মান্না দের সুরে "আমার বলার কিছু ছিল না" গেয়ে বিখ্যাত হন হৈমন্তী শুক্লা

দর্শকাসন থেকে আওয়াজ উঠল, "আপনি আমাদের সকলের আয়ু নিয়ে নিন, কিন্তু বেঁচে থাকুন।"

 |  3-minute read |   30-04-2018
  • Total Shares

অনেকেই হয়ত জানেন না যে মান্না দে কলকাতায় তাঁর শেষ অনুষ্ঠানটি ২০১১ সালে মহাজাতি সদনে করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানটি শেষ করতে পারেননি তিনি। অনুষ্ঠানে মাঝপথে কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ থেকে নেমে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে বলেছিলেন, "সুলোচনাকে (মান্না-দার স্ত্রী) নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত আমি। কে জানে কে ওকে দেখবে?"

সত্তর দশকের শেষের দিকে আমার সঙ্গে মান্নাদার আলাপ। তাঁর সঙ্গে বহু সময় কাটিয়েছি। কিন্তু সে দিন মান্নাদাকে দেখে আমি নিজেই অবাক হয়েছিলাম। এরকম একটা দিলখোলা মানুষের এ কী অবস্থা। আমি যে মান্নাদাকে এত বছর ধরে দেখেছি তিনি হাসতে জানতেন, হাসাতে জানতেন। কিন্তু নিজে কাঁদতে জানতেন না।

মান্না দের কৌতুক রস নিয়ে একটা মজার ঘটনা বলি। আমার একজন চালক ছিল। তাঁর নাম ছিল বৈদ্যনাথ দে। আমি তাঁকে বেঁটে বলে সম্বোধন করতাম। তা, একদিন মান্নাদার সামনে আমি তাঁকে ডেকেছি। বেঁটে কাছে আসতেই মান্নাদা তো অবাক। বললেন, "সে কী তুমি তো আর যাই হোক বেঁটে নও। তোমার নাম কি?" নাম শুনে (পড়ুন পদবি শুনে) মান্না-দা যারপরনাই খুশি। হেসে বললেন, "তুমিও দে, আমিও দে। দে দেখেলেই লোকে বলে, "ওকে টুপি পরিয়ে দে। তাই তো আমি সব সময় টুপি পরে থাকি।"

সঙ্গীত জগতের লোকজন বা সঙ্গীত নিয়ে যাঁরা খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা হামেশাই বলে থাকেন যে মান্না দে খুব বদরাগী। মানছি, উনি খুব অল্পতেই রেগে যেতেন। তাই বলে তিনি কখনও রাগ পুষে রাখতেন না। আসলে কোনওরকম অন্যায় তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। হেমন্তদার (মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে এখানেই তাঁর পার্থক্য। অন্যায় কিছু দেখলে হেমন্তদা তা সমর্থন না করলেও চুপ করে থাকতেন। কিন্তু মান্না দে মুখ খুলতেন।

manna_body2_043018071935.jpgমান্না দে হাসতে জানতেন ও হাসাতে জানতেন, কিন্তু নিজে কাঁদতে জানতেন না

আমার সঙ্গে একবার একটা গণ্ডগোল লেগেছিল। মান্নাদে চেয়েছিলেন আমাকে দিয়ে একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়াতে। কিন্তু অন্য একটা অনুষ্ঠানে যাব বলে আমি আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছিলাম। তাই মান্না-দার পছন্দের অনুষ্ঠানে আমার আর যাওয়া হল না। সেই সময় বাংলার সঙ্গীত জগতের এক ব্যক্তিত্ব নারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। পরে জেনেছিলাম তিনি মান্নাদাকে গিয়ে বলেছিলেন, হৈমন্তী এখন বড় গায়িকা, তাই আপনাকেও পাত্তা দেয় না।" ওই একই ব্যক্তি আবার আমাকে এসে বুঝিয়েছিলেন (ভয় দেখিয়েছিলেন) যে মান্নাদা নাকি আমার উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত। সাহস করে মান্নাদার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। মাস খানেকের মধ্যে মান্নাদার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। এবার সাহস করে তাঁর সামনে গিয়ে পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। বলবার প্রয়োজনও ছিল না হয়ত। কারণ মনে হল মান্নাদা আমার উপর এক ফোঁটাও রেগে ছিল না।

মান্না দা তো শুধু আমার অভিভাবক ছিলেন না। আমার বন্ধুও ছিলেন। তাঁর সুরে "আমার বলার কিছু ছিল না" গেয়েই তো আমি বিখ্যাত হলাম। মান্নাদার কাছে তাই আমি ভীষণ ভাবে ঋণী।

মান্না দে যে দিনের বেশিরভাগ সময়টাই গান নিয়ে থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি গানের সঙ্গে যে ভাবে নিজের জীবনটাকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন তা নিজের চোখে দেখেছি। আমাকে বলতেন, "গানটাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, "যদি কোনও গানে আমি শব্দটি থাকে তাহলে এমন ভাবে গাইবে যেন সেই 'আমি' আসলে তুমি নিজে।" একদিন মান্নাদার সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। আমি আমার গাড়িতে। মান্নাদা অন্য একটি গাড়িতে। হটাৎ হাইওয়েতে একটি বাঁক ঘুরতে গিয়ে বিপজ্জনক ভাবে গাড়িটা উল্টে গেল। অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন মান্নাদা। এর পর তিনি আমার গাড়িতে এসে সামনের আসনে বসলেন। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। হাত দুটি তখনও কাঁপছে। আমাকে বললেন গাড়িতে গান চালিয়ে দিতে। কী আশ্চর্য! গান শুনেই কিছুক্ষণের মধ্যে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলেন তিনি।

কলকাতায় মান্না-দার শেষ অনুষ্ঠানের কথায় আবার ফিরে আসি। সে দিন 'শেষ বিচারের আশায়' গানটি গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষ করতে পারবেন না বুঝে গিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "যদি বেঁচে থাকি আমি আবার আসব।" দর্শকাসন থেকে কয়েকজন বলে উঠলেন, "আপনি আমাদের সকলের আয়ু নিয়ে নিন কিন্তু বেঁচে থাকুন।"

ভেবেছিলাম মানুষের ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখবে মান্নাদাকে। কিন্তু তা আর হলো কোথায়?

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

HAIMANTI SHUKLA HAIMANTI SHUKLA

The writer is a veteran singer.

Comment