মোগলমারির সঙ্গে মোগল সাম্রাজ্যের সম্পর্ক থাকলেও এখানে বৌদ্ধ সংস্কৃতি-নির্ভর জনপদ গড়ে উঠেছিল
হিউয়েন সাং ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মোগলমারি-সহ বঙ্গদেশের বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার পরিদর্শন করেন
- Total Shares
মোগলমারি আজ আর কেবল অখ্যাত গ্রাম নয়, সংবাদ শিরোনামে অবস্থান তার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বিদগ্ধ মহলে প্রত্নচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। মোগলমারিকে নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় ইতিহাস যেমন উদ্ঘাটিত হচ্ছে, তেমন সমৃদ্ধ ও সংযোজিত হচ্ছে ইতিহাসের পৃষ্ঠা।
নামের ইতিহাস
১) বহু বছর ধরে ইতিহাস গর্ভে ধারণ করে থাকা গ্রাম মোগলমারি। সপ্তদশ শতাব্দীতে মির্জা নাথান লিখিত ‘বাহারিস্তান-ই-ঘাইবি’ বইটিতে দুই মোগল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গিরের আমলে বাংলার হাল-হকিকত জানা যায়। ১৫৭৫ সালে মেদিনীপুর আর জলেশ্বরের (ওড়িশা) মাঝামাঝি তুকারুই নামে এক স্থানে মোগল ও পাঠানের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে মোগলদের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই থেকেই হয়তো মোগলমারি নামের উৎপত্তি।
২) স্থানীয় মাড় শব্দের অর্থ সড়ক বা পথ। কিংবদন্তি অনুসারে মোগলরা এই পথ মাড়িয়ে গিয়েছিল বলে এই স্থানে মাড়>মাড়ই>মাড়ি- ব্যবহৃত হয়েছিল। তাই কালের বিবর্তনে মোগলমাড়ি>মোগলমারি নামাঙ্কিত হয়ে প্রচলিত হয়ে আসছে। দাঁতন-১ ব্লকের অন্তর্গত মোগলমারি গ্রাম। এই দাঁতনের পুরোনো নাম দণ্ডভুক্তি ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে এই দণ্ডভুক্তিতেই তাঁর ভূমিদানের দলিল পাওয়া যায়।
চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মোগলমারি বৌদ্ধবিহার পরিদর্শন করেন
ইতিহাস
ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, গ্রামটির প্রাচীন নাম ‘অমরাবতী’। এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র সামন্ত রাজা ছিলেন বিক্রমকেশরী। তাঁর বিদূষী কন্যা সখীসেনার এক সময়ের অধ্যয়নের কেন্দ্র ছিল এখানে- অনেকেই তা মনে করেন। সখীসেনার সঙ্গে মন্ত্রীপুত্র অহিমাণিকের প্রণয় কাহিনির জনশ্রুতি রয়েছে, যা বর্ধমানের লোককবি ফকির রামের অমর কাব্য ‘সখীসোনা’ থেকে পাওয়া যায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ তাঁর ‘কিংবদন্তীর দেশে’ গ্রন্থে এই কাহিনি ‘সখীসেনার পাঠশালা’ নামে বর্ণনা করেছেন। ক্ষুদ্র পল্লিমাটির উপর আজ পড়ে রয়েছে সেই মুখর পাঠশালার এক ভগ্নস্তূপ।
চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার পরিদর্শন করেন। তিনি তাঁর সি-ইউ-কি গ্রন্থে বঙ্গদেশের চার রাজ্যের বিশেষ বর্ণনা করেছিলেন- পুণ্ড্রবর্ধন, সমতটী, কর্ণসুবর্ণ এবং তাম্রলিপ্ত। এই তাম্রলিপ্ত রাজ্যে ১০টি বৌদ্ধবিহার ও একহাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। এযাবৎকাল তাম্রলিপ্ত সন্নিহিত অঞ্চলে কোনও বৌদ্ধবিহার-ই আবিষ্কৃত হয়নি, মোগলমারি ব্যতীত।
পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনস্থলের মধ্যে মোগলমারি অতীতের একটি বিস্ময়কর রত্নভাণ্ডার, যা আজ সখীসেনার পাঠশালার সকল জনশ্রুতির দ্বিধাদ্বন্দ্বকে দূরে সরিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে অবস্থিত অন্যান্য বৃহৎ ও প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যগুলির মধ্যে এটি অন্যতম।
সময়গত ও গঠনগত দিক দিয়ে এই মহাবিহারটি নালন্দা, বিক্রমশীলা, পাহাড়পুর, ময়নামতী প্রভৃতি বিহারের সঙ্গে সাদৃশপূর্ণ
আবিষ্কার ও প্রত্নখননের সময় সারণি
১৯৯৯ সালে প্রাচীন নদী-বাণিজ্য সংক্রান্ত পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষের খোঁজে সুবর্ণরেখার গতিপথ ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন শহরে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. অশোক দত্ত। ড. দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় দাঁতন হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, ইতিহাসপ্রেমী নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস মহাশয়ের। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও প্রত্নত্তত্ব বিষয়ে নানান আলোচনার সূত্রে শ্রী বিশ্বাস দাঁতন-১ নম্বর ব্লকের মোগলমারি (২১˚৫৭’ উঃ অঃ / ৮৭˚১৬’ পূঃ দ্রাঃ) গ্রামে সখীসেনা ঢিবি নামে একটি প্রাচীন ইটের ঢিবির সন্ধান দিয়েছিলেন।
ঢিবিটি গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এবং বর্তমানে মোগলমারি তরুণ সেবা সঙ্ঘ ও পাঠাগার নামে একটি সংস্থার নিয়ন্ত্রাণাধীন। প্রত্নসমীক্ষার সময় দেখা গেছে গ্রামে অবস্থিত সুউচ্চ ঢিবিটিই শুধু নয়, বর্তমানে প্রায় সমগ্র গ্রামটি অবস্থিত একটি বিশাল প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্রের উপর। গ্রামের অভ্যন্তরে অবস্থিত ইটের তিনটি গোলাকার স্তূপের অংশ এবং গ্রামবাসীদের কাছে সযত্নে সংরক্ষিত পোড়ামাটির গোলাকার উৎসর্গ ফলক, যার উপর উৎকীর্ণ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের ব্রাহ্মী লিপিতে এবং মিশ্র সংস্কৃত-প্রাকৃত ভাষায় লেখা বৌদ্ধ ধর্মের অতি প্রাচীন বাণী ‘এ ধর্ম হেতু প্রভব ---’ এবং ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় মস্তকহীন বুদ্ধ মূর্তি ড. অশোক দত্তের বৌদ্ধ নিদর্শন সংক্রান্ত ধারণাকে যেমন সুদৃঢ় করেছিল তেমনি ড. দত্ত উদ্বুদ্ধও হয়েছিলেন মোগলমারির সখীসেনা ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন করার জন্য।
প্রত্নখননের প্রথম পর্যায় (২০০৩-২০০৪)
খননকার্য শুরু হয় ঢিবির উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে। খননে পাওয়া যায় নকশাযুক্ত ইট, বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের বাসস্থানের কুঠুরি। পাওয়া যায় ত্রিরথ কাঠামো যুক্ত নকশা, যা দেখে গবেষকদের প্রাথমিক অনুমান, স্থানটিতে মন্দির বা গর্ভগৃহ ছিল। গ্রামের অভ্যন্তরে খনন চালিয়ে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধস্তূপ ও এক বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া যায়, যাকে কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র বলা হয়।
