উত্তর-ঔপনিবেশিকতা নিয়ে অন্য ধারার লেখক নাইপলের এত ভক্ত কেন
তাঁর লেখা নিয়ে বিতর্কের উত্তর কি ছিল? কোন পরিস্থিতিতে নোবেল পান?
- Total Shares
তাঁর কথায় যেমন লেখাতেও আগল রাখেননি।
বিদ্যাধর সূরজপ্রসাদ নাইপল যে একালের ইংরেজি সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক তা নিয়ে সাহিত্য মহলে কোনও প্রশ্ন নেই। সাহিত্য যদি কেবলমাত্র নিখুত আখ্যান হয় তবে গল্প বলিয়ে হিসেবে তার অনবদ্য দক্ষতা নিয়েও কারও দ্বিমত থাকতে পারে না। তবে যেটা ঘটনা, লেখনির জন্য জীবনভর নাইপল যতটা প্রশংসিত হয়েছেন, ঠিক ততটাই নিন্দিত হয়েছেন আফ্রিকা-বিদ্বেষ, ইসলাম বিরোধী মন্তব্য, ঔপনিবেশিক মানসিকতার শিকার বলে ভারতীয়দের তিরস্কার, তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের হেয় করা, বাঙালিকে অহংসর্বস্ব বলে ঠাট্টা করা, মহিলাদের অবজ্ঞা করা, সমসাময়িক লেখকদের সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য।
বিদ্যাধর সূরজপ্রসাদ নাইপল
এ সব নিয়ে তাঁর অবশ্য কোনও দিনই বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা ছিল না, বরং তিনি বলতেন, ‘কোনও লেখক যদি বিতর্কই তৈরি করতে না পারেন তাহলে বুঝতে হবে সেই লেখকের মৃত্যু হয়েছে’। বর্ণবিদ্বেষী, লিঙ্গবৈষম্যকারী, ইসলামবিরোধী বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কি কম উঠেছে! জীবনীকার প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চকে তিনি খোলাখুলি জানিয়েছিলেন, বিবাহিত জীবনে যৌনকর্মীদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত মেলামেশা ছিল।
জানিয়েছিলেন তাঁর রক্ষিতার উপর অমানুষিক অত্যাচার করার কথা, বলেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছিলেন যে বলা যায়, 'আমি তাঁকে হত্যা করেছি'। তবে একথা স্বীকার করলেও এনিয়ে কখনও তাঁকে আফশোষ করতে দেখা যায়নি। নাইপলের উপন্যাস বললেই সাধারণ পাঠক মন ধরেই নেয়, রুক্ষ নির্দয় গদ্যে মনুষের জীবনের গ্লানি আর দুর্দশাকে বর্ণনা করার অসাধারণ ক্ষমতা। পাশাপাশি নাইপলের ভ্রমণভিত্তিক যে বৃত্তান্ত, সেখানেও তিনি তৃতীয় বিশ্বের নানা ধরণের দারিদ্র্যকে আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপনের কোনও চেষ্টাই করেননি। বরং সেগুলি হয়ে উঠেছে যেন ভয়ভীতি জাগানিয়া সত্য বর্ণনার উদাহরণ।
তথাপি সমালোচকদের মতে, নাইপলের লেখায় ছড়িয়ে আছে নানান ভ্রান্তি আর বিদ্বেষ, কখনও কখনও সেখানে মিশেছে গোঁড়ামি, অহেতুক রাগ-বিরক্তি-ঘৃণায় তিনি ব্যয় করেছেন বহু কথা। তবে অতি তীব্র এবং আক্রমণাত্মক হলেও তারা নাইপলের সহিত্যকর্মের অসাধারণত্ব স্বীকার করে নিয়েই তাঁর লেখার সমালোচনা করেছেন। সমালোচদের ভাষায় নাইপল স্টিরিওটাইপে আটকে পড়া এক বৃদ্ধ যিনি নিজের ফেলে আসা জায়গাকে গালমন্দ করেছেন সারাক্ষণ – এ কথা পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। অবশ্য সমালোচনাকে পাত্তা দেওয়ার মানুষ নাইপল ছিলেন না। অন্যের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টির ক্ষমতা যে তার মজ্জাগত, তাও তিনি জানতেন। বলতেন, এই গুণটি না থাকলে একজন মানুষ আসলে মৃত।
নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে নাইপল
‘হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ একজন অসহায় দুর্বল মানুষের ট্র্যাজিক ছবি। যাঁর নেই কোনও নিজস্ব ঠাঁই, নিজ্বব সত্ত্বা, অস্তিত্ব, পরিচয় – যাবতীয় কিছু কার্যত বিচ্ছিন্ন, এক অকিঞ্চিৎকর জীবন। এটাই কি তৃতীয় বিশ্বের এক বৃহদাংশের ট্র্যাজেডি নয়? উপনিবেশিক দেশগুলির ঔপনিবেশিক পরিণতি, নিজেদের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, দর্শনে, অভিব্যক্তিতে, ভাষায়, জ্ঞানচর্চায়, শিল্পে, নৈতিকতায় পরনির্ভরতা, অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া যে অকিঞ্চিৎকর প্রান্তিক অস্তিত্বের কথা তা কে না জানে! কিন্তু নাইপল এই আখ্যান কথনে এক নতুন গদ্যরীতির সূচনা করেছিলেন। যা তাঁকে সমসাময়িক সব লেখকের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস'-ই প্রথম তাঁকে লেখক হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি এই উপন্যাস রচনা করেছিলেন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মোহন বিশ্বাস চরিত্রটিকে তাঁর পিতার অনুকরণেই তৈরি করেছিলেন নাইপল। মোহন বিশ্বাস নিজের একটা বাড়ি চেয়েছিল। সে মনে করত সম্পত্তিই তাঁকে নিরাপত্তা দেবে, দেবে ব্যক্তি স্বাধীনতা। বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অনন্ত বিবাদের রসদ নইপাল পেয়েছিলেন তাঁর নিজের বাড়িতেই।
এই উপনিবেশিকতা-উত্তর বাস্তবধর্মী উপন্যাসটিকে অনেক সমালোচকই বলেছেন ডিকেন্সিয়ান, কিন্তু নিজগুণে স্বতন্ত্র। আসলে এই লেখার উৎসভূমি এক অনালোচিত ইতিহাসে। যে ইতিহাস অসাফল্যের, হারিয়ে যাওয়ার, পরাভূত হওয়ার। সে ইতিহাস তো অন্ধকারেই রয়ে যায়। ভারত থেকে উনবিংশ শতকজুড়ে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ত্রিনিদাদে আখের খেতে চাষ করতে। চুক্তির শর্ত ছিল যে, চুক্তির মেয়াদ ফুরোলে এদের দেশে ফেরার জাহাজের টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হবে, আর থোক কিছু টাকা।
কিন্তু ইতিমধ্যে মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে উঠে গেল এই চুক্তিবদ্ধ দাসত্ব প্রথা। ত্রিনিদাদের ওই শ্রমিকগুলোর তখন কী হবে? বিদ্যাধরের দাদুও গিয়েছিলেন ওদের সঙ্গে। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ বলে পুরোহিত হিসেবে। লোকগুলো তখন রাস্তা-ঘাটে শুয়ে থাকত, চুক্তি আর বলবৎ নেই, কাজ নেই, দেশে ফেরার টিকিটও আর পাওয়া যায়নি। এঁদের সম্বন্ধে কেউ কিচ্ছু জানতো না, এরা কারা, কোত্থেকে এল, কোথায়ই বা যাবে!
এভাবেই পৃথিবীর বহু কোণের ইতিহাস আলোকিত বৃত্তের বাইরে প্রায়ন্ধকারে ছায়া হয়েই পড়েছিল। উপনিবেশিকোত্তর সাহিত্যের একটা মুখ্য অংশই তো সেই অনাদরে পরে থাকা ইতিহাস-কথা। ভি এস নাইপল ওই সাহিত্যেরই ইতিহাস রচয়িতা। ইতিহাসের এই পর্যায়টির যিনি নাম দিলেন, ‘নতুন পৃথিবী’, আর আমরা বললাম পোস্ট-কলোনিয়াল। ‘এ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি উপন্যাসের সূচনাবিন্দু। হতে পারে তার পটভূমি ত্রিনিদাদ, কিন্তু মোহন বিশ্বাস থেকে শ্যামা, তুলসী পরিবার সবাই ভারতীয় অভিবাসী পরিবারের সন্তান। ছোট্ট মোহনের ছ’টা আঙুল, তার জন্মের পর কোষ্ঠী তৈরি, গণৎকারের তাকে অপয়া বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা—এ সবই ভীষণ ভাবে ভারতীয়।
‘আ হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাস’, ‘ইন আ ফ্রি স্টেট’, ‘আ বেন্ড ইন দি রিভার’ তাঁর বিখ্যাত রচনা। সবগুলির মূল বিষয় হল ভাগ্য সন্ধানী ও অস্তিত্বের সংকটে পড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের মনস্তাত্তিক সংগ্রাম। সুদীর্ঘ ৮৫ বছরের জীবনে নাইপলের সাহিত্যে মানুষের জীবন সংগ্রাম, ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার বহুমাত্রিক প্রতিফলন থাকাটাই স্বাভাবিক। সেখানে ত্রিনিদাদ কিম্বা ভারতের সমাজবাস্তবতার সবথেকে কদাকার দিক বর্ণবাদের মানবিক সংকট যেমন উঠে এসেছে, পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শক্তি এবং ইসলামের প্রভাব সম্পর্কেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। তবে ভারতীয় সমাজে ইসলামের আগমন ও প্রভাব সম্পকে নাইপল যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন তাকে পশ্চিমের ইতিহাস গবেষক ও সমাজতাত্তিকরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা নাইপলের দৃষ্টিভঙ্গির ভুল ধারণাকে বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন ভারতের স্থানীয় রাজারা কিভাবে ইসলামী সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি, সমরকৌশল স্বেচ্ছায় গ্রহণ ও আয়ত্ত করেছিলেন।
ইতিহাস গবেষকরা দেখিয়েছেন, দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্থানীয় রাজারা শুধু যে ইসলামের অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন তাই নয়, সুলতানদের পক্ষ নিয়ে অন্য স্থানীয় রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন। পরিবর্তনশীল ভারতীয় সমাজব্যবস্থা যখন পশ্চিমী অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। তখন ভারতে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানের ইতিহাস সম্পর্কে ভিএস নাইপলের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ প্রবল। লক্ষ্যনীয় নাইপলের লেখায় ওই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনের কারণেই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।
তথাকথিত নয়া বিশ্বব্যবস্থার আলোকে মধ্যপ্রাচ্যসহ তৃতীয় বিশ্বকে আমূল বদলে ফেলার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মিশন নিয়েই শুরু হয়েছিল পশ্চিমীদের ‘ওয়ার অন টেরর’। আমেরিকায় ১১ সেপ্টেম্বরের বিমান হামলার তিন মাসের মাথায় ২০০১ -এর ডিসেম্বরে নাইপলকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সেই সময়ে নাইপলের ইসলাম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়া নতুন করে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। সাহিত্য সমালোচকরা তার মানসিক গঠনের নেপথ্য অভিজ্ঞতাগুলোকেও ফের বিচার বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। এমনটাও বলা হয়, ভারত থেকে একটি দরিদ্র হিন্দু পরিবারের ভৃত্য হিসেবে ত্রিনিদাদে যাওয়া এবং বেড়ে ওঠার মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতার আশ্রয় রয়েছে। নিজে অশ্বেতাঙ্গ হয়েও লন্ডনে পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গদের মতো হয়েই গড়ে উঠেছিলেন। সেখানে ভারত বা পশ্চিমী দুনিয়ায় ইসলামি সংস্কৃতি ও জীবনবোধের অস্তিত্বের বিপক্ষে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখা ছিল সত্যের অপলাপ। নিজের হিন্দু ভারতীয় পরিচয়কে তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলতে চেয়েছেন এবং পশ্চিমী সংস্কৃতির স্তাবকতা করে স্বীকৃতি ও সমর্থন লাভের চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছেন।
আদতে নাইপলের নিজস্ব কোন রাষ্ট্র বা সমাজ ছিল না, যে সমাজকে নিজের মতো সাজানোর স্বপ্ন দেখতে বা দেখাতে পারতেন। ভারত বা ত্রিনিদাদ নিয়ে তার তেমন কোন ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
‘The world is what it is; men who are nothing, who allow themselves to become nothing, have no place in it’. ‘এ বেন্ড ইন দ্য রিভার’ উপন্যাসের প্রথম লাইন। সেখানে পূর্ব আফ্রিকার এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত, ইন্দার বলে, ইহুদিদের অটোমান সাম্রাজ্যে অথবা তুরস্কে বা মিশরে কোনও সমৃদ্ধি ঘটেনি এবং তারাও শতাব্দীর পর শতাব্দী ঠিক এটাই করে এসেছে। যারা হেরে যাওয়াটাকেই নিয়তি হিসেবে আঁকড়ে থেকে ভুলে বসে য়াছে যে তারাও ঠিক অন্যদের মতোই মানুষ। হারতে হারতে সেও ক্লান্ত। কিন্তু সে ওই ভিড়ে মিশে যাবে না... এবার থেকে সে জিততে চায়। অন্যদিকে আরেক ভারতীয় সেলিম, সে কিন্তু সাফ বোঝে, অন্যদের মতোই ইয়োরোপিয়ানদের দরকার ছিল সোনা আর ক্রীতদাস। তাদের সভ্যতার এই দু’টো দিকই তাদের কাজে প্রকাশ পেয়েছে। তারা ক্রীতদাস আর মূর্তি, দু’টোই হাসিল করেছে। এটা তারা পেরেছে কারণ তাদের আত্মসমীক্ষায় গাফিলতি ছিল না। পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে চলতে তাদের প্রস্তুতি ছিল বেশি... তাদের প্রাথমিক দায় ছিল নিজেদের ইয়োরোপীয় সভ্যতার কাছে। এখানেই অন্যদের তুলনায় তাদের দুর্বলতা মারাত্মক। আরব দেশগুলোর বাইরে যে ইসলামিক সভ্যতা, তার চারটি দেশ ঘুরে এসে লিখেছিলেন, প্রথমে, ‘অ্যামং দ্য বিলিভারস’ তার কিছু পরে আরেকবার ঘুরে এসে লিখলেন ‘বেয়ন্ড বিলিফ: ইসলামিক এক্সকারশন অ্যামং দ্য কনভার্টেড পিপলস’।
