সত্যজিৎকে নিয়ে সমালোচনা শুনে রেগে গিয়েছিলেন মৃণাল সেন
মৃণাল সেনের ছেলে কুনাল বাবাকে 'বন্ধু' বলে ডাকতেন
- Total Shares
১৯৬৫ সাল পাঠভবন ইস্কুলের প্রথম দিককার কথা। মাত্র ২৪ জন পড়ুয়া। তখন ইস্কুলের ঘন্টা কেনারও পয়সা ছিল না, শিক্ষক-শিক্ষীকারা ঘড়ি দেখে ক্লাসে যেতেন আসতেন। আমার মা পাঠভনের একজন প্রতিষ্ঠাতা এবং শিক্ষিকা ছিলেন। আমি তখন ক্লাস টু’ইয়ের ছাত্র। আমাদের ক্লাস শুরু হতো সাড়ে বারোটায় কিন্তু আমি মায়ের সঙ্গে সকাল দশটাতেই স্কুলে চলে আসতাম। ক্লাস ফাইভের ছাত্র ছিল মৃণালবাবুর পুত্র কুণালদা। ওদের ক্লাস শুরু হতো ১০টা থেকে। কুণালদার বাবা ওনাকে পৌঁছতে আসতেন। ওনার হাতে তখন অখন্ড অবসর। এইভাবেই ওনার সঙ্গে আমার ভাব জমে ঊঠেছিল। আমি অন্য বন্ধুদের বাবাদের মতোই ওনাকে ডাকতাম মেসোমশাই বলে, উনি হেসে বলেছিলেন, আমাকে মৃণালদা বলে ডেকো। বেশ মজাই লেগেছিল এত বড় একজন দাদা! কুণালদা ওনাকে আবার ডাকতেন ‘বন্ধু’ বলে সেটাও বেশ মজার। যাই হোক দশটা থেকে আমার ক্লাস শুরু হবার আগে পর্যন্ত আমার আর মৃণালদার সময় কাটত ক্যারাম খেলে! তখন মৃণাল সেন যে কে সেটা বোঝার বয়স হয়নি, কিন্তু ওনার সঙ্গে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগত- যদিও ক্যারাম খেলা নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়াও হতো!
তারপর প্রায় তিন বছর কেটে গেল। মৃণাল সেন মাকে বললেন- ওনার পরের চলচ্চিত্রে আমাকে অভিনয় করতে হবে। ছবির নাম ইচ্ছাপূরণ। মনে মনে খুব মজা লেগেছিল- দিনটিন সময় ঠিক হয়ে গেল। ছবি শুরু হওয়ার দু’দিন আগে আমার হল চিকেনপক্স-। ব্যাস সব মাটি। আমার আর ওনার চলচ্চিত্রে অভিনয় করা হল না।
ক্লাস ফাইভের ছাত্র ছিল মৃণালবাবুর পুত্র কুণালদা
আমাদের বাড়ি ছিল ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের কাছে আর কুণালদারা থাকতেন মতিলালা নেহরু রোডে, প্রিয়া সিনেমা হলের দু’ তিনিটে বাড়ি পরেই। কুণালদা তখন আমাদের ভীষণ প্রিয়, হিরোওয়ারশিপ করতাম ওনাকে। মাঝেমাঝেই আড্ডা মারতে যেতাম ওদের বাড়ি। মৃণালদা বাড়ি থাকলে ওনার সঙ্গেও নানান বিষয়ে গল্প হত। সেই সময়েই একটা মজার ঘটনা শুনেছিলাম- দেশপ্রিয় পার্কের সরস্বতী পজোর ঘটনা। কুণালদা সেখানে, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে কিন্তু তখনও বাড়ি ফেরেনি, ইচ্ছেও নেই বিশেষ ফেরার। মৃণাল সেন গিয়েছেন কুণালদাকে ডাকতে আর কুণালদার বায়না বাড়ি যাবে না। মৃণালদার অদ্ভুত কৌশল, বললেন কুণালদা তক্ষুণি বাড়ি না গেলে উনি ওখানে সবার সামনে নাচতে শুরু করবেন! ম্যাজিকের মতো কাজ হল- কুণালদা পিছু পিছু সটান বাড়িতে!
আমি যেতেই ঐ ভিড়ের মধ্যেই মৃণালবাবু হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কোনও বান্ধবী হল!’
