মোগল রমণীরা অবলা ছিলেন না: জেনে নিন 'মোগলানি'দের বীরগাথা

সৈয়দ নাসির নজিরের লেখা 'লাল কিলা কি এক ঝলক' নামে একটি বই আমি পড়েছিলাম

 |  4-minute read |   05-02-2018
  • Total Shares

পিজি উডহাউসের 'ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস' উপন্যাসটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। উডহাউসের প্রায় প্রতিটি নায়িকাই অবলা এবং তাঁরা সর্বদা পুরুষ 'জানোয়ার'দের আতঙ্কে তঠস্থ হয়ে থাকতেন।

এই উপন্যাসটিতে খুব সুন্দর ভাবে মহিলাদের চিত্রায়িত করা হয়েছে- এই মহিলারা যেন এক ধরনের সহায়সম্বলহীন জীব, যাঁদের সুরক্ষার জন্য অন্তত একজন করে পুরুষ নিতান্তই প্রয়োজনীয়। তবে আমার ইতিহাস জ্ঞান থেকে মনে হয়েছে যে এই ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন। সেই সময় মহিলারা যথেষ্ট করিৎকর্মা ছিলেন।তাঁদের করিত্কর্মা হত, কারণ রুজি-রোজগারের তাগিদে পুরুষরা অধিকাংশ সময়ই বাইরে থাকতেন।

'লাল কিলা কি এক ঝলক' নামক একটি বই আমি পড়েছিলাম। বইটির লেখক সৈয়দ নাসির নজিরের ১৮৬৫ সালের ১৬ই অগস্ট। জীবনের শুরুতে তিনি তাঁর পিতার কাছে বিদ্যালাভ করেন। তাঁর পিতা একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন যিনি 'মালাল' ছদ্মনামে লিখতেন।

ছেলেবেলা থেকে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন নজির। পরবর্তী কালে, চিকিৎসক হিসাবে বেশ নাম-ডাক হয় তাঁর। ধর্মপুরের রইস তাকে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও সন্তানদের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন। ধর্মপুরের রইসের মৃত্যুর পর নজির দিল্লি চলে আসেন। দিল্লিতে হঠাৎই তাঁর আধ্যাত্মিকতার প্রতি ঝোঁক হয়, তখন তিনি নিঃসঙ্গ জীবনযাপন শুরু করে দেন। 'সাকি' নামে একটি পত্রিকায় তিনি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন যা পরবর্তী কালে 'লাল কিলা কি এক ঝলক' বইটিতে প্রকাশিত হয়।

বান্নি খানুম নামক জনৈক মহিলার কাছে গল্প শুনে এই বইটিতে মোগল রাজপ্রসাদের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করেছেন নাজির। খানুমের শ্বাশুড়ি রাজপ্রসাদের রান্নাঘরের কর্ত্রী বা সুপারিন্টেন্ডেট ছিলেন। খানুম নিজেও শ্বাশুড়ির সঙ্গে রাজপ্রাসাদে থাকতেন এবং ১৮৫৭ সাল অবধি রাজপ্রসাদের রান্নাঘরে কর্মরত ছিলেন। খানুমের মুখ থেকে ঘটনাগুলোর বিবরণ শুনে নজির ৭৬টি গল্প লিখেছিলেন।

এর মধ্যে একটি ঘটনা ব্যক্তিগত ভাবে আমি খুব উপভোগ করেছি। আমার দিদিমাও অনেকটা একই ভাবে একবার তার বাড়িতে ডাকাতির ছক ভেস্তে দিয়েছিলেন। ডাকাতরা বাড়িতে হানা দিলে আমার দিদিমা হুঁকো পান করার অভিনয় করতে থাকেন এবং খুব জোরে গোঁ গোঁ শব্দ করতে শুরু করে দেন। ডাকাতদের ধারণা ছিল যে বাড়িতে কোনো পুরুষমানুষ নেই এবং সেই সুযোগে ডাকাতি করবার ফন্দি এঁটেছিল তারা। কিন্তু দিদিমার উপস্থিত বুদ্ধির জন্য ডাকাত দল চম্পট দিতে বাধ্য হয়। ছোটবেলায় আমি এই গল্পটি বহুবার শুনেছি।

body_020518035741.jpgধ্য এশিয়া থেকে মোগল সৈন্যদলে যোগ দিতে এসেছিলেন বলে তাঁদেরও মোগল বলা হত

বা

ন্নি খানুমের মুখে শুনে নজিরের লেখা সেই ডাকাতদের গল্পে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক:

মোগল রমণী ও ডাকাত দল

দিল্লির শাহাজাহানাবাদ এলাকায় সেই সময় নক্সাবন্দি সুফি সন্তদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্ৰতিষ্ঠান ছিল। প্রথমটি, মির্জা জান এ জানানের ‘খানকাহ’ বা ধর্মশালা। আর একটি খাজা মির দর্দের ‘বড়দাড়ি’। আমি নিজে খ্বাজা নাতির শিষ্য ছিলাম।

এই সন্তদের জন্য তুর্কমেনিয়া যেন শাহাজাহানাবাদে নেমে এসেছিল। তাদের কয়েকশো ভক্ত শহরে থাকতেন। এমনকি, সবজি মান্ডির একটি চত্ত্বরকে তাদের জন্য মুঘলপুরা নামে ডাকা হত।

(এই মুঘলরা কিন্তু সরাসরিভাবে মুঘল সম্রাটদের পরিবারের কেউ ছিলেন না। কিন্তু তাঁদেরও মোগল বলে সম্বোধন করা হত, কারণ তাঁরা মোগল সাম্রাজ্যের সেনাদলে যোগ দিতে মধ্য এশিয়া থেকে এ দেশে এসেছিলেন। এই গোষ্ঠীর মহিলাদের ‘মোগলানি’ বলে আঞ্চলিক ভাষায় সম্বোধন করা হত।)

এঁরা খুব সাহসী যোদ্ধা ছিলেন যাঁরা দক্ষিণাত্য অভিযানের সময় নিজেদের বীরত্ব প্রমাণ করেছিলেন। শিরিন বেগ ও শক্কর বেগ যখন লাহোরি দরওয়াজা থেকে চাঁদনি চক পর্যন্ত বাড়িগুলোতে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট বাধিয়ে দিতেন। এ জন্য তারা দিল্লিবাসীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তেন।লড়াইয়ে দুপক্ষেরই অনেকেই আহত হতেন। কিন্তু কোনওদিনও কেউই এ বিষয় পুলিশে অভিযোগ জানাতেন না।

একদিন আমি ‘বড়দাড়ি’তে আমার গুরুকে প্রণাম জানাতে গিয়েছিলাম। সেই দিন মোগলপুরা থেকে জনাপঞ্চাশেক শিশু ও মহিলা ওই জায়াগায় জমায়েত হয়েছিলেন। আমি মির দর্দের নাতনি বেগম সাহিবার কাছে এদের আসার কারণ জানতে চাই।

বেগম সাহিবা বললেন, "ওঁরা একটু সমস্যায় পড়েছেন। তাই বাড়ি ছেড়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। ওঁদের বাড়ির ১২ থেকে ৫০ বছর বয়সী পুরুষরা সকলেই দক্ষিণাত্য অভিযানে গেছেন। শিশুদের নিয়ে এই মহিলারা একেবারে একা হয়ে পড়েছেন।

কিছুদিন আগে একজন ভিক্ষুক তাদের কাছে ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিল। এদের একজন তাঁদের পরিচারিকাকে কিছুটা ময়দা ভিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই পরিচারিকা ভিক্ষে দেওয়ার সময় ভিক্ষুককে জানিয়ে দেন যে এই চত্বরে ভিলায়তি মোগলদের ২০টি বাড়ি রয়েছে। বাড়ির পুরুষরা যুদ্ধে গিয়েছেন, তাঁদের বাড়িতে লুঠ করা প্রচুর ধনসম্পত্তি মজুত রয়েছে।

ভিক্ষুক সেখান থেকে যাওয়ার পরে পরিচারিকার কাছে গৃহকর্ত্রী জানতে পারেন যে সে ভিক্ষুকে কী খবর দিয়েছে। এদের প্রতিটি বাড়ির মাঝখানে যে জানলা রয়েছে, সেই জানালা দিয়ে নিমেষে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ওই ভিক্ষুক ডাকাতির জন্য তাঁদের বাড়িতে চড়াও হতে, এ কথা ভেবে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

এর পর মহিলারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরিস্থিতি মোকাবিলার পরিকল্পনা করেন। রাতের বেলা তাঁরা পুরুষদের পোশাক পরে, পুরুষদের অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে পাহারা দিতে শুরু করেন। শান্তিপূর্ণ ভাবেই কাটল সেই রাত।পরের দিন সেই ভিক্ষুক আবার ভিক্ষে চাইতে চাইতে সেই স্থানে এলেন। ভিক্ষুকের আওয়াজ শুনে পরিচারিকা দৌড়ে বাড়ির বাইরে গেল। ভিক্ষুক তখন পরিচারিকাকে ভর্ৎসনা করে বললেন, "তুমি বলেছিলে বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। অথচ গতকাল রাতে বাড়ির ছাদে একগাদা পুরুষ পাহারা দিচ্ছিল।" পরিচারিকা তখন ভিক্ষুকের কাছে আগের রাতের ঘটনাও ফাঁস করে দেয়।

পরিচারিকা বাড়ি ফিরলে গৃহকর্ত্রী আবার তার আর ভিক্ষুকের মধ্যে কী কথোপকথন হয়েছে তা জেনে ফেলেন। ফের আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেন বাড়ির মহিলারা। তাঁরা বুঝতে পারেন যে এবার সত্যিটা জেনে ফেলার পর তাদের আর কোনওরকম রেওয়াত করবে না ডাকাত দল। তাই তারা ধনসম্পত্তি সহ ‘বড়দাড়ি’র হজরত বেগম সাহিবের কাছে আশ্রয় নিতে ছোটেন। কিন্তু সেই পরিচারিকাকে তাঁরা বাড়িতে রেখে দিয়ে যান।

আগের দিন মোগলপুরা থেকে একজন এসে খবর দেন যে যেদিন তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সেদিন তাদের পাড়ায় একটি ডাকাতি হয়। ডাকাতরা বেশ কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু বাড়িতে দামি কিছু না পেয়ে তারা মিথ্যা খবর দেওয়ার দায়ে সেই পরিচারিকাকে বেদম প্রহার করে। এই খবর শুনে মোগল রমণীরা খুব খুশি হন।

এখন হজরত বাবা পুলিশে খবর দিয়েছেন এবং পুলিশ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মহিলারা আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই যে যার বাড়িতে ফিরে যাবেন।"

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

RANA SAFVI RANA SAFVI @iamrana

The writer is the author of 'Where Stones Speak' and other books.

Comment