জিন্না বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন দেশপ্রেমের একটা অন্য সংজ্ঞা দিল 'রাজি'
দ্বিতীয় দিনেই ১১ কোটি ব্যবসা ছাড়ালো সিনেমাটি
- Total Shares
রাজনীতি ও ধর্মের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে যখন বড় মাপের এক কবি আর এক বড় একজন কবির লেখার থেকে উদ্ধৃত করে নিজের লেখায় ব্যবহার করেন তখন সেটা সত্যিই একটা খুব বড় ব্যাপার। গুলজার নিজের মেয়ে মেঘনা গুলজারের সাম্প্রতিক ছবি 'রাজি'-র জন্য 'অ্যায় ওয়াতন' গানটিতে কবি আলামা ইকবালের লেখা নজম থেকে কিছু অংশ নিয়েছেন। আলামা ইকবাল এই নজমটি পাকিস্তানের স্কুল পড়ুয়াদের জন্য লিখেছিলেন:
লব পে আতি হয়ে দুয়া বন কে তমন্না মেরি জিন্দেগি শাম্মা কি সুরত হো খুদায়া
(বাসনার রূপে একটা প্রার্থনা আসে ঠোঁটে একটা মোমবাতি নিজে জ্বলে যায় অন্যদের আলো দেবে বলে)
একটি গান যাতে এই শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেটি গেয়ে সিনেমায় একজন সদ্য গুপ্তচর কাজে হাতে খড়ি হওয়া একটি মেয়ে -সহমত খান গানটি গেয়ে একটি পাকিস্তানি পরিবারের বিশ্বাস অর্জন করেন। তাই এই গানটি ছবির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে যদি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় মুহাম্মদ আলি জিন্নার একটা ছবি রাখা হয় তাহলে দেশ হয়ত ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার হতে পারে ঠিক তখনই এই ধরণের ছবি বা গান ক্ষতের উপর প্রলেপের কাজ করবে। যদিও গুলজার ইকবালের নজম থেকে এই পংতিগুলোর ব্যবহার করার পেছনে একটা পরিহাস করেছেন। কারণ যেমন জিনহাকে দ্বিজাতি তথ্য গ্রহণে ইকবাল বাধ্য করেন ঠিক তেমন ইকবালই "সারে জাহা সে আচ্ছা হিন্দুস্থান হামারা" গানটি লিখেছেন।
ছবিতে আলিয়া ভট অত্যন্ত দক্ষ ভাবে শেহমতের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন
কিন্তু মেঘনা গুলজারের ছবিটি ভালো পাকিস্তানি খারাপ পাকিস্তানি বা ভালো মুসলমান খারাপ মুসলমানের বিভাজনের উর্ধে গিয়ে ছবিটি বানিয়েছেন। এই কাল্পনিক ছবিতে একজন অল্প বয়সী কাশ্মীরি মহিলা যে আসলে একজন ভারতীয় গুপ্তচর বিয়ে করে একটি পাকিস্তানি উচ্চবৃত্ত ফৌজি পরিবারে আসে। ওই পরিবারে এসে মেয়েটি 'জঙ্গ' বা যুদ্ধ ও 'মুল্ক' মানে স্বদেশের আসল মানে বুঝতে পারে। ছবিতে সহমতের চরিত্রে আলিয়া ভট যেমন ভারতীয় গুপ্তচর হয় নিজের দেশের প্রতি অবিচল ও দ্বায়িত পালন করেছেন ঠিক তেমন ভাবেই শেহমতের স্বামী ইকবাল একজন পাকিস্তানি ফৌজি তাঁর স্ত্রীয়ের পাশে থেকে স্বামীর কর্তব্য পালন করেছেন। ছবিতে ইকবাল তাঁর বাবাকে বলেন শেহমত যা করেছে সেটা তাঁর মুল্কের জন্য করেছে আর আমরাও যা করি সেটা আমাদের মুল্কের জন্য।
তবে জং বা যুদ্ধের সময় মানুষের সম্পর্ক বা মানুষের জীবন মাঝখানে আসে না। হরিন্দর সিক্কার লেখা গল্প অবলম্বন করে একজন কাশ্মীরি গুপ্তচরের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবিটি। বইটিতে রয়েছে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় পিএনএস গাজী যখন আইএনএস ভিক্রান্তের উপর একটি সুপরিকল্পিত হামলা চালিয়েছিল তখন ভারতীয় নৌসেনা কী ধরণের কৌশল ব্যবহার করে চমকে দিয়েছিল।
