অসাধারণ, সাহসী ও প্রেমের গল্প 'মান্টো'
সৃজনা মিত্র দাসের চোখে 'মান্টো' ছবি সবদিক থেকেই সুন্দর
- Total Shares
মান্টো: ★★★★★
পরিচালক: নন্দিতা দাস
অভিনয়: নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, রসিকা দুগল,তাহির রাজ ভাসিন, ঋষি কাপুর, পরেশ রাওয়াল, দিব্যা দত্ত, জাভেদ আখতার
ইউ/এ, ১১৬ মিনিট
মান্টো নিখুঁত। মান্টো নিজেও অবশ্যই নিখুঁত ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে যত জন প্রতিভাবান সাহিত্যিক ছিলেন তাঁদের মধ্যে সাদাত হাসান মান্টোই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তিনি যথাযথ মর্যাদা পাননি। তাঁর জীবনী অবলম্বনে যে ছবিটি বানানো হয়েছে তা স্রষ্টা হিসাবে মান্টোকে এবং একই সঙ্গে তাঁর সাহিত্যের ভাষা এবং সুন্দর, বেদনাক্লিষ্ট ও দুরন্ত মনের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানো হয়েছে।
ছবিতে সবাই অসাধারণ অভিনয় করেছেন।
প্রতিটি দৃশ্যে লেখক মান্টোর চরিত্রে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির অভিনয় দক্ষতা দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। মান্টোর চরিত্রের সব ক'টিদিক যেমন তাঁর চঞ্চলতা, তাঁর আবেগ (ইয়াদ হ্যায়, উসনে হমে ফ্রি কা পান দিয়া থা), বাস্তবকে কঠিন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করা এবং হৃদয় জুড়ে ভালোবাসা এই সবকিছুই তিনি অত্যন্ত একাগ্রতা ও মনোযোগের সঙ্গে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মান্টোর চরিত্রে নওয়াজউদ্দিনের অভিনয় একেবারে নিখুঁত। তিনি পেলব ভাবে তাঁর সুদর্শন চিত্রতারকা বন্ধু শ্যাম (তাহির রাজ) ও নিজের স্ত্রী সফিয়ার (রাসিকা) দিকে তাকান তারপর বিস্ময়ে নিজের চারপাশের জগৎটাকে দেখেন। তিনি দেখেন তাঁর চারপাশে বহু দালাল ও যৌনকর্মী নিজেদের চোখ বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। এ ছাড়াও কয়েকজন ধর্ষক ক্লান্ত দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তেমন কয়েকজন মানুষও রয়েছেন সেখানে। জায়গাটা নোংরা এবং রক্ত ও পুঁজে ভরা।
মান্টো একজন চিত্রনাট্যকার যাঁর চিত্রনাট্যে শুধুই দু'ধরণের জগৎ ফুটে উঠেছিল -একটি অন্ধকারময় এবং অন্যটি সুন্দর ঝাঁ চকচকে একটা জগৎ।
সাদাত হাসান মান্টো: মহান এবং সবচেয়ে কম আলোচিত সাহিত্যিক (ছবি: মান্টোর পোস্টার)
তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি, বোম্বেতে মৌলিক লেখকদের একটি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মান্টো। সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ইসমাত চুগতাই যিনি নিজের লেখার সম্বন্ধে খুব একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না, ‘তুমকো ইয়াদ রহে যায়, উতনা তো আচ্ছা থা।" একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে যে একটু স্টুডিয়োতে অভিনেতা অশোক কুমার, সুন্দরী ও তরুণী নার্গিস, কে আসিফ এবং মান্টোর বন্ধু শ্যাম, যিনি একজন বড় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, সবাই বসে 'মোঘল-এ-আজম' ছবিটি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন। জীবনের স্রোতের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে অবশেষে ঢেউ এসে ভাঙে বোম্বেতে। তখন মান্টো নিজের লেখা নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকতেন এবং তাঁর প্রায় সবকটি লেখাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
মান্টো এবং তাঁর স্ত্রী সফিয়ার চরিত্রে অভিনয় অনবদ্য (ছবি:টুইটার)
তারপর ১৯৪৭-এ দেশ যখন স্বাধীনতার দোরগোড়ায় তখন চারদিকে হিংসা ছড়াতে থাকে।
