শতবর্ষে মান্না দে: স্মৃতিচারণায় গায়িকা আরতি মুখোপাধ্যায়

মান্না দের কোনও ছাত্রছাত্রী ছিল বলে মনে পড়ে না

 |  4-minute read |   30-04-2018
  • Total Shares

বোম্বেতে একটি গানের প্রতিযগিতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মান্না দের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তখন আমি খুবই ছোট, ১৪ কি ১৫ বছর বয়স আমার। ওই প্রতিযোগিতায় আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। মেয়েদের মধ্যে আমি আর ছেলেদের মধ্যে মহেন্দ্র কাপুর প্রথম হই। প্রতিযোগিতায় বিচারকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মান্না দে। সেখানেই আমি মান্না দেকে প্রথমবার দেখেছিলাম। তরপর অনিল বিশ্বাসের বাড়িতে মান্নাদার সঙ্গে ভালো ভাবে পরিচয় হয়।

মান্নাদা খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন, অনেক মজার মজার গল্প বলতেন। যদিও উনি খুব নাম করা একজন বড় শিল্পী ছিলেন, কিন্তু ধরুন যখন মান্নাদা অন্য আর একজন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলতেন, তখন তাঁর কথার মধ্যে কোনও রকম অহঙ্কারের লেশ মাত্র থাকত না। ওঁর স্ত্রীও সুলোচনাবৌদিও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ওঁরা আমার অভিভাবকের মতো ছিলেন আর মান্নাদা আমার পিতৃতুল্য ছিলেন।

যখন গান গাইতাম তখন উনি আমাকে নানা পরামর্শ দিতেন। উনি বলতেন, "আরতি এই জায়গাটা এই ভাবে গাও" বা "আরতি এখানে একটি উপরের সা লাগিয়ে দাও।" ওঁর এই ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগত।

manna1_043018064133.jpgমান্না দে

মান্নাদার সঙ্গে আমি অনেকগুলো সিনেমায় দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছি। বাংলা ও হিন্দি সিনেমা মিলিয়ে কম করে হলেও খান পঞ্চাশেক গান তো হবেই। আমি মান্নাদের করা সুরেও গান গেয়েছি। সেটাও একটা দারুণ ভালো অভিজ্ঞতা ছিল আমার জীবনে।

খুব ছোট বয়সে আমি গানের জন্য বিদেশ সফর করি। অনুষ্ঠানটির আয়োজকরা মান্নাদার থেকে এমন গায়িকার নাম চেয়েছিলেন যে একক কণ্ঠে ও দ্বৈতকণ্ঠে গান গাইতে পারবে। মান্নাদা আমার নাম বলেছিলেন। আমার বাবা খুব ছোট্ট বয়েসে মারা গিয়েছিলেন বলে আমার দাদুই আমাদের অভিভাবক ছিলেন। তাই দাদু আমাকে অত ছোট বয়সে বিদেশ সফরের অনুমতি না দিতে পারে ভেবে মান্নাদা দাদুকে ফোন করে রাজি করান।

বোম্বেতে কাজ করতে গিয়ে অনেকটা সময় আমি ওঁর বাড়িতে ছিলাম আর তখন থেকেই ওঁর পরিবারের সঙ্গে আমার একটা অন্য রকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই অভিজ্ঞতাটাও দারুণ ছিল, আমার আজও মনে পড়ে। উনি খুব নিয়ম মাফিক চলতেন তাই রোজ সকালে মান্নাদা আমাকেও ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি তুলে দিয়ে রেওয়াজ করতে বসাতেন।

manna_body2_043018064256.jpgঅনুষ্ঠানে মান্না দে 

ওঁর গায়কীর একটা স্বতন্ত্র স্টাইল ছিল। মান্নাদা মূলত ক্লাসিক্যাল স্টাইলে গান গাইতে বেশি পছন্দ করতেন। তিনি একজন শিক্ষিত গায়ক ছিলেন, যাঁর গান নিয়ে ছিল বিস্তর পড়াশোনা ও নিয়মিত চর্চা। ওঁর কণ্ঠস্বরটাও একটু অন্যরকম ছিল।উনি খুব অনেক গানে সুরও দিয়েছেন। "কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো" ওঁরই সুর করা গান। যেহেতু ওঁর ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক ছিল তাই ওঁর করা সুরগুলো বেশ অনেক সময় একটু কাছাকাছি হয়ে যেত।