বিলেতে যাওয়ার সময় জাহাজে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ডায়েরি, ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিখ্যাত সব পর্যটক-সাহিত্যিকদের আদলে লিপিবদ্ধ করবেন যাবতীয় অভিজ্ঞতা। কিন্তু তাঁরা সবাই ছিলেন সাহেব, উপনিবেশ তৈরি করা জাতির লোক, আর ওই কিশোর সেই উপনিবেশের কৃষ্ণাঙ্গ! বহু দশক বাদে সেই অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে গিয়ে, ‘দ্য এনিগমা অব অ্যারাইভাল’-এ লিখলেন যে লেখক হিসেবে তিনি তখন তার অভিজ্ঞতাগুলোকে তার নিজেরই কাছ থেকে আড়াল করেছিলেন। নিজেকে আড়াল করেছিলেন নিজের অভিজ্ঞতার থেকে... একদিকে পর্যটক লেখকের গ্ল্যামার, আরেকদিকে উপনিবেশের লোকেদের একজন হওয়া সত্ত্বেও...বোঝাই যায়, তৃতীয় বিশ্ব থেকে আসা ইংরেজি সাহিত্যের এই লেখকটির পক্ষে লেখক হিসেবে নিজের সঠিক পথটি খুঁজে নেয়া খুব সহজ হয়নি। কিন্তু তাঁকে লিখতে হয়েছে।
১৯৬২-তে নিজের উৎস-সভ্যতা ভারত ঘুরে লিখলেন ‘ইন্ডিয়া : অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস’। পরে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি জরুরি অবস্থার সময়ে আবারও ভারতে এসে, সব দেখে-টেখে লিখলেন, ‘ইন্ডিয়া: দ্য উন্ডেড সিভিলাইজেশন’। ক্ষমাহীন ভাবে ভর্ৎসনা করলেন, দেখালেন কী ভাবে দেশটার ভাবমূর্তি, পরিচয়, দেশেরই লোকের কাছে আটকে রয়েছে সেই সুদূর অতীতের কিছু মিথ আর ধারণার মধ্যে, সময়কে স্বীকৃতি দিয়ে, ইতিহাসকে স্বীকৃতি দিয়ে, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে মোটেই বিবর্তিত হয়নি। নিজের শেকড়ই পড়ে রয়েছে গভীর অন্ধকারে, যে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হিসেবে পরিচয়, সেই তৃতীয় বিশ্বের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে অন্ধকার। সেই আবছা, অস্পষ্ট, আলোবাতাসহীন মাটিতেই জন্ম, জীবনের শুরু।
তাহলে নাইপলকে আমরা কী ভাবে নেব? একজন বদমেজাজি, দুর্মুখ লেখক, যিনি পলিটিক্যাল কোনও কারেক্টনেসের ধার ধারেন না, ভারত নিয়ে যার মত ‘অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস, যেখানে লোকে সর্বত্র মলত্যাগ করে। রেললাইনের ধারে, মাঠের ধারে, রাস্তার ধারে, নদীর ধারে, সমুদ্রতীরে কোত্থাও হাগতে বাকি রাখে না’।
মেয়েরা কপালে টিপ পরে মাথায় কিচ্ছু নেই বলে... আফ্রিকা থেকে ইসলাম যা মনে এসেছে তাই বলেছেন। আবার ইরাক, ইরান, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ঘুরে বেড়িয়ে মুসলমান জনজীবন নিয়ে দু’পর্বের বই লিখেছেন। ঢাকা লিটারেচার সামিটে তাঁকে ঘিরে উৎসাহের অন্ত ছিল না বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের, জয়পুর লিটারেচার মিটে তাঁর জন্য হাজির ছিল ছ’হাজার ভক্ত।
The end of a long tale: Paul Theroux helps push VS Naipaul's wheelchair @ZEEJaipurLitFes pic.twitter.com/Rj9cOtLoej
— William Dalrymple (@DalrympleWill) January 24, 2015
কারণ নাইপল মানে কতগুলি বিতর্কিত মন্তব্যের সম্ভার নয়, অন্যকে আক্রমণ নয়, নাইপল এ কালের ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ, তাঁর কলমেই উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যভাষা নতুন মাত্রা পেয়েছে।