যেমন ছিল আমার বাবা সত্যজিৎ
একটু আধটু সর্দিকাশি ছাড়া কোনও দিন বাবার কোনও বড় ধরণের অসুখ হতে দেখিনি
- Total Shares
বাবার চেহারা, গলার স্বর ও তাঁর উচ্চতা দেখে অনেকেই মনে করতেন যে উনি বোধহয় খুব রাশভারী গোছের রাগী মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার বাবা সত্যজিৎ রায়কে দেখলে খুব রাশভারী বলে মনে হলেও বাবা কিন্তু খুব খোলা মনের ও হাসিখুশি মানুষ ছিলেন।
বাড়িতে উনি ছিলেন খুবই সাধারণ। ওঁর মধ্যে বাঙালিয়ানা ছিল পুরোমাত্রায়, যেটা ওঁর ছবির চরিত্রের মধ্যেও ফুটে উঠেছে নানা সময়। আমরা যেমন সবাই জানি যে উনি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতেন, এমনকি গোড়ার দিকে শুটিংয়েও উনি পাজামা-পাঞ্জাবিই পরে যেতেন। তবে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যেখানে সেখানে বসা বা বিভিন্ন কাজে একটু অসুবিধা হত বলে পরের দিকে উনি শুটিংয়ে প্যান্টশার্ট পরে যেতে শুরু করলেন।
বাবার একটা অসাধারণ টাইম ম্যানেজমেন্ট ক্ষমতা ছিল। উনি খেতে ভালোবাসলেও খুব কম সময়ের মধ্যে খাবার শেষ করে ফেলতেন। কারণ উনি মনে করতেন, খাবারে বেশি সময় দিলে ওঁর কাজে দেরি হয়ে যেতে পারে। খাবারদাবার প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় আমরা মাঝে মধ্যেই পার্ক স্ট্রিটের স্কাইরুমে কন্টিনেন্টাল খাবার খেতে যেতাম। বাড়িতে কখনও-যখনও রয়েলের বিরিয়ানিও আসত। তবে বাবা কিন্তু খুব একটা পাঁচতারা হোটেলে যেতেন না।
ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায়
উনি পরিবারকে খুব ভালোবাসতেন। বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে বসে পড়াশোনা করছেন, বাবার এমন ছবিই বেশি দেখা যায়। উনি বাড়িতে থাকলেও ওঁকে খাটে শুয়ে-বসে বা সোফায় একটু গা এলিয়ে বসে আছেন, এমন ভাবে খুব কমই দেখা যেত। উনি ওঁর কাজের জায়গাটাকে খুব ভালোবাসতেন এবং ওঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসেই কাজ করতে পছন্দ করতেন। একটা গল্প বলি এই প্রসঙ্গে।
এই বাড়িটা নেওয়ার আগে মা এসে এই বাড়িটা দেখে যান। তারপর বাবাকে বাড়িটার ব্যাপারে বললে বাবা বলেন, "এলগিন রোডে আমি যাব না, ওটা সাহেবি পাড়া। ওখানে থাকলে আমার লেখা বেরবে না।" কিন্তু মা অনেক বোঝানোর পর তিনি এই বাড়িটা দেখতে এলেন। এসে বলেন যে, এখানে এমন একটাও ঘর নেই যেটা তাঁর কাজের জায়গা হতে পারে। তাই তিনি এখানে আসবেন না। তখন বাড়িওয়ালা বাবাকে পাশের ফ্ল্যাটের একটা ঘর দেখাতেই বাবার খুব পছন্দ হয়ে যায়। সেই ঘরটার চার দিকে কাচের জানলা আর ঘরটা খুব নিস্তব্ধ। এরপর বাড়িওয়ালার তদ্বিরে অনেক চেষ্টা করে পাশের ফ্ল্যাটের ওই অংশটা আমাদের ফ্ল্যাটের সঙ্গে যোগ করার পরেই আমরা এখানে আসি।
উনি ওঁর কাজের ঘরটা এতটাই ভালোবাসতেন যে সেই টানেই তিনি দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকতেন না কেন খুব তাড়াতাড়ি নিজের জায়গায় ফিরে আসতেন। উনি ভীষণ ভাবে চাইতেন যাতে আমরা দিনের কোনও একটা সময়, সেটা দুপুরেই হোক বা রাতে, পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খাবার খাই।