প্রত্নখননের দ্বিতীয় পর্যায় (২০০৬-২০০৭)
এই পর্যায়ের খনন ঢিবির পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পরিচালিত হয়। পাওয়া যায় নকশাযুক্ত ইট দ্বারা সুসজ্জিত দেওয়াল, স্টাকো পলেস্তারা যুক্ত দেওয়াল, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার কুঠুরি। উদ্ধার হয় বুদ্ধের খণ্ড-বিখণ্ড মূর্তি, আদি মধ্যযুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের পুরাবস্তু, লোহার সামগ্রী এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির সিল।
প্রত্নখননের তৃতীয় পর্যায় (২০০৭-২০০৮)
খননকার্য হয় ঢিবির উত্তর, পূর্ব ও মধ্যভাগে। খননে স্টাকোর পদ্মের পাপড়ির ন্যায় পলেস্তারার নকশাযুক্ত সুসজ্জিত দেওয়াল, প্রদক্ষিণ পথ, বৌদ্ধস্তূপ, স্টাকো নির্মিত মুখাবয়ব, পাথরের মূর্তি, তামার মুদ্রা ও প্রচুর মৃৎপাত্র পাওয়া যায়।
প্রত্নখননের চতুর্থ পর্যায় (২০০৯-২০১০)
এই পর্যায়ের উৎখনন ঢিবির উত্তর দিকে পরিচালিত হয়। আবিষৃত হয় বৌদ্ধ বিহারের মূল প্রবেশদ্বার, প্রবেশদ্বারের উভয় দিকে দুটি সমায়তনের বৃহৎ কক্ষ, ইটের কারুকার্যমণ্ডিত স্তম্ভযুক্ত কুলুঙ্গি, চুনের পলেস্তারা যুক্ত মেঝে এবং পোড়ামাটির প্রদীপ।
গ্রামের অভ্যন্তরে খনন চালিয়ে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধস্তূপ পাওয়া যায়
প্রত্নখননের পঞ্চম পর্যায় (২০১০-২০১১)
খননকার্য ঢিবির মধ্য ও দক্ষিণাংশে হয়। দক্ষিণ দিকে পাওয়া যায় সমগ্র সীমানাপ্রাচীর যা স্টাকোর নির্মিত বিভিন্ন ধরনের নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। সীমানাপ্রাচীরের বাইরে চুনের পলেস্তারা যুক্ত ইট বিছানো প্রদক্ষিণ পথ ও এই প্রদক্ষিণ পথের উপর একটি গোলাকার স্তূপের ভিত্তি উন্মোচিত হয়। এছাড়াও সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির সিল, উৎসর্গ ফলক, প্রদীপ, আতরদান, কারুকার্যমণ্ডিত ছিদ্রযুক্ত নল ও গুপ্তোত্তর যুগের নকশাযুক্ত মৃৎপাত্র পাওয়া যায়।
প্রত্নখননের ষষ্ঠ পর্যায় (২০১১-২০১২)
এই পর্যায়ের খননকার্য হয় ঢিবির দক্ষিণ, মধ্য ও দক্ষিণ পশ্চিম দিকে। ঢিবির মধ্যভাগে পশ্চিমমুখী দেওয়ালে ১৩টি স্টাকোর মূর্তি উন্মোচিত হয়, যার মধ্যে কুবের জাঙ্গুলী, অবলোকিতেশ্বর, লোকেশ্বর, গন্ধর্ব, নৃত্যরত মানব মানবী ও গণমূর্তি প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সিদ্ধমাতৃকা হরফে উৎকীর্ণ বুদ্ধের বাণী সম্বলিত সিল, প্রদীপ, লোহার কাঁটা, আতরদান, নকশাযুক্ত ইট, নিত্য ব্যবহার্য মৃৎপাত্র প্রভৃতি পাওয়া যায়।
এই পর্যায়-ই ছিল ড. অশোক দত্তের নেতৃত্বে শেষ বারের জন্য মোগলমারির বুকে প্রত্নখনন। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর ৭ মার্চ ২০১৩ মোগলমারি ‘সখীসেনা ঢিবি’-কে রাজ্য সংরক্ষিত সৌধের মর্যাদা প্রদান করে এবং রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহশালা অধিকারের অধীনে মোগলমারিতে সপ্তম পর্যায়ের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের কাজ হয়।
