মহাব্রতর জেদটাই সিনেমার ঘোঁতনকে আরও জীবন্ত করে তুলতে পেরেছে
সে বুঝেছিল যে তাকে নিজের সঙ্গে অনবরত লড়াই করে সুস্থ্য হয়ে উঠতেই হবে
- Total Shares
সমবয়সী আর পাঁচটা বাচ্চার মতো জীবন নয় তার। এখন তার জীবনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ক্যামেরা, লাইট, অ্যাকশন, কাট, ছবির প্রচার ইত্যাদি। নিশ্চয়ই বুঝেছেন কোনও সেলিব্রিটির কথা বলছি। হ্যাঁ। আমি একজন সেলিব্রিটির কথাই বলছি। আমাদের অনেকেরই এখন বেশ পরিচিত নাম মহাব্রত বসু। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বাংলা ছায়াছবি 'রেনবো জেলি'-র হিরো সিনেমায় যার নাম ঘোঁতন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোঁতন ও তার পরী পিসি এখন সুপার হিট।
সেই মহাব্রতর এখন দিনের অনেকটা জুড়েই চলে ছবির প্রচার ও ছবিটির জন্য বিভিন্ন সাক্ষাৎকার। স্বপ্নের মতো জীবন যেন।
ছবি সৌজন্যে: ইন্ডিজেনাস প্রোডাকশন
লেখার শুরুতেই যেমন বলেছি - তার বয়সী আর পাঁচটা বাচ্চার মতো জীবন নয় মহাব্রতর। এই কথাটা যেমন ঠিক তেমন এই কথাটাও খুব সত্যি যে তার শৈশবটাও আর পাঁচটা বাচ্চার মতো ছিল না। জন্মের পর মহাব্রত সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয় যার ফলে ওর স্নায়ুর সমস্যা দেখা দেয়।
মহাব্রত স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারতো না বা ঠিকঠাক হাঁটাচলা করতে পারতো না। ওর ব্যালেন্সিং-এরও সমস্যা ছিল। নিজের কাজ করার জন্য ওকে মা কিংবা বাবার সাহায্য নিতে হতো। কিন্তু ওই কচি বয়সেই মহাব্রত বুঝতে পেরেছিল যে ওকে নিজের সঙ্গে অনবরত লড়াই করে সুস্থ্য হয়ে উঠতেই হবে। সেই জেদের ফলেই মহাব্রতর অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। চার-পাঁচ বছর থেকেই ও নিজের চেষ্টায় অনেক সমস্যা কাঁটিয়ে ওঠে।
ইতিমধ্যে পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল তাঁর ছবি 'রেনবো জেলি'র জন্য একটি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন বাচ্চার খোঁজ করছিলেন।
ছবি সৌজন্যে: ইন্ডিজেনাস প্রোডাকশন
মহাব্রতর সঙ্গে কথা বলার আগে পাঁচ-ছ'জনের অডিশন নিয়েছিলেন পরিচালক। শেষে তিনি মহাব্রতর মধ্যেই তাঁর ছবির হিরো ঘোঁতনকে খুঁজে পেলেন। পরিচালক যেমন জানিয়েছিলেন 'ওর হাসিটা আমার খুব ঝলঝলে লেগেছিল।'
তবে মহাব্রত সিনেমায় অভিনয় করবে এমনটা কেউ হয়ত কখনও ভাবেনি।
মহাব্রতর যখন পরিচালকের কাছে আসে তখন ওর কথা বলার সমস্যাটা বেশ ভালো মাত্রাতেই ছিল।
একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর মুখের ভাব বা আবেগগুলো ঠিকঠাক ভাবে ব্যক্ত করতে হয় কিন্তু মহাব্রতর ক্ষেত্রে এটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। ওর অভিব্যক্তিগুলো ছিল খুবই নিশ্চল। সৌকর্য ঘোষাল বলেন, "মহাব্রতর রিফ্লেক্সটাগুলো খুব শ্লথ ছিল। ওর অভিব্যক্তির অভাব সিনেমার ক্ষেত্রে একটা বড় অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারত।"
তাই ওর মুখের বা শরীরের অভিব্যক্তিগুলো পর্দায় ফুটিয়ে তোলাটাই ছিল পরিচালকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ছবি সৌজন্যে: ইন্ডিজেনাস প্রোডাকশন
শুরু হল প্রস্তুতি পর্ব। মহাব্রতর সঙ্গে তিন মাস লাগাতার ওয়ার্কশপ চলে। ওয়ার্কশপের সময় পরিচালক বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন স্পুন-মার্বেল মুখে দিয়ে কথা বলা বা স্মাইলি মেথড অবলম্বন করে ওর মুখের বিভন্ন অভিবক্তি ফুটিয়ে তোলার অভ্যাস করাতে শুরু করলেন।
এভাবেই ধীরে ধীরে মহাব্রত অভিনয়, সংলাপ ও শুটিং-এর অন্যান্য দিকগুলো আয়ত্ত্বে করে ফেললো। সৌকর্য ঘোষাল বলেন, "শুটিং-এর সময় ক্যামেরার পেছন থেকে আমি বিভিন্ন স্মাইলি বলতাম আর ও শুনে সেভাবে নিজের অভিব্যক্তিগুলো ফুটিয়ে তুলতো।"
সৌকর্য ঘোষাল বলেন, "শুটিং করতে গিয়ে বহুবার আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। হিন্দি সিনেমা 'দঙ্গল'-এর আমির খানের মতো আমি মাথা ঠুকতাম আর ভাবতাম আমি বোধহয় পারবো না। কিন্তু ওই সময় আমার স্ত্রী আমাকে বলেন যে তুমি যখন সিনেমার জন্য মহাব্রতকে কাস্ট করেছ তখন তুমি হাল ছেড়ো না। দেখবে তুমি ঠিক পারবে।"
পরিচালক বলেন, "মহাব্রতও আমার সঙ্গে সহযোগিতা না করলে সিনেমাটা আমার একার চেষ্টায় করতে পারতাম না। ওর মধ্যে ভীষণ জেদ ও অধ্যায়বসায় কাজ করেছিল তখন।"
ছবি সৌজন্যে: ইন্ডিজেনাস প্রোডাকশন
ওয়ার্কশপের সময় লাগাতার তিন মাস হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেছিলেন মহাব্রত ও সিনেমার পরিচালক। এর ফলে শুটিং ফ্লোরে গিয়ে মহাব্রতর গোটা ব্যাপারটা একদম জলভাত হয়ে গিয়েছিল।
পরিচালক বলেন, "ছবি শুটিং শেষ হওয়ার প্রায় ছ'মাস পর ডাবিংয়ের কাজ শুরু হয়। ততদিনে মহাব্রত অনভ্যাসের ফলে অনেককিছুই ভুলে গিয়েছিল। আমি আর আমার সাউন্ড ডিজাইনের আবার একটা পদ্ধতি ব্যবহার করি। আমার কানে হেডফোনটা থাকত যাতে সংলাপ শোনা যেত আর সেটা শুনে আমি অভিনয় করতাম আর মহাব্রতকে বলতাম এবার তুই চোখ বুজে সংলাপগুলো বল। তারপর সেগুলোকে জুড়ে সিনেমায় ওর মুখের সঙ্গে মিলিয়ে সংলাপ বসানো হয়েছিল।"
শুটিং করার সময় মহাব্রত নিজেকে ভুলে গিয়ে ঘোঁতন হয়ে উঠতে পেরেছিল। ও যখন অভিনয় করতো তখন ওর ব্যক্তি সত্তার ছাপ কোথায় পড়তে দেয়নি, তাই বোধহয় ও খুব সহজেই ঘোঁতন হয়ে উঠতে পেরেছিল। "আমার মনে হয় ও স্পেশাল চাইল্ড বলেই হয়ত নিজেকে ভুলে গিয়ে ঘোঁতনের মতো করে ভাবতে পেরেছে। আমি-আপনি সেটা হয়ত পারতাম না।"