সিনেমার শুটিংয়ের জন্য বাবার সঙ্গে দেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। শুটিংয়ের লোকেশন দেখাটা একটা খুব মজার ব্যাপার ছিল আমার শৈশবে। এ ভাবেই বাবার সঙ্গে আমি রাজস্থান পুরো চষে ফেলেছিলাম। বাবার যখন কোনও বড় ধরণের আউটডোর থাকত, তখন সেটা তিনি আমার ছুটির সময়ে রাখতেন, যাতে আমিও যেতে পারি। তবে যে সব জায়গায় খুব একটা পর্যটক যেত না বাবা সেই জায়গাগুলোতে যেতে বেশি পছন্দ করতেন। তখন জয়সলমের যাওয়াটা খুব কঠিন ছিল, ওখানে কোনও ট্রেন যেত না। বাবার সঙ্গে জয়সলমের, কোটা, বুঁদি, ভরতপুর এবং রাজস্থানের অন্য অনেক জায়গা দেখেছি। আমাদের দুটো খুব প্রিয় জায়গা ছিল-পুরী আর দার্জিলিং। উনি সব সময় বলতেন, আমাদের দেশেই যা দেখার আছে সেটা শেষ করা যায় না।
ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায়
পড়াশোনা ভালো করতে হবে বলে কোনও চাপই দিতেন না বাবা। সত্যজিৎ রায়ের ছেলে বলে স্কুলে কখনও কোনও বাড়তি সুবিধাও পাইনি।
বাবার কোনও সেক্রেটারি বা ম্যানেজার ছিল না। উনি নিজে সমস্ত ফোন তুলতেন, কেউ এলে নিজে গিয়ে দরজা খুলে দিতেন, আর সে রকম লোক হলে যাওয়ার সময় বাবা তাঁকে দরজা অবধি পৌঁছেও দিতেন। বাবার একটা জিনিস আমার ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো লাগত, সেটা হল, প্রাতঃরাশ শেষ করে উনি নিজে হাতে সব ক’টি চিঠির জবাব দিতেন।
বাবার সহ-পরিচালক হিসেবে 'সতরঞ্চ কে খিলাড়ি' আমার প্রথম ছবি এবং পরিচালক হিসেবে আমার প্রথম ছবি 'ফটিক চাঁদ’। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছেলে বলে আমি কিন্তু কখনোই খুব একটা চাপ অনুভব করিনি। তবে প্রথম ছবি করার সময় আমি ওঁকে বলেছিলাম যে তুমি অন্তত শুটিংয়ের সময় সেটে হাজির থেক না, তাহলে তো নানা রকমের কথা রটে যাবে স্টুডিয়ো পাড়ায়। প্রথমদিন উনি যখন 'ফটিক চাঁদ'-এর শুটিং দেখতে এসেছিলেন আমি তখন ওঁকে ফ্লোরে ঢুকতে দিইনি, বললাম বাইরে থেকে আমার পিঠ চাপড়ে চলে যাও।
ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পর যখন সবাই বলল যে ছবিটা বাবা করে দিয়েছেন, তাতে কিন্তু আমার খুব একটা মন খারাপ হয়নি, বরং বেশ আস্বস্তই হয়েছিলাম এটা ভেবে যে, যাক তাহলে বোধহয় ছবিটা ভালোই হয়েছে।
একটু আধটু সর্দিকাশি ছাড়া কোনও দিন বাবার কোনও বড় ধরণের অসুখ হতে দেখিনি। ১৯৮৪ সালে বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়, তারপর একটা অপারেশনও হয়। এর বেশ অনেকদিন পর্যন্ত উনি কাজ করতে পারেননি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমি তখন বেশিদিন বাইরে কোথাও থাকতাম না বা যে সব ছবিতে অনেক আউটডোর আছে সেই সব ছবিগুলো করতাম না। ওই সময়টায় আমরা একটা টেলিভিশন সিরিজ করি যার নাম 'সত্যজিৎ রায় প্রেসেন্টস - পার্ট ১ ও পার্ট ২।তারপর বাবার শরীরের একটু উন্নতি হতে আমার 'গুপী বাঘা ফিরে এলো' শুরু করি। সিনেমাটা করার সময় আমি বেশ একটু চাপে ছিলাম, কারণ তার আগে ওই ফ্র্যাঞ্চাইজির দুটো সিনেমা হয়ে গিয়েছিল। তবে বাবার পরামর্শে এবং তপেনদা, রবিকাকু ও অন্যদের সাহায্যে তেমন কোনও অসুবিধা হয়নি।
ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায়
তখন একটা ব্যাপার খুব লক্ষ করেছিলাম। বাবা কী অসম্ভব মাত্রায় শুটিং করতে চাইছেন কিন্তু করতে পারছেন না। শুটিং করা বা স্টুডিও পাড়ার গন্ধ বাবা ভীষণ মিস করতেন তখন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা শারীরিক সমস্যা হতে শুরু করে, তার ফলে উনি একটু ডিপ্রেসেড হয়ে পড়তেন মাঝে মধ্যে। কিন্তু সত্যজিৎ রায় অসম্ভব পজিটিভ মানুষ ছিলেন। 'গুপী বাঘা ফিরে এলো'তে অনেক ইনডোর ছিল, তাই আমি বাবাকে শুটিংয়ে আসতে বলি। উনি দুপুরের খাবার শেষ করে সেটে আসতেন আর চুপ করে একদিকে বসে সব দেখতেন। শুটিংয়ের হইহট্টগোল খুব উপভোগ করতেন তিনি। কিন্তু বাবা আমার আমার কাজের ব্যাপারে কখনও নাক গলাতেন না।
এরপর উনি আবার ছবির শুটিং শুরু করলেন। যে ডাক্তারই বাবাকে দেখতেন তাঁরাই বলতেন যে, কাজের মধ্যে থাকলেই বাবা ভালো থাকেন। কিন্তু তাঁরা অবশ্য বাবাকে ক্যামেরা চালাতে বারন করেছিলেন। জীবনের শেষদিন অবধি উনি নিজের সব কাজ নিজে হাতে করেছেন।
একদিন উনি ঠিক করলেন, 'গোরস্থানে সাবধান' বইটা লিখবেন। দীর্ঘদিন পার্ক সেমেট্রিটা দেখা হয়নি বলে লেখার আগে গোরস্থানটা একবার দেখতে যান। তখন তো আর জায়গাগুলো আজকের মতো এতটা পরিষ্কার-পরিছন্ন ছিল না। ওখানে গিয়ে মশার কামড় খেয়ে ওঁর একটা সাংঘাতিক ম্যালেরিয়া হয়, সেটা হয় একেবারে জয় বাবা ফেলুনাথ শুটিংয়ের সময়ে।
বাবা আমার ছবির ফার্স্ট কাট দেখতেন। তাই উনি মারা যাওয়ার পর মনে হয়েছিল এবার আমার ছবির ফার্স্ট কাটকে দেখবে। হি ওয়াজ মাই সেন্সর। যে ব্যাপারটা আমাকে খুব বেদনা দেয়, সেটা হল বাবা ইউনিটের যে সব মানুষজনকে নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের সংখ্যা এখন আস্তে আস্তে কমে আসছে।
ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায়
আমার ছেলে সৌরদীপের যখন দু'বছর বয়স, তখন বাবা মারা যান। তাই আমার ছেলে সৌরদীপের তার ঠাকুরদার স্মৃতি খুবই কম। সে এই পেশায় আসবে কিনা জানি না। তবে আমি কম্পিউটারের কোনও ব্যাপারে যখন একটু আটকে যাই, তখন আমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করে নিই। আমি যেমন আমার পেশাজীবন শুরু করি বাবার সিনেমার ছবি তুলে, ঠিক তেমন সৌরদীপ এখন আমার সিনেমার আর সিনেমার শুটিংয়ের ছবি তুলছে। ওর লেখার হাত খুব ভালো, তাই ওকে আমি আমার সিনেমার জন্য সাব-টাইটেল লিখতে উৎসাহ দিই। তবে আমার বাবাও যেমন কোনও দিন আমাকে কোনও ব্যাপারে চাপ দেননি ঠিক তেমন আমিও সৌরদীপকে কোনও বিষয়ে চাপ দিতে চাই না। ওর যদি ইচ্ছে হয় ও পরিচালনায় আসবে, দাস দা রে লেগেসি উড কন্টিনিউ...