শ্যামের কাকা রাওয়ালপিন্ডি থেকে আসার আগে পর্যন্ত মান্টো বোম্বেতেই ছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে ফিরে এসে শ্যামের কাকা বলেন যে দাঙ্গাকারীরা নৃশংস ভাবে তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে। ঘটনাটি শুনে শ্যাম ঘেন্নায় মান্টোর মুখে থুতু দেয় এবং বলে যে, ‘এখানে যদি কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হত তাহলে আমার হাতে তোমার মৃত্যু হত।"
এই কথা মান্টোর মন ভেঙে দেয় এবং তাঁর জীবনটাই যেন চিরদিনের মতো বদলে যায়। হটাৎই তাঁর মন ভালোবাসার পরিবর্তে রক্ত এবং জন্মসূত্রে পাওয়া জাতিধর্মের চিন্তায় মগ্ন হয়ে ওঠে। এই সব চিন্তা মানুষের মনের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়। কারণ ওই কথা একজন লেখক ও একজন বন্ধুর মনকে একেবারে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল। শ্যাম মান্টোর মনকে চুর্ণবিচুর্ণ করে দিয়েছিল।
তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
লাহোর তো বোম্বে নয়। ১৯৪৮ সালে তখন চারদিকে দারিদ্র, উদ্বাস্তু সমস্যা, স্যঁতস্যঁতে ঠান্ডা, মনখারাপ করা পরিস্থিতি এবং অন্ধকার। মান্টো মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, কিছুতেই তিনি তাঁর চারপাশের কদর্যতাকে কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেন না। ঠিক এই সময় তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখাগুলির কয়েকটা লিখেছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম 'ঠান্ডা গোস্ত'। একজন শিখ ব্যক্তি একটি মুসলমান মেয়েকে ধর্ষণ করে কিন্তু তারপর সেই ব্যক্তি বুঝতে পারে যে মেয়েটির আগেই মৃত্যু হয়েছে। অশ্লীলতার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয় যেখানে তাঁর হয়ে মামলাটি লড়েছিলেন সুট পরা ও ধীর স্বভাবের অধ্যাপক আবিদ (জাভেদ আখতার) এবং বিপক্ষের উকিল ছিলেন ফৈয়াজ।
মামলার শুনানি যতই এগোতে থাকে মান্টো ততই চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং অবশেষে তাঁর মাদকাসক্তির ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যেখানে তিনি তার সর্বশ্রেষ্ঠ এবং পরাবাস্তব লেখাটি লেখেন – 'তোবা তেক সিং'। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আটকে পড়া কয়েকজন উন্মাদ মানুষের কাহিনি। এই কাহিনিতে পুরুষ, মহিলা, পশু, পাখি, গাছপালা প্রায় সবকিছুর যেন ত্রিশঙ্কুর মতো অবস্থা, তারা আটকে নো ম্যানস ল্যান্ডে।
চরিত্রের এই জটিল দিকগুলি নওয়াজউদ্দিন অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। মান্টোর স্ত্রীর চরিত্রে রসিকা দুগলের অভিনয়ও দর্শকের নজর কেড়েছে। অভিনেতা তাহির রাজ তাঁর সৌন্দর্য দিয়ে দর্শকদের মাতিয়েছেন। যে অভিনেতারা ক্যামিও বা ছোট চরিত্রগুলিতে অভিনয় করেছেন তাঁদের অভিনয়ও ছিল অনবদ্য। যেমন একজন দালালের ভূমিকায় লাঠি হাতে পরেশ রাওয়াল, নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার আশায় উন্মাদ হয়ে যাওয়া এক ব্যক্তির ভূমিকায় বিনোদ নাগপালের অভিনয়ও অসাধারণ, কখনও বেশ বিদ্রুপপূর্ণ আবার দুঃখদায়ক ঘটনাও দেখানো হয়েছে। ছবিতে অভিনেতা ঋষি কাপুর এমন একজন প্রয়োজকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যিনি বিভিন্ন ছেলেমেয়েদের স্ক্রিনটেস্ট নেওয়ার অছিলায় তাঁদের নগ্ন হতে বলতেন, "উতারো, উতারো, বড়া চ্যালেঞ্জিং রোল হ্যায়'), অভিনেত্রী দিব্যা দত্ত একজন শিখ মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন যিনি নিজের স্বামীর একটি মৃতদেহকে ধর্ষণ করার অভিজ্ঞতার কথা শোনেন।
পরিচালক নন্দিতা দাস দক্ষতার সঙ্গে মান্টোর সাহিত্যকে খুব সুন্দর ভাবে সিনেমায় উপস্থাপনা করেছেন। ছবিতে লেখকের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক এবং কাল্পনিক গল্পের মোড়কে কঠিন বাস্তবকে তুলে ধরেছেন, ফলত মান্টো আমাদের কাছে আরও অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ছবিতে অসাধারণ সিনেম্যাটোগ্রাফির করেছেন কার্তিক বিজয়। কার্তিক বিজয়ের ক্যামেরায় খুব দক্ষ ভাবে ফুটে উঠেছে পুরোনো দিন। অথচ 'পিরিয়ড ড্রামা' ঠিক যেমন হয়, তেমন ঘোলাটে নয়। তেমনই অসাধারণ এডিটিং করেছেন শ্রীকর প্রসাদ। ছবিটির পরতে পরতে সঙ্গীতের সুচিন্তিত ব্যবহার ও ছবির সংলাপ দুই-ই অসাধারণ। অনবদ্য একটি দৃশ্যে লাহোরের এক যৌনকর্মী একটু চাপা কণ্ঠে মান্টোকে "দে না" বলে তাঁর পকেট থেকে একটি সিগারেট বার করে নেন -অনেকটা বোম্বেতে ভেলপুরি নেওয়ার মতো।
লাহোরে দরিদ্র এবং উদ্বাস্তুদের মধ্যে গিয়ে পড়লেন মান্টোকে (ছবি: স্ক্রিনগ্র্যাব)
মান্টোর জীবনের দারিদ্র, নারীবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার মতো বিষয়গুলিকে যে ভাবে দেখানো হয়েছে তা এক কথায় অনবদ্য। পরিচালক এই বিষয়গুলি দিয়ে তাঁর গল্পটিকে বুনেছেন, পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছেন যে বিষয়গুলি আজকের দিনেও ঠিক কতটা প্রাসঙ্গিক। তাঁর সৃষ্টিতে চিত্রকরের তুলির টান থাকলেও ভাস্করের ছেনির আঘাত নেই। বর্তমান সময়ে যখন সমাজের অবক্ষয় ও শিল্পকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা দুই-ই ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে নন্দিতা দাসের পরিচালনা নিজ প্রভাবে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
একজন আর্ট হাউস পরিচালকের পরিচালনা বলে কাউকে অসম্মান না করে ছবিটি দর্শককে ভাবতে বাধ্য করবে।
মান্টোর মতো গতভাঙা লেখক যাঁকে 'গুলাব কে ফুল' না বলে 'নিম কা পাত্তা' বলে ভূষিত করা হয়, যাঁকে অন্য লেখকদের মতো ফুলদানিতে সাজিয়ে বসার ঘরের শ্রীবৃদ্ধি করা যায় না, যাঁকে এই ইট-কাঠ-পাথরের দুনিয়ায় পথের ধুলোয় দমকা হওয়ায় চিনে নিতে হয় -'তাঁকে' তিনি রুপোলি পর্দায় অসম্ভব বাস্তবোচিত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিদ্রোহী ও বেপরোয়া এবং মানুষ মাত্রই অস্থির ও অসহায় - লেখক মান্টোর চরিত্রের এই দুটি দিকই দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন পরিচালক। ছবিটি দর্শককে এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে বাধ্য করে যা শুধুমাত্র উচ্চমানের সাহিত্যই পারে - কারণ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র মান্টো কখনও এই মেকি বুর্জোয়া সমাজের গতে বাঁধা জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি।
যদিও তিনি মাত্র ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তবে তাঁর চারপাশের আর পাঁচজনের থেকে অনেকবেশি বর্ণময় এবং অর্থপূর্ণ ছিল তাঁর জীবন।
মান্টোর জীবন ছিল অনেক বেশি কঠিন, তিনি বৈঠকখানায় বসে সাহিত্য রচনা করেননি (ছবি: স্ক্রিনগ্র্যাব)
'মান্টো' ছবিটির সবচেয়ে সুন্দর দিক হল প্রেম।
মান্টোকে প্রেম, যাঁদের আমরা ভালোবাসি সেই সব মানুষের প্রতি প্রেম, প্রদেশের প্রতি প্রেম, দেশের প্রতি প্রেম। যে মানুষটিকে সব চেয়ে বড় নির্লজ্জ বলে মনে করা হয় তাঁর শালীনতার প্রতি প্রেম।
লেখালেখির প্রতি প্রেম। এমন মানুষজনকে ভালোবাসা যাঁদের কখনও ভালোবাসা যায় বলে মনেই করেননি কখনও। এদের ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে নতুন কিছু পাওয়া।
আগাগোড়া একটি প্রেমের গল্প 'মান্টো'। তাই দেখুন ছবিটি, আপনার ভালো লাগবে।
তারকাচিহ্নের ব্যাখ্যা:
★ অতি সাধারণ
★★ সাধারণ
★★★ ভালে
★★★★ খুব ভালো
★★★★★ অনবদ্য
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন