রেনবো জেলি খায়িয়ে খারাপ মামাকে ভালো বানানো - এটাই দুষ্টু গন্ডারিয়ার শাস্তি
সিনেমাটি হ্যাবিট্যাট ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নির্বাচিত হয়েছে
- Total Shares
আমার ছবি 'রেনবো জেলি' আসলে হল একটা ফুড ফ্যান্টাসি, অর্থাৎ খাবার নানা স্বাদ কী ভাবে আমাদের মনকে প্রভাবিত করে সেটাই আমি আমার ছবির মাধ্যমে দেখাবার চেষ্টা করেছি।
ছবির প্রধান চরিত্র ঘোঁতন বারো বছরের একটি অটিস্টিক অনাথ শিশু যে তার দুষ্টু মামা - গণ্ডারিয়ার সঙ্গে থাকে। গণ্ডারিয়ার চরিত্রটা অনেকটা আমাদের ছোটবেলায় পড়া চরিত্র সেলফিশ জায়েন্টের মতো। ঘোঁতনের তাকে যখের ধনের স্বপ্ন দেখায়। গণ্ডারিয়া তাকে বলে যে ঘোঁতনের বাবা মারা যাওয়ার সময় ঘোঁতনের জন্য রেখে গেছেন যখের ধন, যার পাসওয়ার্ড ঘোঁতনের আঠারো বছর বয়স হলে তার মামা তাকে দেবে। ছেলেটা তার মামাকে বিশ্বাস করে।
একদিন আচমকাই এক বয়স্ক মহিলা আসেন এবং ঘোঁতনকে বলেন যে তিনি পরীপিসি। তাঁর কাছে একটা বর্মী বাক্স আছে যাতে সাত-সাতটা রান্নার মসলা আছে-মিষ্টি, ঝাল, টক, তেতো, কষা,নোনতা ও ঝাঁঝালো। এই মশলার সাহায্যে ঘোঁতন চাইলে আগামী আটদিনের মধ্যেই সেই যখের ধন পেয়ে যেতে পারে। সাতটা মসলা দিয়ে সাত রকম স্বাদের রান্না করে মামাকে খাওয়াতে পারলে মামা তাকে ওই যখের ধনের খোঁজ দিয়ে দেবেন।
ছবি সৌজন্যে: ইন্ডিজেনাস প্রোডাকশন
এই ভাবে বিভিন্ন স্বাদের রান্না খেয়ে মামার স্বভাব-চরিত্রের বদল ঘটতে থাকে এবং অবশেষে মামা যখের ধনের পাসওয়ার্ডটা বলে দেন। পরীপিসি ঘোঁতনকে একটা শর্ত দিয়ে বলেন যে এই সাত দিন মামার এঁটো খাবারের কিছুটা পিসিকে এনে দিতে হবে। এই সাতটা স্বাদের এঁটো দিয়ে অষ্টম দিনে পরীপিসি যে রান্নাটা করবেন, সেই রান্নাটার নাম রেইনবো জেলি। এই খাবারটার মধ্যে সাত রকমের রং ও সাত রকমের স্বাদ একসঙ্গে রয়েছে যেটা খেলে একজন ব্যক্তি বদলে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে উঠবে।
এই সিনেমায় প্রধান চরিত্র ঘোঁতন ও ভিলেন মামা গণ্ডারিয়ার মধ্যে একটা লড়াই হয় যেখানে ঘোঁতন গন্ডারিয়াকে হারাতে চায় কিন্তু গন্ডারিয়াকে পরাস্ত করে নয় বরং গণ্ডারিয়ার ভিতরের খারাপ মানুষটাকে পরাস্ত করে তাঁকে একজন ভালো মানুষে রূপান্তরিত করে। রেইনবো জেলি খায়িয়ে একটা খারাপ মানুষ থেকে ভালো মানুষ বানানো -সিনেমায় এটাই দুষ্টু গণ্ডারিয়ার শাস্তি।
ছবিটা লেখিকা লীলা মজুমদারকে উৎসর্গ করা হয়েছে। লীলা মজুমদার বলেছিলেন বাচ্চাদের ভিলেনও যেন নিষ্ঠুর না হয়; সেই ভিলেনকে দেখেও যেন কষ্ট ও মায়া হয়। শিশুমনের জায়গা থেকে হিংস্রতা শোভা পায় না। আমার এই ছবিতে দেখতে চেয়েছি যে সবসময় খারাপকে পরাস্ত করার জন্য হিংসা কিংবা তাকে হারিয়ে দেওয়াটাই একমাত্র উপায় নয়। খারাপকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে ভালো করে দেওয়াটাও একটা প্রতিশোধের উপায় হতে পারে। একজন ব্যক্তি খারাপ কিংবা ভালো হয় না, তাঁর মধ্যে ভালো কিংবা খারাপের বীজটা থাকে তাই ঘোঁতন তার মামার মধ্যের সেই খারাপের বীজটাকে উপরে ফেলে দিতে চেয়েছে। ঘোঁতন পরী পিসির সাহায্যে গন্ডারিরার ভেতরের খারাপ মানুষটাকে পরাস্ত করে ভালো মানুষের দিকটাকেই আরও প্রকাশিত করার চেষ্টা করেছে। রেনবো জেলি একটা জিতে যাওয়ার গল্প, যেই জিতে যাওয়াটা মনের ভেতরের খারাপ মানুষটাকে হারিয়ে দিয়ে ভালো মানুষটাকে জিতিয়ে দেওয়া।
ছবি সৌজন্যে: ইনডিজেনিআস প্রোডাকশন