এরপর স্কুলের শেষ, আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন মৃণালদার সঙ্গে অন্যরকম একটা সম্পর্ক। যখনই কোনও অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে আসার জন্য আবদার করেছি উনি সস্নেহে রাজি হয়েছেন। কিন্তু কখনোই ওনাকে গিয়ে আনতে হত না, নিজে নিজেই আসা-যাওয়া করতেন। পরে বুঝেছি উনি ছাত্র-ছাত্রীদের অসম্ভব ভালো বাসতেন। সব সময়ে ওই বয়সী ছেলেমেয়েরা কী ভাবছে সেটা খুব গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন, বোঝার চেষ্টা করতেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তখন একটা খুব চল ছিল সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে সমালোচনা করার। মনে আছে মৃণাল সেন কোনও একটা কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিমন্ত্রিত, সত্যজিৎবাবুর Our Films, There Films বইটা তখন সবে বেরিয়েছে। কোনও এক ছাত্র সমালোচনা করে বলেছিল- বইটার নাম Our Films Their Films দেওয়া ঠিক হয়নি, কেননা এতে ভারতীয় চলচ্চিত্র আর বিদেশি চলচ্চিত্রের কোনও পুর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ নেই। এই নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে গেল, ওই একবারই মৃণাল সেনকে যথার্থই রেগে যেতে দেখেছিলাম। উনি বলেছিলেন- সত্যজিৎ রায় কখনোই লেখার মুখবন্ধে দাবী করেননি যে এই বইটি ভারতীয় ও বিদেশি চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ। উনি কিছু দেশি-বিদেশি ফিল্ম নিয়ে ওনার মতো করে এই বইটিতে আলোচনা করেছেন ও তা প্রকাশিত হয়েছে, এ নিয়ে এত বাগবিতন্ডার কোনও মানেই হয় না।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তখন মাঝেমাঝেই মৃণাল সেনের বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হত। একবার মনে আছে গান্ধীভবনে ‘নীল আকাশের নীচে’ দেখানো হবে, আমি এই ছবিটি প্রথম দেখব, ঘন্টা খানেক আগে কুণালদাও এসে হাজির, বলল ফিল্মটা কখনও দেখেনি তাই দেখতে এসেছে!
আমাকে ওনার থেকে তিন প্যাকেট চারমিনার প্লেন উপহার দিলেন, বললেন- ‘ সিগারেট তো খাও!’
একবার কুণালদার কাছে কোনও একটা কারণে গিয়েছি, যথারীতি ওদের বসার-ঘরে অসংখ্য লোক। তখন ‘আকালের সন্ধানে’-এর শুটিং চলছে। আমি তো সটান কুণালদার ঘরে। কুণালদা বললেন, ‘এসেছিস যখন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে যা না হলে দুঃখ পাবেন।’ আমি যেতেই ঐ ভিড়ের মধ্যেই মৃণালবাবু হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কোনও বান্ধবী হল!’ আমি নিরুত্তর। বললেন- ‘এতদিন পরে বাড়িতে এসেছ তোমাকে কি দিই বলো তো?’ তারপর আমাকে ওনার থেকে তিন প্যাকেট চারমিনার প্লেন উপহার দিলেন, বললেন- ‘ সিগারেট তো খাও!’
এরপরের ঘটনা বেশ কিছুদিন পরের। রূপকলা কেন্দ্রে আমার বন্ধু অনিতা অগ্নিহোত্রী তখন ডিরেক্টর আর আরেক বন্ধু উজ্জ্বল চক্রবর্তী শিক্ষক। ওদের দুজনের অনুরোধে আমিও রূপকলার কিছু কিছু কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। রূপকলা কেন্দ্রের কোনও প্রয়োজনে সেই সময়ে মৃনাল সেনের বাড়িতে গিয়েছি। আমার ডাকনাম সানাই। সেদিন সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমাকে দেখলেই ওনার একটা গল্প মনে পড়ে। বনফুলের (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের) ভাই প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখন বার্ধক্যজনিত কারণে কানে কিছুটা কম শুনতেন। তা জেনে অরবিন্দবাবু উচ্চস্বরে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি বলাইয়ের ভাই কানাই।’ রবীন্দ্রনাথ সেই তীক্ষ্ণ স্বর শুনে মৃদু হেসে নাকি বলেছিলেন,‘এ যে দেখি সানাই!’
৯৫-এ পড়লেন মৃণালদা। তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।