প্রত্নখননের সপ্তম পর্যায় (২০১৩-২০১৪)
খননকার্য হয় ঢিবির উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। পশ্চিম দিকে উন্মোচিত হয় সীমানা প্রাচীর, গর্ভগৃহ, প্রদক্ষিণপথ, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার কুঠুরি। পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি স্টাকো মূর্তি, যার মধ্যে মঞ্জুশ্রীর মূর্তিটি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পাওয়া যায় মস্তকহীন বুদ্ধমূর্তি, রাজা সমাচার দেবের মিশ্রধাতুর মুদ্রা এবং সোনার লকেট। এই পর্যায়ের খননের শেষের দিকে উৎখনন চালিয়ে বিহারের নামফলক বা নামমুদ্রা উদ্ধার হয়। ফলকটিতে “শ্রীবন্দক মহাবিহারে আর্যভিক্ষু সঙ্ঘ” লেখা রয়েছে বলে গবেষকগণ প্রাথমিক পাঠোদ্ধার করেন।
প্রত্নখননের অষ্টম পর্যায় (২০১৪-২০১৫)
অষ্টম পর্যায়ের উৎখনন হয় ঢিবির উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যভাগ জুড়ে। উন্মোচিত হয় বিশালাকার স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ, বৌদ্ধ স্তূপ, উৎসর্গ ফলক, মূর্তির ভাঙা অংশ, লোহার কাঁটা, তামার বালা ও আংটি, পোড়ামাটির প্রদীপ, হাতির দাঁতের জপমালা, নকশাযুক্ত ইট ইত্যাদি।
প্রত্নখননের নবম পর্যায় (২০১৫-২০১৬)
এই পর্যায়ে ঢিবির দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্যভাগ জুড়ে খননকার্য করা হয়। উৎখননে ঢিবির কেন্দ্রস্থল থেকে উদ্ধার হয় ৯৫টি ব্রোঞ্জের মূর্তি, যার মধ্যে ২৫-৩০টি বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও অবলোকিতেশ্বর, হারীতী, তারা, সরস্বতী প্রভৃতি মূর্তিও পাওয়া যায়। উদ্ধার হয় স্বর্ণ মুকুটের একটি অংশ। এছাড়াও পাওয়া যায় ধাতুর ধুনুচি, জল ছিটানোর কমণ্ডলু, ধাতব স্তূপ, খেলনা গাড়ির চাকা, নিত্য ব্যবহার্য মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির অলঙ্কার, পাথরের মূর্তির ভাঙা অংশ ও ভাস্কর্য প্রভৃতি।
এযাবৎ খননে প্রায় ৫২ ধরনের নকশাযুক্ত ইটের ব্যবহারের নিদর্শন বিশেষ উল্লেখযোগ্য
নিরীক্ষণ
মোগলমারি বৌদ্ধ মহাবিহারে নবম পর্যায়ের উৎখনন পরিসমাপ্তির পর প্রাপ্ত পুরাবস্তু ও প্রত্নক্ষেত্রটি পর্যালোচনা করে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ নিম্নরূপ মন্তব্য পোষণ করেন –
১) মোগলমারি গ্রামের অভ্যন্তরে উৎখননে প্রাপ্ত কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র, এই অঞ্চলে তাম্রাশ্মীয় বা প্রাক-ঐতিহাসিক যুগের জনবসতির মুখ্য নিদর্শন।
২) মহাবিহারটি গঠনশৈলী ছিল ত্রিরথ কাঠামো। আয়তনে মহাবিহারটি ৬০ মিটার×৬০ মিটার (৩৬০০ বর্গমিটার)। এযাবৎ পশ্চিমবঙ্গে আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ।
৩) এযাবৎ খননে প্রায় ৫২ ধরনের নকশাযুক্ত ইটের ব্যবহারের নিদর্শন এবং স্টাকো ব্যবহারের নিদর্শন বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