আমি নিজে খুব রান্না করতে ভালোবাসি আর আমি খেতেও খুব ভালোবাসি। ঠিক যেমন রান্না করার সময় মনের ভাবের একটা সম্পর্ক আছে, ধরুন যখন মন ভালো থাকে তখন রান্না করতে খুব ভালো লাগে বলে রান্নাটাও খুব ভালো হয় আবার কখন ও দুঃখে বা রেগে থাকলে রান্নার উপর তার প্রভাব পরে। তাই আমার মনে হল এর উল্টোটা হলে কেমন হয়। এই ধারণাটি আমার ছবির মূল ভাবনা ছিল। এই ছবিটা নিয়ে রিসার্চ করার সময় আমি আয়ুর্বেদ নিয়েও একটু নাড়াচাড়া করেছিলাম। তখন একটা মজার কথা খুঁজে পাই -'ডোন্ট মেক মেডিসিন ইওর ফুড; মেক ফুড ইওর মেডিসিন (Don’t make medicine your food make food your medicine)। খাবাদবারের মানুষের মনের উপরে একটা বিরাট প্রভাব আছে।
আমার এই গল্পের মমনটা আসলে লীলা মজুমদারের সাহিত্য পড়ে তৈরি হয়েছে।
গল্পটা ঘোঁতন একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে নিয়ে। ঘোঁতনের চরিত্রের জন্য আমি অনেক বাচ্চারই অডিশন নিয়েছিলাম সব্বাই খুবই ভালো কিন্তু আমি এদের মধ্যে এমন একটা হাসি খুজছিলাম যেটা আমি কারও মধ্যে পাইনি। যখন ঘোঁতনকে প্রথমবার আমার বাড়িতে দেখি আমি ওর হাসিটা দেখেই বুঝেছিলাম যে আমি আমার ঘোঁতনকে পেয়ে গেছি। কারণ আমার গল্পে ঘোঁতনের বর্ণনা করতে গিয়ে আমি লিখেছিলাম ঘোঁতনের হাসি সূর্যের সাতটা রং-এর মতো ঝলমল করে। তাই যখন মহাব্রতকে প্রথমবার দেখি তখন আমার এই বর্ণনার সঙ্গে এক্কেবারে খাপখেয়ে গিয়েছিল। মহাব্রত বসু আমার সিনেমার ঘোঁতন।
ছবি সৌজন্যে: ইনডিজেনিআস প্রোডাকশন
এই চরিত্রটা তৈরি করতে গিয়ে আমার নিজের জীবন থেকে অনেক ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। ঘোঁতনের ছেলেবেলার সঙ্গে আমার ছেলেবেলার অনেক মিল আছে। ঘোঁতনের স্বপ্ন দেখা, ঘোঁতনের ধাক্কা খাওয়া কিংবা ঘোঁতনের কল্পনা প্রবণতা অনেককিছুর সঙ্গে আমার শৈশবের অনেক মিল রয়েছে।
দুষ্টু মামার ভূমিকায় কৌশিক সেনকে নেওয়ার কারণ হল তাঁর অভিনয় ক্ষমতা। মামার নাম গন্ডারিয়া কারণ তাঁর লজ্জা বলে কোনও বস্তুই নেই। গন্ডারের চামড়া যেমন পুরু হয় এখানে মামার কোনও লজ্জা বা দুঃখ নেই তাই তাকে গন্ডারের সঙ্গে তুলনা করে ঘোঁতন মামাকে গেণ্ডারিয়া বলে ডাকে। আমার মনে হয়েছিল আমার গন্ডারিয়াকে পর্দায় অপূর্ব ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে কৌশিক সেন সত্যি তিনি সেটাই করেছেন তিনি নিজস্ব বাচনভঙ্গি ও বিশেষ উচ্চারণের মাধ্যমে চরিত্রটিকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছেন। এই রকম কৌশিক সেনকে আমরা এর আগে কখনও দেখিনি। ভিলেন অথচ আবার যার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম কমিক্যাল দিকও রয়েছে।
শ্রীলেখা মিত্রর সঙ্গে আমি আগেও কাজ করেছি এবং ওঁর কাজের উপরে আমার সম্পূর্ণ আস্থ্য রয়েছে। শ্রীলেখা মিত্র খুব চটপটে আর পরী পিসিও খুব চটপটে তাই শ্রীলেখা মিত্রকে আলাদা করে ভাবতে হয়নি অভিনয় করানোর সময়। পরী পিসি দার্জিলিং চা আর কুকি খেতে যেমন ভালোবাসে আবার অন্য দিকে সে ঘোঁতনের মুখে মা কালী বা মাইরি শুনলে চটে ওঠেন। তিনি পরী হয়েও পাশের বাড়ির পিসির মতো। তাঁর চরিত্রের অনেকগুলো রং আর দিক রয়েছে। একটা মজার চরিত্র।
ছবি সৌজন্য: ইন্ডিজেনাস প্রোডাকশন
সিনেমায় ছ'টা গান আছে।
সিনেমাটা কিন্তু মুভি অফ চাইল্ডহুড। বড়দের ভিতরেরও যে একটা শিশু মন রয়েছে সেটাকেই বাইরে বের করে আনার চেষ্টা করেছি মাত্র। রেনবো জেলি দেখতে গিয়ে যেমন বাচ্চারাও এই সিনেমারটার সঙ্গে একাত্ম হতে পারবে আবার একজন প্রাপ্তবয়স্কও সিনেমাটা দেখলে নিজের শৈশবে ফিরে ফিরে যাবেন। সিনেমাটি হ্যাবিট্যাট ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নির্বাচিত হয়েছে।