ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রথম কার্যালয়ে টাকাপয়সার বিবর্তন নিয়ে জাদুঘর
নষ্ট করে ফেলা টাকা দিয়ে তৈরি হচ্ছে শৌখিন জিনিস
- Total Shares
প্রবেশ করে ভিটিটার্স বুকে নাম লেখার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন, কেন এসেছি। মিউজিয়াম দেখব বলা মাত্রই গাইড চলে এলেন। বলতে শুরু করলেন একেবারে দেওয়ালের নকশার ব্যাখ্যা থেকে। দরজায় যে এক টাকার কয়েনের ছবি রয়েছে সেটি হায়দরাবাদ টাঁকশালে তৈরি এবং কী ভাবে বোঝা যায়, সেই ব্যাখ্যাও করলেন।
মিনিট পাঁচ-সাত সেখানেই কেটে গেল। তারপরে ভিতরে ঢুকতেই কিউরেটর নিজে দেখা করে গেলেন এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এসে ঘুরিয়ে দেখালেন সদ্য চালু হওয়া জাদুঘরটি। ওঁরা শুধু একটা পরিচয়ই পেয়েছিলেন, মুদ্রা নিয়ে আগ্রহ আছে। সেই সূত্রে আমার কোনও পরামর্শ আছে কিনা তাও জিজ্ঞাসা করলেন।
ভারতীয় নোটের বিভিন্ন মোটিফের কোলাজ। (নিজস্ব চিত্র)
এখনও পর্যন্ত নয় নয় করে পঞ্চাশের অনেক বেশি জাদুঘর দেখেছি, কোনওটা সরকারি, কোনওটা ব্যক্তিগত – কিন্ত এমন অভিজ্ঞতা হয়নি আগে। জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গেছি, সেখানেও এমন অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও।
কলকাতায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিস বলতে লোকে যে বাড়িটিকে চেনেন, সেই বাড়িটি নয়, কারেন্সি বিল্ডিংও নয় – ৮ নম্বর কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটেই সদ্য চালু হয়েছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের জাদুঘর। এটি বিবাদী বাগ চত্বরে, শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে।
জাদুঘরের উদ্দেশ্যটি আর পাঁচটা জাদুঘরের চেয়ে ভিন্ন। এই জাদুঘরের উদ্দেশ্য অতীতকে দেখানো নয়, বরং ভবিষ্যৎকে উপস্থাপন করা।
ইতিহাস, নীচে প্রদর্শিত মুদ্রা। (নিজস্ব চিত্র)
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মারফত প্রয়োজনমতো টাকা ছাড়া হয় বাজারে, তারপর সেই টাকা আবার ফিরে আসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে। নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে সেটি নষ্ট করা হয়। সেই নষ্ট করা টাকার মণ্ড দিয়ে ইঁট বানিয়ে সেগুলি বেচে দেওয়া হয়। এখন সেই সব মণ্ডকে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে তা দিয়ে চাবির রিং, ফাইলের কভার প্রভৃতি বানানো হচ্ছে বিক্রির জন্য। এখনই অবশ্য কেনা যাবে না, কারণ কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দাম ও বিল করার ব্যপারটি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সে সব করা নিষেধ, ভোটপর্ব মেটার আগে সে সব অনুমোদন আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
টাকা তৈরির পদ্ধতি থেকে শুরু করে টাকা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে অবশেষ দিয়ে ইঁট বানানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে ছবির মাধ্যমে, দেওয়ালে। ওই ইঁটের কাঁচামাল দিয়ে ভাস্কর্য করে দেওয়াল সাজানো হয়েছে দেওয়াল।
বাতিল পয়সা (এক পয়সা থেকে ২৫ পয়সা) বানানো হয়েছে ভাস্কর্য। যেহেতু সরকারি ভাবে এই পয়সাগুলি বাতিল তাই নিয়ম অনুসারে এগুলি গলিয়ে ফেলার কথা। তা না গলিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে ভাস্কর্য তৈরিতে। তাই একে ভ্যান্ডালিজম বলা যাবে না কোনও অর্থেই।
এই ভাস্কর্যে ব্যবহার করা হয়েছে বাতিল পয়সা। (নিজস্ব চিত্র)
মূল জাদুঘরে রয়েছে বিনিময় প্রথা থেকে টাকার বিবর্তনের ইতিহাস, বিভিন্ন ধরনের টাকা-পয়সা (কয়েকটি আসল, বেশ কয়েকটি রেপ্লিকা, মূলত নিরাপত্তার কারণে), সিন্ধু সভ্যতার মডেল এবং বিশ্বের বৃহত্তম মুদ্রার প্রতিরূপ। অল্প কথায় তার বর্ণনাও রযেছে।
ভল্ট কেমন হয়, তার আন্দাজ এখানে পাওয়া যাবে, সেটি করা হয়েছে সাবেক একটি ভল্টেই। রয়েছে টাচ-স্ক্রিনের মাধ্যমে নানা তথ্য জেনে নেওয়ার উপায়। অনেকটা বিজ্ঞান-সংক্রান্ত জাদুঘরের মতোই আধুনিক ভাবনায় এই জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। বিদেশের স্পেসিমেন নোটও রয়েছে। দেশের নোট নিয়ে বানানো হয়েছে তথ্যচিত্র।
বৃহত্তম মুদ্রা ইয়াপ পাথর এবং তার সামনে রাখা কড়ি-সহ বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা। (নিজস্ব চিত্র)
যাঁরা শুধুমাত্র টাকাপয়সার ইতিহাস জানার জন্য এখানে যাবেন বা প্রাচীন যুগের টাকা-পয়সা দেখার জন্য যাবেন, তাঁদের মন নাও ভরতে পারে। আসলে এই জাদুঘরের ভাবনাটি একটু অন্যরকম। সাধারণ মানুষ যাতে আর্থিক বিষয়ে সচেতন হতে পারেন (ফিনান্সিয়াল এডুকেশন), সে কথা মাথায় রেখেই এই জাদুঘরের ভাবনা। এখনও কাজ চলছে অন্য একটি তলে যেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা নিজেরই কম্পিউটার গেম খেলতে পারবে এই জাদুঘরে এবং তার মাধ্যমেই তারা জেনে যাবে সাধারণ ভাবে ব্যাঙ্কে গিয়ে কী করা উচিত, টাকাপয়সা বিনিয়োগ কী ভাবে করা উচিত প্রভৃতি।
সাড়ে চব্বিশ মিনিটের ফিল্মও বানানো হয়েছে, সেটিও দর্শকরা দেখতে পারেন চাইলেই। তবে যাওয়ার আগে মনে রাখবেন, প্রতি সোমবার ও জাতীয় ছুটির দিন বন্ধ থাকে এই জাদুঘর। অন্য দিন খোলা থাকে সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা।
জাদুঘরের একাংশ। (নিজস্ব চিত্র)
১৯৩৪ সালে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পথ চলা শুরু করেছিল যে সদন থেকে, সেখানে কেন এত দেরিতে জাদুঘর করা হল, এই প্রশ্ন ওঠা খুবই সঙ্গত। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রথম কার্যালয় শুরুর প্রায় ৮৫ বছর পরে সেখানে জাদুঘর চালু হল ঠিকই, তবে তা হয়েছে জেন ওয়াই এবং জেন এক্সের কথা ভেবে। তাই দেরিতে জাদুঘর তৈর হওয়াকে সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
শহরেই ভারতীয় জাদুঘরের মুদ্রা বিভাগে ভারতীয় ধাতব মুদ্রার বিবর্তন ধরা রয়েছে। তাই এই জাদুঘরে সেই একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটলে কাজের কাজ কিছু হত না, তাই তাঁদের চিন্তাভাবনা বেশ ভালো। তবে একই সঙ্গে দুটি বিষয় তাঁরা ভাবনায় রাখতেন পারেন। প্রথমত, কলকাতা টাঁকশাল তো বটেই, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুদ্রা এখানে স্থায়ী ভাবে প্রদর্শিত করা যেতে পারে। যদি বাংলার মুদ্রা নিয়ে তাঁরা কোনও প্রদর্শনী করেন, তা হলে তো কথাই নেই। দ্বিতীয়ত, কারেন্সি নোটের জাদুঘর। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অধীনে এমন জাদুঘর থাকলেও, কলকাতায় এমন একটি স্থায়ী প্রদর্শনী দরকার। এই বিভাগে বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া যেতে পারে এক টাকার নোটের উপরে।
হরপ্পায় সময় কেনাকাটার মডেল। (নিজস্ব চিত্র)
শেষে বলতে হয়, মডেলের সাহায্যে হরপ্পার যে চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সেখানে অনেকগুলি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত তখন ওই ধরনের পোশাকের চল ছিল না, দ্বিতীয়ত তখন খুব সম্ভবত দাঁড়িপাল্লা ছিল না। তৃতীয়ত, যে ঘর দেখানো হয়েছে তেমন ঘরও ছিল না। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের জন্য যিনি এই মডেল বনাচ্ছেন, তাঁর অনেক বেশি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।