৪) মহাবিহারটির নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণের তিনটি পৃথক পৃথক পর্যায় চিহ্নিত করা হয়েছে।
৫) রাজা সমাচারদেবের মিশ্রধাতুর মুদ্রা, স্বর্ণলকেট, স্বর্ণমুকুট এবং মহাবিহারের নামফলক বা নামমুদ্রা উদ্ধার হল উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার।
৬) সময়গত ও গঠনগত দিক দিয়ে এই মহাবিহারটি নালন্দা, বিক্রমশীলা, পাহাড়পুর, ময়নামতী প্রভৃতি বিহারের সঙ্গে সাদৃশপূর্ণ।
৭) সর্বোপরি উৎখননে বিস্ময়কর আবিষ্কার হল, মহাবিহারটির একটি স্থানে, একদিনে, একসঙ্গে ৯৫টি ব্রোঞ্জ মূর্তি উদ্ধার সমগ্র পৃথিবীর প্রত্নখননের ইতিহাসে এক বিরলতম দৃষ্টান্ত।
যাত্রাপথের বিবরণ
মোগলমারি গ্রাম দাঁতন-১ নং ব্লকের অন্তর্গত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়, ওড়িশা সীমানার খুব কাছাকাছি অবস্থিত। কী ভাবে পৌঁছবেন মোগলমারিতে? ভাবছেন তো? কলকাতার খুব কাছেই তো মোগলমারি। কলকাতা থেকে সড়ক পথে অতি সহজেই পৌঁছান যায় মোগলমারি। বিদ্যাসাগর সেতু থেকে মোগলমারির দূরত্ব প্রায় ১৬৩ কিলমিটার। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভাবে আপনার নাগালের মধ্যে। সময় লাগে ঘণ্টা তিনেক। বিদ্যাসাগর সেতু হয়ে প্রবেশ করতে হবে কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে। কোনা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বামদিকে মোড় নিয়ে ৬ নং জাতীয় সড়কে প্রবেশ করতে হবে। যাত্রাপথে ধূলাগড়ি,
উলুবেড়িয়া, কোলাঘাট, দেউলিয়া, মেছোগ্রাম, ডেবরা পার হয়ে কিছু দূর অতিক্রম করার পর মাদপুরের কাছে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক দু-ভাগে বিভক্ত হয়েছে। প্রথমটি উড়ালপুলের উপর দিয়ে খড়্গপুর হয়ে মুম্বাইয়ের দিকে গিয়েছে। অন্যটি বাঁদিকে বেঁকে গিয়ে ৬০নম্বর জাতীয় সড়ক বা এশিয়ান হাইওয়ে ৪৫-এ গিয়ে মিশেছে। এই পথ ধরে ৫২ কিলোমিটার অতিক্রম করলেই পৌঁছানো যাবে মোগলমারি বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ড থেকে ডানদিকে একটি রাস্তা মোগলমারি গ্রামে প্রবেশ করেছে। সেই রাস্তা ধরে মাত্র ৪০০ মিটার এগোলেই মোগলমারি প্রত্নউৎখনন স্থল বা মোগলমারি বৌদ্ধ মহাবিহার।
কলকাতা থেকে মোগলমারির দূরত্ব প্রায় ১৬৩ কিমি, রাতের প্রত্নক্ষেত্রটির মায়াবী রূপ সত্যি মুগ্ধ হওয়ার মতো
শুধুমাত্র সড়ক নয় কলকাতা (হাওড়া স্টেশন) থেকে ট্রেনেও পৌঁছানো যাবে মোগলমারিতে। হাওড়া স্টেশনের নতুন প্ল্যাটফর্ম থেকে সকাল ৬.০০টা ছাড়ে ট্রেন নং ১২৮২১ হাওড়া পুরী ধৌলি এক্সপ্রেস। এই ট্রেনটি ধরে খড়গপুর অতিক্রম করে নামতে হবে বেলদা (সকাল ৮টা ১৫মি.) স্টেশনে। বেলদা থেকে নিত্য যাতায়াতের বাস বা গাড়ি ভাড়া করে ১০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে অতি সহজেই পৌঁছান যাবে মোগলমারি প্রত্নস্থলে। মোগলমারি পরিদর্শন করে পাশাপাশি কয়েকটি স্থানও (কুরুম্বেরা দুর্গ, দাঁতন, শরশঙ্কা দিঘি, সূবর্ণরেখা নদীর মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মনোহরপুর রাজবাড়ী, কাকরাজিত প্রভৃতি) পরিদর্শন করে নেওয়া যায়। আর একই দিনে ফিরে যেতে চাইলে ঠিক বিকাল ৫টা ২৫ মিনিটে ট্রেন নম্বর ১২৮২২ ধৌলি এক্সপ্রেসে চাপলেই রাত্রি ৮টা ১৫মিনিটে হাওড়া স্টেশন।
লোকাল ট্রেনে হাওড়া থেকে খড়্গপুর, খড়্গপুর থেকে ওড়িশাগামী ট্রেনগুলিতে চেপে নামতে হবে নেকুড়সেনী স্টেশনে। নেকুড়সেনী থেকে মোগলমারির দূরত্ব মাত্র ২ কিলোমিটার। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও ট্রেন পরিষেবা রয়েছে। নামতে হবে খড়্গপুর স্টেশনে। তারপর খড়গপুর থেকে দাঁতনগামী নিত্য যাতায়াতের বাস, ওড়িশাগামী লোকাল ট্রেন বা গাড়ি ভাড়া করে সহজেই মোগলমারি পৌঁছানো যাবে। খড়গপুর স্টেশন থেকে মোগলমারির দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার।
দেশ বা বিদেশের উৎসাহী পর্যটকরা মোগলমারি আসতে চাইলে প্রথমে নামতে হবে কলকাতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। তারপর উপরে বর্ণিত যে কোন একটি পরিষেবা গ্রহণ করলেই পৌঁছানো যাবে মোগলমারি।
মোগলমারিতে রাত্রিযাপন করতে চাইলে প্রত্নক্ষেত্রের পাশেই রয়েছে থাকার উত্তম ব্যবস্থা। রাতের প্রত্নক্ষেত্রটির মায়াবী রূপ সত্যি মুগ্ধ হওয়ার মতো।
উপসংহার
মোগলমারির সঙ্গে মোগল সাম্রাজ্যের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকলেও এক সময় ঐতিহ্যমণ্ডিত বৌদ্ধ সংস্কৃতি নির্ভর একটি বিস্তীর্ণ জনপদ গড়ে উঠেছিল মোগলমারিতে। শুধুমাত্র বৌদ্ধ মহাবিহার নয়, সমগ্র গ্রাম জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে বৌদ্ধ স্থাপত্যের নিদর্শন, যা এক কথায় অনবদ্য। মোগলমারিতে অতীত ও বর্তমান যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এক সময় এই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো সুবর্ণরেখা নদী। এই নদীকেই কেন্দ্র করে, নদীর বাম তীরে প্রায় ১৫০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল বিহারটি। বর্তমান নদীটি প্রত্নক্ষেত্রটির ৪.৫ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রবাহিত হচ্ছে।
বিহারটির দেওয়ালের বাইরের অংশ কারুকার্যমণ্ডিত নকশাযুক্ত স্টাকোর পলেস্তারা যুক্ত থাকায় এক সময় সূবর্ণরেখার তীরে বিহারটী এক অপরূপ সৌন্দর্য বহন করত। কিন্তু কালের নিয়মে সবই আজ ধ্বংসাবশেষে পরিনত হয়েছে। তবে এখনো যে টুকু অক্ষত রয়েছে তাও কোন অংশেই কম নয়। সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যদিও অনন্য নয়, একদিকে বিহারের দক্ষিণঅংশ এবং অন্য দিকে উড়িষ্যার উত্তর অংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করেছিল সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত মোগলমারি। এভাবে মোগলমারি প্রাথমিক মধ্যযুগে ভারতের পূর্বাঞ্চলে বৌদ্ধ সংস্কৃতির এক ঐতিহ্য বহন করেছিল, যেখানে আজ থেকে কয়েকশ বছর পূর্বে উচ্চারিত হতো সেই পবিত্র মহামন্ত্র ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি ......।’