স্বাধীন ভারতের সেই রূপকার যিনি কোনওদিন কর্তৃত্ব ফলাননি
হিন্দোল সেনগুপ্তর লেখা দ্য ম্যান হু সেভড ইন্ডিয়া পুস্তকের নির্বাচিত ও সম্পাদিত অংশ
- Total Shares
সর্দার প্যাটেল যেন এক মহীরূহ
আমরা জানি যে সর্দার প্যাটেলের কার্যকলাপ ও তাঁর দৃঢ়তার কাছে ভারত গভীর ভাবে ঋণী। যদিও তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরূপ আচরণের জন্য আজ তিনি বিস্মৃতপ্রায় এক ব্যক্তি। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, যে ভারতের রূপকার হলেও তিনি কোনওদিনই আধিপত্য কায়েম করেননি, সেই ভারতের অনুসরণ করা উচিৎ ছিল সেই ‘লৌহমানব’কেই। এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নেয়ে হিন্দোল সেনগুপ্তের গভীর গবেষণামূলক বই দ্য ম্যান হু সেভড ইন্ডিয়া আসলে ভারতের স্বাধীনতার কথাই বলে।
হিন্দোল সেনগুপ্তের সেই ইংরেজি বইয়ের অংশবিশেষের সম্পাদিত অংশ:
(পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস ইন্ডিয়ার অনুমতিক্রমে গ্রন্থটির সারাংশ মুদ্রিত হয়েছে)
***
সর্দার প্যাটেল ছিলেন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, মহাত্মা গান্ধী ছিলেন পাঁচ ফুট ৩ ইঞ্জি। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন পাঁচফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা আর জওহরলাল নেহরু ছিলেন পাঁচফুট আট ইঞ্চি লম্বা।
“এ থেকে কী বোঝা গেল?” আমার স্কুলের এক শিক্ষক এ কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
“এর মানে হল, যাঁরা লম্বা তাঁরাই ইতিহাস তৈরি করেন।” গণিতের যে শিক্ষক এ কথা বলেছিলেন তিনি একাজ শ্রেণীর ছাত্রদের চেয়েও লম্বায় খাটো ছিলেন।
“তা হলে কে লম্বা ছিলেন?’’
স্তব্ধতা।
“মহম্মদ আলি জিন্না। জওহরলাল মতোই পাঁচফুট আট ইঞ্চি লম্বা।”
একই মাপের নেতা? জওহললাল নেহরু ও মহম্মদ আলি জিন্না
তা হলে? প্রায় কিছুই বুঝে উঠতে না পারা কলকাতার ওই শ্রেণিকজ্ঞের মধ্যে প্রশ্নটা এক মুহূর্ত ঘুরতে লাগল।
“বাকিদের চেয়ে লম্বা হওয়ায় দু’জনেই নিজেদের দেশ পেয়েছিলেন।”
গণিতের সেই শিক্ষক নিজেই ইতিহাসের ক্লাস নিতে গিয়ে বলেছিলেন, ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেল – অনেকেই মনে করতেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন – আসলে ওঁরই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল — আজ তিনি উপেক্ষিত। আগামী কয়েক বছর তিনি আমার স্মৃতিপটে থাকবেন একজন খর্বকায় ব্যক্তি হিসাবেই, তার বেশি কিছু নয়।
...
বয়স যখন বছর কুড়ি পার হয়ে গেল, তার আগে নয়, তার পরেই আমি আমার দেশ সম্বন্ধে অন্য মতামতগুলো জানতে শুরু করলাম আর ক্রমেই আশ্চর্য হতে লাগলাম...
...
এই অনুসন্ধান করতে করতে একদিন সেই ব্যক্তির সম্বন্ধে জানতে শুরু করলাম, যাঁর নাম বল্লভভাই ঝাবেরভাই প্যাটেল। আজকাল নতুন এক ধাঁচে ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে, মহান ব্যক্তিত্বের ধ্যানধারণা, যেখানে বিভিন্ন ঘটনাকে তার পারিপার্শিকতা হিসাবে দেখানো হয়, যার মধ্যে থাকে সেই ‘মহান ব্যক্তি’কে বঞ্চনা করার কথাও, একেই মানবজাতির ইতিহাস হিসাবে বিবেচনা করা হয়... তবে আমি যখন পড়ি, অন্য ভাবে বলতে গেলে আমি যে ভাবে ভাবি, মনে করি ভারতের ইতিহাস বড় মহান ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তারপরেও একটা কথা বলা যায় যে সব মহান ব্যক্তিত্বর কথাই রয়েছে এমন নয়, কয়েকজনমাত্র মহান ব্যক্তির কথা রয়েছে।
...
ইতিমধ্যে আমি এই বইটি নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি যখন সর্দার প্যাটেলের মূর্তি তৈরি শুরু হয়েছে।
স্টেট অফ ইউনিটির কল্পরূপ (স্টেটঅফইউনিটি.ইন)
নতুন দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রিট-সহ বিভিন্ন জায়গায় আগে থেকেই সর্দার প্যাটেলের স্ট্যাচু রয়েছে। এই রাস্তাটির নাম করলাম কারণ রাস্তাটি সরাসরি সংসদে গেছে। এই মূর্তিটি অবশ্য খুব একটা সুন্দর দেখতে নয়। যে ভদ্রমহিলাকে ওই মূর্তির বেদিটি পরিষ্কারের ভার দেওয়া রয়েছে তিনি সত্যিই ওই মূর্তিটি সম্বন্ধে কিছুই জানেন না বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে। আরেকটা কথা, ওই মূর্তিটি কবে শেষ পরিষ্কার করা হয়েছে সে কথা কেউই জানেন না।
অতএম নতুন মূর্তিটি বানাতে হবে প্যাটেলের নিজের রাজ্য গুজরাটে। এটিতে উৎসাহ রয়েছে গুজরাট সরকার ও রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী (প্রকল্পটি ঘোষণা হয়েছিল ২০১০ সালে) তথা ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। এর নকশা করেছেন পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ জয়ী রাম বনজি সুতার, যিনি অন্তত ৫০টি বিরাট ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন যার মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর একটি মূর্তিও রয়েছে। সর্দার প্যাটেলের মূর্তিটি তৈরিতে খরচ পড়ছে ৪৪ কোটি টাকা, যার একাংশ দিচ্ছে সরকার ও বাকিটা জোগাড় হচ্ছে চাঁদা তুলে।
স্ট্যাচু অফ ইউনিটি তৈরি হচ্ছে সর্দার প্যাটেলের জীবন ও কীর্তির চেয়ে আরও বেশি কিছু তুলে ধরার জন্য। এটা হবে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মূর্তি – চিনের স্প্রিং টেম্পল বুদ্ধ (১৫৩ মিটার) ও আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টির চেয়েও লম্বা। এর উচ্চতা হবে ১৮২ মিটার (প্রায় ৬০০ ফুট)
...
আরও একটা ব্যাপার, ভারত নিজেকে বিশ্বের নিরিখে কোন অবস্থায় দেখছে।
...
মনে করা হচ্ছে যেটি বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি হতে চলেছে – উদ্বোধানের দিন সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম আসবে – যার ফলে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ‘কোমল শক্তি’ রূপটি প্রতিষ্ঠিত হবে।
নেহরু, গান্ধী ও প্যাটেল: যে তিনজন নেতা স্বাধীন ভারতের রূপকার ছিলেন
আমার মনে হয়, প্যাটেলের এমন একটি মূর্তি নির্মাণের নেপথ্যে নিশ্চিত ভাবে অন্য কারণও আছে বলে আমার মনে হয়। লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ারের মূর্তি, যেটি ভারতে জন্ম হওয়া ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ মেঘনাদ দেশাইেয়র উদ্যোগে তৈরি হয়েছে, সেই মূর্তি সহ অন্তত সত্তরটি দেশে জাতির (আধুনিক ভারতের) জনক মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি রয়েছে... প্রথম প্রধানমন্ত্রী তথা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অন্তত আটটি মূর্তি রয়েছে, এ ছাড়াও মরিশাসেও একটি মূর্তি রয়েছে।
...
তবে যে ভারত আমরা দেখি, আক্ষরিক ভাবে হোক বা রূপকঅর্থে, স্বাধীন ভারতকে নেহরু যে ভাবে গড়তে চেয়েছিলেন আমরা কখনোই সেই ভারতকে পাইনি—আজ আমরা ভারত বলতে যা বুঝি সেটি প্যাটেলের ভারতও নয়।
তর্কের খাতিরে বলতে পারি (এটি একান্ত ভাবেই আমার যুক্তি) রাষ্ট্র হিসাবে আধুনিক ভারত প্যাটেলের কাছে যতটা ঋণী তা গান্ধী বা নেহরুর চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
...