যদিও একটি সাম্প্রতিক তেলুগু ছবি 'দ্য গাজি অ্যাট্যাক'-এর বিষয়বস্তু কিছুটা একই রকম কিন্তু 'রাজি'-ই তে মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন ও মানুষের হিংসা বেশি দেখানো হয়েছে। দিল্লিতে একটি কলেজের ছাত্রী শেহমত, যাঁর ধমনীতে বইছে স্বাধীনতা সংগ্রামীর রক্ত তাই সে একজন ভারতীয় গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর আধিকারিক যখন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন সে এই অলীক কারণে নিজের জীবন বিপন্ন করছে তখন উত্তরে মেয়েটি বলেছিল "ম্যয় হয় তো মুল্ক হু"। তবে শেহমতের জন্য কিন্তু কারণটা খুব বাস্তব কারণ তাঁর বাবাও ছিলেন ভারতের গুপ্তচর ও তাঁর পিতামহ ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তবে এখানে যে প্রশ্নটা মনে আসে সেটা হল এই মেয়েটি হল একজন মুসলমান, একজন কাশ্মীরি মুসলমান।
এই মেয়েটি হল একজন মুসলমান, একজন কাশ্মীরি মুসলমান
এখানেই পরিচালক হিসেবে মেঘনা গুলজারের জয় হয়েছে। কারণ তিনি একজন মানুষের সবকটা আবেগ চোখে আঙ্গুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলেও এ যুগে যখন নানা সময় দেশে ধর্মের নামে বা রাজনীতির নামে যে বিভাজন চলে সেটা উঠে এসেছে। গোড়ার দিকে শেহমত ও তাঁর স্বামীর (স্বামীর ভূমিকায় ভিকি কৌশল এবারেও অনবদ্য) মধ্যে সম্পর্কটা মোটামুটি হলেও পরের দিকে কিন্তু তাঁদের সম্পর্কটা গভীরতা পেয়েছে। এছাড়াও সিনেমায় দেখান হয় কীভাবে ধীরে ধীরে শেহমত তাঁর ননদ ও শশুরমশায়ের সঙ্গে বেশ মিলেমিশে যায় আবার ঠিক একই ভাবে দেখানো হয়েছে যে নিজের আসল পরিচয় গোপন রাখতে গিয়ে শেহমত কী ধরণের মারাত্মক সব পদ্ধতি অবলম্বন করে।
ছবিতে আলিয়া ভট অত্যন্ত দক্ষ ভাবে শেহমতের ভূমিকায় অভিনয় করেছে যাঁর কাছে নিজের দেশের থেকে বেশি আর কোনও কিছু নয় পাশাপাশি তাঁর অভিনয় উঠে এসেছে চরিতের দুর্বল দিকটা আবার ছলনার দিকটাও।
কখনও বড়ে গুলমালির গান শুনে আবার কোনও বা কাশ্মীরের চা যাকে 'খাওয়া' বলা হয় সেটা বানিয় বিয়ের পর একটি নতুন বাড়ি, একটি নতুন পরিবার ও নতুন দেশে এসে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে ওখানকার লোকেরা যতবার নিজেদের কথায় ভারতের নাম উল্লেখ করে ততবার তাঁর মুখেচোখে ভেসে ওঠে একটা অস্বস্তিভাব। যখন তাঁর শশুরমশাই নিজেদের দেশকে ভালো দেখতে গিয়ে বলেন, "উও আসমান দেখ রহে হংগে অউর হাম উনকে প্যয়েডো তলে জমিন খিঁচ লেঙ্গে।" তাঁর এই কথায় শেহমতের মুখে অস্বস্তি দেখা গেলেও সে কিন্তু সেই অনুভূতিটা খুব ভালোভাবে ঢেকে ফেলতে পেরেছিল।
স্বামীর ভূমিকায় ভিকি কৌশল এবারেও অনবদ্য
পাকিস্তানে ঠিক কীভাবে শেহমত তাঁর গুপ্তচরের কাজ চালিয় যায়, কীভাবে সে তাঁর নতুন পরিবারে মানিয়ে নেয়, কীভাবে প্রত্যেকবার নিজের বুদ্ধি দিয়ে শত্রুদের হারিয়ে দিয়ে ভারতে তথ্য পাঁচার করেছেন, আর প্রতিষ্ঠান কীভাবে এই সম্ভাবনাকে একরকম ধূলিসাৎ করে দিয়ে কোনও রকম প্রতিক্রিয়ায় দেখায় না। এই সব কিছু মিলিয়ে সিনেমাটি দর্শকের যেমন বিনোদন দেবে তেমনই তাঁদের মনে ছাপ ফেলে যাবে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন যেকোনও ঝগড়ায় মানুষের দেশের প্রতি ভাবেলাসের বিচার হয় তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের নিরিখে।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন