নেহরুর জন্য জাদুঘর বনাম প্রধানমন্ত্রীদের জন্য জাদুঘর
নেহরুর সঙ্গে অন্য প্রধানমন্ত্রীদের কেন একাসনে বসানো হচ্ছে
- Total Shares
দিল্লির নেহরু মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিকে প্রধানমন্ত্রীদের জাদুঘরে পরিণত করা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। যাঁরা দিল্লিতে গিয়ে কন্ট্যাক্ট ট্যুরে ঘোরেন তাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতিতে একটি জাদুঘর দেখে থাকেন, যেখানে রাজীব গান্ধীর ব্যবহৃত জিনিস ও মৃত্যুর সময় যে পোশাক পরেছিলেন সেটিও রাখা আছে। তিনমূর্তি ভবনও তাঁরা দেখে থাকেন। মানে এবই তিন প্রধানমন্ত্রী ছাড়া যাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন তাঁদের সম্বন্ধে অন্তত দিল্লি বেড়িয়ে কিছু জানার উপায় নেই।
এখন বিজেপি জমানা, স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপিও চাইবে এ বার আলো পড়ুক অটলবিহারী বাজপেয়ীর জীবনের উপরে, তাঁকেও জানুক সকলে। একই সঙ্গে লালবাহাদুর শাস্ত্রী, মোরারজি দেশাই, নরসিমহা রাওদের সেখানে জায়গা দিতেও বিজেপির আপত্তি থাকবে না। কারণ কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীদের জায়গা দিলে সেখানে কংগ্রেসের কিছু বলার থাকবে না, আবার প্রধানমন্ত্রী মানেই গান্ধী-নেহরু পরিবার, সেই মৌরুসিপাট্টাও ঘোচানো যাবে।
আর পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর পার্থক্য আছে, কারণ তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীও বটে। তবে সেই একই কথা আরও অনেকের ক্ষেত্রেই খাটে, বাজপেয়ীর ক্ষেত্রেও।
বিতর্ক সরিয়ে রেখে আপাতত নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরির নথি ডিজিটাইজেশনের কাজ সুরু হয়েছে। শুভ উদ্যোগ। তবে এই কাজের কতটা প্রয়োজন এবং কেন সে জন্য টেন্ডার, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ইতিমধ্যেই গুগল কালচারাল ইনস্টিটিউটের ভার্চুয়াল মিউজিয়ামে রয়েছে নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি।
ইতিমধ্যেই গুগল কালচারাল ইনস্টিটিউটে নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি (স্ত্রিন শট)
কিন্তু বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা কি এখানে দেওয়া সম্ভব? গুগল কালচারাল ইনস্টিটিউটে সম্ভব না হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য প্রকল্পে তা করা সম্ভব। আজকাল ই-বুক হরদম তৈরি হচ্ছে, তা নিখরচায় ডাউনলোডও করা যাচ্ছে।
গুগল কালচারাল ইনস্টিটিউটে জাদুঘর
গুগল কালচারাল ইনস্টিটিউট বহুদিন হল কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের সঙ্গে একযোগে কাজ শুরু করেছে। তারা ভারত-সহ বিভিন্ন বিভিন্ন জাদুঘরের সম্পদ ভার্চুয়াল মিউজিয়ামে তুলে ধরছে। মিউজিয়াম এখন স্মার্টফোনে। তাই এ জন্য বিশাল কর্মযজ্ঞের খুব একটা দরকার আছে বলে মনে হয় না।
দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামও এখন ভার্চুয়াল (স্ক্রিন শট)
তা ছাড়া থ্রিডি ভার্চুয়াল এই জাদুঘর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারে অনেকটাই।
ভারতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক জাদুঘর
এ দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক জাদুঘর কত যে আছে তা গুণে শেষ করা যায় না। কাশ্মীরের রাজপরিবারের এমন এক জাদুঘরের কথা শুনেছিলাম জম্মু-কাশ্মীরের শেষ রাজা হরি সিংয়ের পুত্র করণ সিংয়ের কাছে, মিনিট-খানেকের জন্য। গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া পরিবারের জাদুঘর সাধারণের জন্য খোলা। কোচবিহারেও এমন জাদুঘর রয়েছে, তবে এগুলির মতো নয়। সচিন তেন্ডুলকর নিজের বাড়িতে নিজেকে একটি জাদুঘর করেছেন, সেখানেও সাধারণ লোকজন যেতে পারেন না।
এ রাজ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখকে নিয়ে জাদুঘর রয়েছে। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন যত উপহার পেয়েছেন, সম্মান পেয়েছেন – সে সব নিয়ে পাটনা জাদুঘরে একটি গ্যালারি রয়েছে। কলকাতা শহরে রয়েছে মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে এমন একটি জাদুঘর। আবার গুরুসদয় দত্তের সংগ্রহ নিয়েও কলকাতার উপকণ্ঠে একটি জাদুঘর রয়েছে যেখানে গুরুসদয় দত্তের পাশাপাশি বাংলার লোকশিল্পের ইতিহাসও ধরা রয়েছে।
কলকাতায় রবীন্দ্রতীর্থ (নিজস্ব চিত্র)
তবে এই ধরনের জাদুঘরের সেরা উদাহরণ হায়দরাবাদের সালার জঙ্গ মিউজিয়াম। এটি হল তৃতীয় সালার জঙ্গের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও ব্যবহারের জিনিস দিয়ে সাজানো। গোয়ালিয়রের জাদুঘর ও রামনগরে কাশীরাজের পারিবারিক জাদুঘর তেমনই। রবীন্দ্রতীর্থ মিউজিয়ামে আবার রয়েছে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির রেপ্লিকা, রবীন্দ্রনাথের কথায় যাঁরা গান গেয়েছেন তাঁদের ছবি, রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির কপি প্রভৃতি। আবহে বেজে চলেছে তাঁর গান। কোনও ব্যক্তির জীবন ও বাণী তুলে ধরার জন্য এই ধরনের জাদুঘর দরকার।
নেহরুর জন্য আলাদা জাদুঘর?
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে নিয়ে আলাদা জাদুঘর থাকা দরকার নাকি একটি জাদুঘরে তাঁর জন্য একটি বিভাগ থাকাই যথেষ্ট? প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে তাঁর জন্য পৃথক একটি জাদুঘর না রাখা কি তাঁর অবদান অস্বীকার করার দিকে এক ধাপ এগনো? উঠতে পারে এই প্রশ্নও।
জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাঁর জীবন বর্ণময়, রয়েছে বিতর্কও। সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরতে হলে ব্যক্তিত্বের আলোর পাশাপাশি আঁধারের দিকও তুলে ধরা জরুরি। আমাদের দেশে সাধারণ ভাবে কোনও ব্যক্তির জীবনের উজ্জ্বল দিক তুলে ধরে কার্যত দেবতার আসনে বসিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে সেখানে অনেক ব্যক্তিত্ব থাকলে তা ভারসাম্য-যুক্ত হতে পারে।
যেমন একই জাদুঘরে জওহরলাল নেহরু, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী, মোরারজি দেশাই, চরণ সিং, রাজীব গান্ধী, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্র শেখর, নরসিমহা রাও, অটলবিহারী বাজপেয়ী থাকলে দেশের রাজনীতির ধারা উঠে আসবে। ব্যক্তিত্বের সংঘাতের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠবে রাজনৈতিক ইতিহাস।
পাটনা জাদুঘরে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদকে নিয়ে একটি বিভাগ রয়েছে (ফাইল চিত্র)
গান্ধীজির ইচ্ছায় জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল উপেক্ষিত হয়েছিলেন বলে যে বিতর্ক রয়েছে, সামগ্রিক ইতিহাস নিয়ে জাদুঘর না তৈরি করলে সেখানেও বল্লভভাই প্যাটেলের মতো ব্যক্তি উপেক্ষিত রয়ে যাবেন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী হননি বলে। তবে প্রধানমন্ত্রীদের জন্য পৃথক জাদুঘর হলে সেখানে এই ধরনের বিশ্লেষণের উপায় যে থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক।
কোনও মহান ব্যক্তির বাড়িতে তাঁকে নিয়ে আলাদা জাদুঘর থাকা উচিত। তবে দেশের রাজধানীতে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য এক একটি জাদুঘর রাখা অনেকটাই বিলাসিতা। তাই প্রধানমন্ত্রী পদের গৌরব তুলে ধরার জন্য প্রধানমন্ত্রীদেরল নিয়ে পৃথক একটি জাদুঘর থাকাই বাঞ্ছনীয় যেখানে তাঁদের জীবন ও কাজ ফুটে উঠবে।
জাদুঘর করলেই হবে না, দেখতে হবে সেটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নহরুকে নিয়ে হচ্ছে নাকি ব্যক্তি নেহরুকে নিয়ে হচ্ছে। ব্যক্তি নেহরু বা গান্ধী-নেহরু পরিবারকে নিয়ে জাদুঘর গড়া হলে তার দায়িত্ব দেশের করদাতারা নেবে কেন?
একই ভাবে বলা যায়, কংগ্রেসকে নিয়ে কোনও জাদুঘর গড়া হতে পারে, তা হলে সেটি কংগ্রেস দসলগত ভাবে করুক। চাইলে বিজেপিও এই ধরনের জাদুঘর গড়তে পারে। করদাতাদের অর্থে কোনও জাদুঘর হলে সেখানে কংগ্রেস নয়, সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে হোক। সরকারি অর্থে ব্যক্তিগত জাদুঘর গড়া হলে নয়ডায় ফিল্ম সিটির কাছে মায়াবতীর নিজের (দলের নামে) জাদুঘর গড়ার মতো বিতর্ক দেখা দিতে পারে। চান বা না চান, রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে আলাদা করতেই হবে। দেশের জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, লড়াই করেছেন তাঁদের কংগ্রেস নামে বন্ধনীতে ঢুকিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। কংগ্রেসের জন্মের আগেও এ দেশে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছে।