মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ: সেলুলয়েডে মধ্যবিত্ত প্রতিবাদী যুবক

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ অনুরোধ করলেও তাঁর গল্প নিয়ে ছবি করেননি মৃণাল সেন

 |  7-minute read |   31-12-2018
  • Total Shares

চিত্রনাট্যের খসড়া

১৯৮২ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসব। মৃণাল সেনের সঙ্গে আলাপ হল গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের।  উৎসবে জুরি সদস্য হিসাবে গিয়েছিলেন মৃণাল। সেখানে মার্কেজও ছিলেন জুরি সদস্য হিসাবে। সেখানেই প্রথম দেখা। এরপর সেই আলাপ দ্রুত বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এর বছর দুই-তিন পর হাভানায় ফের দেখা হয় দু’জনের। সেখানে প্রচুর আড্ডা হয় তাঁদের মধ্যে। তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশ বিদেশের ছবি, সাহিত্য থেকে কী ভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায় এসব নিয়ে প্রচুর কথা হয় দু’বন্ধুর।

gabiel-mrinal_123118063654.jpgমার্কেজ ও মৃণাল সেন (সৌজন্য: টুইটার)

মার্কেজ প্রসঙ্গে মৃণালের কথাতেই আমরা জানতে পারি মার্কেজ সিনেমা বানাতে বলেছিলেন মৃণাল সেনকে। অথচ তিনি চাইতেন না তার লেখা নিয়ে কেউ ছবি করুক। কারণ মার্কেজ বিশ্বাস করতেন ওঁর গল্পের যা ধারা তা থেকে ছবি করা মুশকিল। গল্পের মূল মেজাজটাই নষ্ট হয়ে যাবে।

কিন্তু মৃণাল সেনকে তিনি তাঁর ‘অটাম অব দ্য পের্টিয়ার্ক’ নিয়ে ছবি বানানোর প্রস্তাব করেছিলেন, বলা যায় অনুরোধ করেছিলেন। এর জন্য তিনি কোনও টাকাপয়সা যে নেবেন না, সে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু মৃণাল সেন এ ব্যাপারে তাঁর অপারগতার কথা সরাসরি মার্কেজকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

এমন একটা প্রস্তাব মৃণাল ফিরিয়ে দিলেন কেন? এ ব্যাপারে মৃণাল সেনের বক্তব্য ছিল, আসলে মার্কেজ মৃণালের কাছে একটা ভারতীয় যোগাযোগের সূত্র খুঁজছিলেন। কিন্তু মার্কেজ বোঝার চেষ্টাই করেননি যে ওই গল্প নিয়ে ছবি করা মৃণাল সেনের পক্ষে অসম্ভব কাজ। মার্কেজ জানিয়েছিলেন, ছোটদের কোনও একটা বইয়ে তিনি একটা ভারতীয় বাড়ির ছবি দেখেছিলেন। সেই ছবিটিকে মাথায় রেখেই লিখেছিলেন গল্পটি। মৃণাল সেন মার্কেজকে বলেছিলেন, ওই গল্পের সমাজ, চরিত্র শুধু নয় গল্পের মেজাজটাও এত বেশী লাতিন আমেরিকান যে তার আদল বদলে ভারতীয় প্রেক্ষেপটে নিয়ে আসা দুরুহ কাজ। মার্কেজ মৃণালের বক্তব্য যেমন বুঝতে পেরেছিলে, আমরাও জানলাম মৃণাল সেন ঠিক কোন মেজাজের চলচ্চিত্র নির্মাতা।

সিকোয়েন্স

ফিরে যাই মার্কেজের সঙ্গে মৃণালের এই আলাপচারিতার ঠিক দেড় দশক আগে। দার্জিলিং জেলার  নকশালবাড়িতে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে  অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাংশ, কেরল, পূর্ব ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতায়। ইতিমধ্যে মৃণাল সেন পরিচালিত ছবি ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়। ছবিটি অনেকের মতে মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। এরপরই মৃণাল তাঁর কলকাতা ট্রিলজি অর্থাৎ ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২) এবং পদাতিক (১৯৭৩) নির্মাণ করেন। তিনটি ছবিতেই তিনি কলকাতার সেই অস্থির সময়কে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

mrinal-sen_1_123118063725.jpegমৃণাল ছিলেন অন্য মেজাজের চলচ্চিত্র নির্মাতা (সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)

কী বলতে চাইলেন মৃণাল? তিনি কি কলকাতার রাজনীতির মনঃস্তত্ত্বে প্রবেশ করতে চাইলেন, নাকি সেকালের তরুণদের চোখ দিয়ে কলকাতার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে চাইলেন? কিন্তু ইন্টারভিউ ছবিটিতেও তো আমরা পথের পাঁচালী-র সর্বজয়া, অপু ও দুর্গাকে পেলাম। রঞ্জিত, তাঁর মা ও বোন। যদিও মৃণালের কথা অনুযায়ী কলোনিয়াল লিগ্যাসি (ঔপনিবেশিকতার ধারা) থেকেই গিয়েছে, এবং সেটা কেবল পোশাকের স্তরে নয়, সর্বস্তরে কাজ করেছে। আর সেটা দেখাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা কোলাজের মতো করে নানা ধরণের মন্তব্য, একটা ক্ষীণ গল্পের বাইরে গিয়ে ফের দরকার মতো ভিতরে এসে একটা গল্প বলারও চেষ্টা, মন্তব্য... গভীর বক্তব্য রেখেছেন।

স্টার্ট ক্যামেরা

ইন্টারভিউ বা সাক্ষাৎকারকে ঘিরেই এগিয়েছে ইনটারভিউ  ছবিটি। আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পুষে রাখার যে প্রবণতা তার তীব্র সমালোচনা ছবিটিতে। সাহেবি পোশাক স্যুট জোগাড় করতে পারেনি বলে চাকরি হয়নি রঞ্জিত মল্লিকের। ছবিতে একটি সুট জোগাড়ের জন্য অর্ধেক কলকাতা চষে ফেলে রণজিৎ। একটি প্রেসে কাজ করেন তিনি, কিন্তু আরও একটু ভালো থাকার আশায় প্রাণপণে তিনি স্যুট জোগাড়ের চেষ্টা করেন।

 

চাকরিপ্রার্থী ও চাকরিদাতা, উভয়ের মগজেই সদ্য বিদায় নেওয়া ব্রিটিশ প্রভুদের আত্মা ভর করে আছে যে! তাই চাকরি পাওয়ার জন্য অন্য সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু পোশাকের কারণে চাকরি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় রঞ্জিত। যে ক্ষোভ ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে কতগুলি প্রশ্ন। কারা প্রশ্ন করছেন তাঁকে? দর্শক, সাধারণ মানুষ নাকি পরিচালক?

অ্যাকশন

সেই প্রশ্নগুলিই অস্থির করে তোলে রঞ্জিতকে। প্রথমে তিনি চাকরিটি পাননি বলে বেশ নির্লিপ্ত ছিলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে তিনি আফসোস আর ক্ষোভের আগুনে পুড়ছিলেন সেটা বেরিয়ে আসে ওই সব প্রশ্ন বা উস্কানিতেই। তাই কাচ ঘেরা সুট-টাই-টুপি পরা এক মানেক্যন বা পুতুলের উপর হামলা করেন রঞ্জিত। ভেঙে চুরমার করেন কাচ, টেনে ছিঁড়ে ফেলেন পুতুলের গায়ের জামাকাপড়। তার আগে সে ওই পুতুলের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে সুট-টাইয়ে। পরে পুতুলকে নগ্ন করার মধ্য দিয়ে রঞ্জিত নিজের ভিতরের সাহেব প্রভুর প্রতি যে অবনত ভাব সেটাকে দূর করে ঔপনিবেশিক মানসিকতার অবসান ঘটাতে চায়।

ছবির শুরুর দৃশ্যগুলি আবার আমরা দেখি -- কলকাতার রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ব্রিটিশ রাজের বসানো বড়লাটের মূর্তি। গলায় দড়ি বেঁধে নামানো হয় বড়লাটকে। রণজিৎ শেষ দৃশ্যে যখন ভাঙচুর করছে তখন হঠাৎই দেখা যায় একজন স্লোগান দিচ্ছে ‘ইনকিলাব...’। দেখা যায় কৃষকদের মিছিল, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, বিপ্লব, কলকাতার রাজপথ, প্রতিবাদ মুখর শ্রমিক কৃষক জনতার ভিড় – মারমুখী তাঁরা, রঞ্জিতের মতোই। তাঁরাও প্রচলিত সবকিছুকে ভেঙে ফেলতে চান। সমাজ মনে গেড়ে বসা ঔপনিবেশিক প্রতিমাকে গুঁড়িয়ে দিতে চান রঞ্জিত।  

ডায়লগ

কিন্তু রঞ্জিত দ্বিধাদ্বন্দ্বময় এক মাঝারি বুর্জোয়ার চরিত্র। ছবির শুরুতেই তিনি তাঁর মাকে বলছেন,  নতুন চাকরিতে অনেক বেশি বেতন পাবে। মানে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন রঞ্জিত। প্রেমিকাকে বিয়ে করে আর দশটা বড়লোক যেমন, ঠিক তেমনটি হওয়ার ইচ্ছা তাঁরও আছে। ইন্টারভিউর দিন সকালে সে গুণগুণ করে গান: ‘আমার সোনার হরিণ চাই’।  সেই রঞ্জিতের ভেতরকার প্রতিবাদী মানুষটাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনা হয়-  অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে, বিপ্লবী হয়ে ওঠার মন্ত্র যেন বুক থেকে টেনে মুখে, তারপর ক্রোধে পরিণত করা হয়। যে ক্রোধ সামিল হয় বিশ্বের অন্য আরও সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে।

ফেড ইন

কে এই এই রঞ্জিত? যিনি বা যাঁরা নিজেকে অসহায় বোধ করে উৎপীড়ন ভোগ করেন বিদেশি পুঁজির আঘাতে নিদারুণ। কিন্তু বিদেশি কোম্পানির মোটা অঙ্কের মাইনে পেতে চান। কিন্তু কোম্পানির ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে তিনি বঞ্চিতও হন – এটা তো উৎপীড়নই। উৎপীড়িত হলে এই মাঝারি বুর্জোয়া ‘বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেন এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করেন। এই মাঝারি বুর্জোয়াই আবার বিপ্লবের শত্রু হয়ে উঠতে পারে, নিজেদের সুযোগ-সুবিধা পেলে। শত্রু হওয়া মানে অসহযোগিতা করা, নিজেদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাকে যে কোনও মূল্যে রক্ষা করা। আর সেটা করতে গেলে অবধারিত ভাবেই বিরোধিতা করতে হবে তাঁদের, যাঁরা এই ঔপনিবেশিক শক্তির পুরোপুরি অবসান চান।

সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে রঞ্জিত বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন বটে, কিন্তু একটা পর্যায়ে রঞ্জিত বারবারই নিজেকে কল্পনা করেছিলেন সাহেবি পোশাকে তখন কিন্তু তাঁর দোদুল্যমানতাই ফুটে ওঠে যা মাঝারি বুর্জোয়ার শ্রেণিচরিত্র।

ফেড আউট

আমরা দেখি, বিদ্রোহী হয়ে ওঠার সময় মৃণাল সেন বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখালেন, ঠিক যেন সেই মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনির ‘জ্যাবরিস্কি পয়েন্ট’-এর শেষ দৃশ্য, যেখানে বুর্জোয়া স্থাপত্য বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়া হয়, সে রকমই এক মূর্তি ভাঙার দৃশ্য আমরা রচিত হতে দেখি ‘ইনটারভিউ’তে। পরিচালক বিষয়টিকে একটি প্রতীক বা সিম্বলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন বলেই ছবিতে রঞ্জজিত শেষ পর্যন্ত রণমূর্তি ধারণ করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে।

ফ্রিজ

আসলে মৃণাল সেন রঞ্জিতের ভেতর দিয়ে মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণির মনোবাসনা পূরণ করতে চাননি, বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, পরিচালক হিসেবে তিনি কিছু কথা বলতে চান এবং সেসব কথা কয়েকটি চরিত্র ও কাহিনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চান।

এভাবেই তিনি একটি ধারণাকে রূপক আকারে হাজির করার কথা বলতে চান, সেটা দর্শককে অদৃশ্য চতুর্থ দেওয়ালের ওপারে রেখে নয়, দর্শককে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করেই বলতে চান। দর্শক যেন নিষ্ক্রিয় না থেকে সক্রিয় হয়ে ওঠেন, একটা মিথষ্ক্রিয়া যেন তৈরি হয়। রণজিৎ একটি চরিত্র মাত্র। বলা যায় রণজিতের চাকরির জন্য হন্যে হয়ে সুট খোঁজা একটি উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য হল বাঙালির ঔপনিবেশিক মনোভাব, ভৃত্যের জীবনকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতাকে কটাক্ষ করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা।

এই পুরো প্রক্রিয়াটিই আবার খুব খোলামেলা ভাবেই দেখাতে চেয়েছেন তিনি। চলচ্চিত্রের চরিত্র ও দর্শকের মাঝে যে কল্পিত চতুর্থ দেয়াল থাকে সেটিকে তিনি ভেঙে দিয়েছেন ওই একটি কারণেই।

interview5j_123118063905.jpgইন্টারভিউ (সৌজন্য: মৃণালসেন.ওআরজি)

মৃণাল সেনের শিল্পীমানসের নির্মাণ হয়েছিল কমিউনিষ্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রভাবে ও শিক্ষায়। মৃণাল সেন তাঁর আত্মজীবনী তে বলেওছেন, যে গণনাট্যই তাকে ছবি করতে বার বার অনুপ্রাণিত করেছে৷ বলেছেন গণনাট্যের জন্যই দেশের মাটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন৷ মৃণাল সেন গণনাট্যের জন্যই দেশের মাটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন৷ গ্রামগঞ্জের ভিতরে ঢুকে আসল জীবনকে দেখেছেন, দেখেছেন মানুষের লড়াইকে৷ আর এই অভিজ্ঞতাই তাঁর ছবি তৈরির অন্যতম উপাদান৷

কাট টু

আসলে রাজনীতি-সমাজ নিয়ে তাঁর তর্কাতর্কিই তাঁকে আধুনিক করেছে কখনও উত্তর আধুনিকও। তাঁর ছবি একমাত্রিক নয়, বহু অলিন্দ ধরে তিনি হেঁটেছেন সেলুলয়েডে। কখনও সরাসরি দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, বলতে চেয়েছেন এটা চলচ্চিত্র বা সে রকম কোনও মাধ্যম নয়, তা হলে সেটা কী? হতে পারে চলচ্চিত্রের রূপরেখা কিংবা নীল আকাশের নীচে একদিন প্রতিদিন অথবা তার সব কিছু খারিজ করে দিয়ে একদিন আচানক খণ্ডহরে পৌঁছে যাওয়া।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TAPAN MALLICK CHOWDHURY TAPAN MALLICK CHOWDHURY

The writer is a journalist.

Comment