কফি হাউস: সব কর্মীর বেতন সমান, টিপসও ভাগ হয় সমান ভাগেই
এখানে প্লেট ধুয়ে শুরু হয় জীবন, রান্না শিখলে তবেই রাঁধুনি
- Total Shares
ডেল কার্নেগির কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। সামান্য কারিগর থেকে ধীরে ম্যানেজার হয়ে ওঠার সেই গল্প। গল্পই বটে। বাস্তবে এমন হয় নাকি? কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে গিয়ে বুঝলাম এমনও হয়। কথা হচ্ছিল কাউন্টারে বসা জাহিদ হুসেনের সঙ্গে। ১৯৫৩ সাল থেকে এই বাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। তখন তাঁর বাবা ছিলেন। পরে তিনি কাজে যোগ দেন, ১৯৭৬ সালে। প্রথমে প্লেট ধুতেন। তার পরে রাঁধুনি হয়ে যান, এখন কাউন্টার সামলাচ্ছেন।
এখনও আড্ডা চলে টেবিলে টেবিলে
জাহিদ বললেন, “এটাই এখানে নিয়ম। যারা কাজে যোগ দেয় তাদের প্রথম প্লেট ধুতে হয়। তার পরে যে কাজ সে ভালো রপ্ত করতে পারে, সেই কাজই সে করে। এখানে ভালো-মন্দ কাজ বলে কিছু নেই। সকলের সমান বেতন। অমুক কাজে বেশি, তমুক কাজে কম—এমন কোনও ব্যাপার নেই। ধোয়া-মোছার জন্য আলাদা লোক আছে, বাকি সকলকেই এখানে সব কাজ করতে হতে পারে।”
যাঁরা ওয়েটার, তাঁরা তো টিপস পান! তাঁদের আয় নিশ্চয়ই অন্যদের চেয়ে বেশি? জাহিদ বললেন, “যে যাই টিপস পাক, দিনের শেষে তা এক জায়গায় জড়ো করা হয়। সেটাও সমান ভাগে ভাগ করা হয়। সমবায় তো, কোনও বেশি-কম নেই।”
ভিড়ে ঠাসা দু’টি তলা মিলিয়ে ৩০০-র বেশি আসন। সকাল গড়ানোর কিছুক্ষণ পর থেকে সর্বক্ষণই ভরে থাকে চেয়ার। টানা জোগান দিয়ে যাওয়া হচ্ছে খাবারের, সঙ্গে কফি। কফি বোর্ড হাত তুলে নেওয়ার পরে সমবায় করে চালানো এই কফি হাউসে কে না এসেছেন! বাম আমলে কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা এখানে আসতেন। রাজনৈতিক তর্ক জমে উঠত, ঢিমে তালে চলা পাখার হাওয়ায় ভেঙে যেত সিগারেটের ধোঁয়ার রিং। কফি হাউসের কোনও কর্মী কোনও দিন জড়িয়েছেন কোনও রাজনীতির সঙ্গে?
জাহিদ বললেন, “না না, আমরা ও সবের মধ্যে নেই। এখানের কেউ কোনও দিন ও সব আলোচনায় থাকে না। এখানে আগে সব কবি-সাহিত্যিকই আসতেন। অনেকেই মারা গেছেন। যাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন তাঁরাও আর আসতে পারেন না। নতুনরা আসেন। আমি তো জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে (রাজ্যের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী) দেখেছি। তাঁরাও এসেছেন এখানে। এখনও তরুণ সাহিত্যিকরা এখানে আসেন।”
এখনও আলোচনা হয় সাহিত্য নিয়ে
আর মান্না দে?
জাহিদ বলেন, “আমি দু’বার আসতে দেখেছি। আমরা ওঁকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে অনেক কিছু খেতে অনুরোধ করেছিলাম। উনি এককাপ কফি আর একটা স্যান্ডউইচ ছাড়া আর কিছু খাননি।”
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা সত্যিই এখন নেই। একটা টেবিলে এখন আর সাত জন বসেন না, চাইলে হয়তো বসতেও পারেন। তবে চারটেতে শুরু করে জমিয়ে আড্ডা মেরে সাড়ে সাতটায় ওঠার উপায় আর নেই। কারণ এই যুগে এক কাপ কফি নিয়ে যদি সাত জনে মিলে সাড়ে তিন ঘণ্টা বসে থাকেন, তা হলে কফি হাউসটাই উঠে যাবে যে! ধূমপান এখানে নিষিদ্ধ, তবুও চারমিনার না হোক অনেকের ঠোঁটে এখনও জ্বলে সিগারেট... না হলে আড্ডাটা জমে না বোধ হয়।
তিন-চারঘণ্টা আড্ডা দেওয়ার জো নেই
জাহিদ বলেন, “এখানে অনেক দিনই ধূমপান নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তবে অনেকে এখনও ধূমপান করেন। আমরা অবশ্য তেমন কিছু বলি না। আর লোকে জানে, আজকালকার দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটু খাবার নিয়ে বসে থাকলে কফি হাউসটাই উঠে যাবে। কাউকে বলতে হয় না, খাবার ফুরোলে তাঁরা নিজেরাই উঠে যান।” কফি হাউস যখন বন্ধ হবে হবে করছে, তখন কবি-সাহিত্যিকরা বেঁচে যাওয়া কাটলেট নিজেরা ভাগ করে কিনে নিয়ে যেতেন, বাঙালির আড্ডার এই পীঠস্থানকে রক্ষা করার জন্য।
ধূমপান নিষেধ, তবু এখনও তা জ্বলে ঠোঁটের কোণে
১৮৭৬ সালের এপ্রিলে তৈরি হয় অ্যালবার্ট হল। পরে সেখানেই ১৯৪২ সালে তৈরি হয় কফি হাউস। স্বাধীনতার পরে নাম বদলে সেটি হয়ে যায় কফি হাউস। কফি বোর্ড সরে যায় ১৯৫৩ সালে। শুরু হয় অচলাবস্থা। ১৯৫৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় বাঙালির আড্ডার পীঠস্থান। উল্টোদিকের রাস্তায় থাকা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উৎসাহে এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়, শিক্ষাবিদ নির্মলচন্দ্র চন্দ্র-সহ বেশ কয়েকজনের উদ্যোগে নতুন করে খোলে কফি হাউস। ওয়েটার মন্টু দাস বলেন, “মুনি লাল, চুণী লাল, বামু বাবু, নায়েক বাবু, মহম্মদ সাকিব প্রমুখ ছিলেন সেই সময়ে। সাকিবের ছেলেই হলেন জাহিদ।”
সব টিপস ভাগ হয় সমান ভাগেই
১৯৭৬ সাল থেকে এখানে কাজ করছেন জাহিদ, তাঁর দাবি, এই মুহূর্তে তিনিই সবচেয়ে পুরোনো লোক। বিহার থেকে এসে এ রাজ্যের পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে গেছেন। বিহারেও সম্পত্তি আছে। নকশাল আমলের কথা তিনি শুনেছন। তিনি শুনেছেন, একবারই মাত্র নকশালরা এই বাড়িতে হামলা করেছিল। কাচ ভেঙেছিল। কিন্তু তাঁদের অনুনয়ে আন্দোলনকারীরা চলে যায় বেশি ক্ষতি না করে। তখন একবার বন্ধ হয়েছিল। পরে বাংলা বনধের দিনগুলি ছাড়া অন্য কোনও দিন এই কফি হাউস বন্ধ হয়নি।
কফি হাউসে অনেক দিন পরে গিয়ে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। প্লেটে করে যাচ্ছে চাউমিন। আগে তো দেখিনি!
কফি থাকেই, সঙ্গে অন্য খাবার
জাইদ বলেলন, “কফি, পকোড়া আর স্যান্ডউইচ আছে আগের মতোই। প্রথম দিকে ছিল ভেজ আর চিজ স্যান্ডজউইচ। তখন লোকে চিকেন খেত না। পরে চিকেন যোগ হয়। তবে চাহিদা অনুযায়ী অনেক কিছুই বদলেছে প্রথম দিকে ইডলি ও দোসা পরিবশন করা হত। তার পরে চালু হয় কাটলেট। এটা বাঙালিরা খুব পছন্দ করে। ইডলি ও দোসা অবশ্য চাহিদার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এখন লোকে চাইনিজ ও রোল চায়। ব্যবসা চালাতে গেলে সময়ের সঙ্গে খাবার তো বদলাতেই হবে! দেখুন না, চারদিকে কত মোমোর দোকান হয়েছে।”
সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে/ সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই/ একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি/ শুধু সেই সেদিনের মালি নেই...