আমি একটি ছোট্ট পরীক্ষা করেছিলাম। আমি দেখছিলাম যে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের দু’টি জনপ্রিয় বই সুনীল খিলনানির আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া এবং রামচন্দ্র গুহর ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী বই দু’টিতে এই দু’জনের কথা কত বার উল্লেখ করা হয়েছে। আমি জানতাম যে সংখ্যার বিচারে নেহরুর এগিয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক কারণ তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং টানা সতেরো বছর এই পদে আসীন ছিলেন। আমি তাও দেখতে চেয়েছিলাম কতটা! পার্থক্য ঠিক কতটা।
খিলানির বইয়ে প্যাটেলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে আর বার এবং নেহরুর কথা পঁয়ষট্টি বার। ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী বইয়ে গান্ধীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে আটচল্লিশ বার এবং নেহরুর কথা একশো পঁচাশি বার – প্রায় চার গুণ বেশি বার।
মহান পুস্তক, লেখকরাও মহান। কোনও কারণে মহান ব্যক্তিত্ব তাঁদের নজর এড়িয়ে গেছেন
আমি জানি যে মজার একটা তথ্য তুলে ধরা ছাড়া এর আর কোনও মূল্য নেই, তা ছাড়া এর মানে এই নয় যে এই দুই লেখকের সমালোচনা করা হচ্ছে, তাও আমার মনে হয় যে জাতীয় প্রেক্ষিতে ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্যাটেলের ভূমিকা কত অল্প ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে – যদিও ভারতীয় জনতা পার্টি তাঁর ভূমিকা তুলে ধরার আগের কথাই বলছি – রাজামোহন গান্ধীর কথায়, তাঁর অবদার কী অকিঞ্চিৎকর হিসাবে দেখানো হয়েছে...
...
আমার কথা হল, যে আন্দোলনের জেরে ব্রিটিশ সাসন থেকে বারত স্বাধীনতা লাভঊ করে সেই আন্দোলনের তিনজন স্তম্ভের মধ্যে একজন স্তম্ভের মর্যাদার দাবিদার প্যাটেল, হয়তো তিনিই এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত, আক্ষরিক ও রূপক – দুই অর্থেই, এবং স্বাধীনতার আগে থেকে ১৯৫০ সালে তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তাঁর অবদান নেহরুকে চাপিয়ে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নেহরুর যে বেশ কয়েকটি ভালো ভালো ভাবনা ছিল, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই, তবে মাটির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পাকিস্তান, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ও চিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্যাটেলের যে সম্যক ধ্যানধারনা ছিল, নেহরু সেই পথে ভাবনাচিন্তা করলে হয়তো ফল ভালো হত। তার মানে অবশ্য এই নয় যে নেহরু-প্যাটেল সম্পর্ক খুব খারাপ ছিল বা গান্ধী-প্যাটেল সম্পর্ক ছিল নিছক শোষণমূলক – এমন কথা বলা ঠিক তো হবেই না বরং অনুচিতই হবে; নিঃসন্দেহে এই তিনজনের মধ্যে ভাতৃত্বের সম্পর্ক ছিল। তাঁরা তিনজনেই মহান ব্রতের অংশ ছিলেন যে ব্রত ছিল তাঁদের প্রাণাধিক প্রিয়।
নিরপেক্ষ ভাবে যদি বিচার করা হয়, তা হলে দেখা যাবে যে এই তিনজনের মধ্যে প্যাটেলই ব্যক্তিস্বার্থ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি করে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন বাকি দু’জনের চেয়ে – যদিও তিনি ব্যক্তি হিসাবে অনেক উজ্জ্বল ও ক্ষুরধার মস্তিস্কের ছিলেন। এ নিয়ে একটা ছোট্ট উদাহরণ হল, বাকি দু’জনকে নিজেদের কথা ব্যাখ্যা করার জন্য প্রচুর লেখালিখি করতে হয়েছে, বিশাল মোটা মোটা বই তারা লিখেছেন, স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনার নিয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছে... তবে প্যাটেল নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বলার জন্য কোনও বই লেখেননি, তিনি কী ভাবে দেখছেন সে কথা বলেছেন, যা থেকেই আগামী প্রজন্মকে তাঁর গুরুত্ব বুঝতে হচ্ছে। এ সবই মনে করে দেয় তাঁর লক্ষের কথা – তাঁর কাজ – তাই তাঁকে দেখা যেতে পারে তাঁর লেখা চিঠির মধ্য দিয়ে। তবে চাঁর চিঠি নেহরু ও গান্ধীর মতো স্মৃতিমেদুর, দুনিয়র অবস্থা ব্যাখ্যা করা বিশাল ছিল না।
স্বভাবতই এই তিন জনের মধ্যে যাঁকে নিয়ে সবচেয়ে কম লেখা হয়েছে, তা সে জীবনীই হোক বা তাঁকে নিয়ে কোনও বই, তিনি হলেন প্যাটেল। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম, যেন যেই একটা কাজ তিনি সম্পন্ন করে ফেলছেন, প্যাটেল যেন তাঁর সেই সংক্রান্ত স্মৃতি একেবারে যেন ভারতের স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলতে চাইতেন।
***