উনি একজন অতুলনীয় গায়ক ছিলেন। গানটা ওঁর কাছে শুধুমাত্র গান নয়, ছিল একটা সাধনার রূপান্তর। উনি নিজের গানের সমালোচনা নিজেই করতেন। ওঁর নিজের গানের যে জায়গাগুলো ভালো লাগত না, আমাদের বলতেন "দেখো তো এই জায়গাটা বোধহয় ঠিক শোনাচ্ছে না, তাই না?" অত বড় মাপের একজন শিল্পীর মধ্যে কিন্তু এই জিনিষটা খুব একটা চোখে পড়ে না।

উনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা কিশোর কুমারের কণ্ঠস্বরে একটা আভিজাত্য ছিল। উনি রোমান্টিক গানগুলো যে ভাবে গাইতে পারতেন, সে ভাবে অনেকেই পারতেন না। এ ছাড়া পাশ্চাত্য ঢঙে যে সব গান তখন তৈরি করা হত, সেগুলোও খুব অনায়াসেই গেয়ে দিতেন, যেমন "হয়ত তোমারই জন্য" কিংবা "জীবনে কী পাব না"।

অনেক সময় এমনও হত যে, সারাদিন হয়ত আমরা শুধু দেশ-বিদেশের নানা শিল্পীর গান শুনেই কাটিয়ে দিতাম। এই অভ্যাসটা কিন্তু আমাদের কানটাকে তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।

মান্না দের কোনও ছাত্রছাত্রী ছিল বলে মন পড়ে না। কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি, কেউ যদি আন্তরিক ভাবে দাদার কাছে কখনও গান শিখতে চাইতেন, তাহলে উনি তাঁকে ফিরিয়ে দিতেন বলে মনে হয় না। তবে উনি খুব ব্যস্ততার মধ্যে থাকতেন সব সময়। শুধু বাংলা বা বোম্বেতেই নয়, উনি নানা ভাষায় গান গেয়েছেন, তাই তাঁকে নিত্য দিনই বিভিন্ন শহরে যাতায়াত করতে হত।

manna3_043018064410.jpgমান্নাদা মূলত ক্লাসিক্যাল স্টাইলে গান গাইতে বেশি পছন্দ করতেন

আমি যখন ওঁর সঙ্গে কোনও দ্বৈতকণ্ঠে গাইতাম তখন উনি আমাকে গানটা আমার মত করে গাইবার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেন। আমরা অল্প বয়সী শিল্পী বলে বা ওঁর চেয়ে অভিজ্ঞতায় কম বলে কোনও সময় দাবিয়ে দিতেন না।

"বেঁধোনা ফুল মালা ডোরে" ওঁর সঙ্গে যখন গেয়েছিলাম তখন উনি আমাকে অনেক জায়গায় পরামর্শ দিয়েছিলেন।

পঞ্চমদার সুরে একটা অত্যন্ত কঠিন গান "আও টুইস্ট করে" দাদা গেয়েছিলেন। আমার মনে হয় সারা ভারতে এই গানটা ওঁর মতো করে আর কেউ গাইতে পারবেন না। আবার দাদরা, ঠুমরি বা টপ্পা অঙ্গের গানগুলোও যে পারদর্শিতার সঙ্গে উনি গাইতেন, সেটা ওঁর মতো করে আর কেউ গাইতে পারত কি না আমার সন্দেহ জাগে। যেমন "ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না"। "ও চাঁদ জোছনাকে বলো আজ চলে যেতে" "ঝনক ঝনক পায়েল বাজে"ও দারুণ ভাবে গেয়েছেন মান্নাদা।

manna2_043018065026.jpgমান্না দে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন

আমার মনে হয় যে ধরণের গান উনি গেয়েছেন আর যত সংখ্যক গান উনি গেয়েছেন সেই তুলনায় বোম্বে হয়ত ওঁকে সম্মানিত করতে পারেনি।

সিনেমার জগতে মান্নাদার সঙ্গে কারও কখনও কোনও মন কষাকষি বা রাগারাগি কখনও দেখিনি। উনি খুব সহজ একজন মানুষ ছিলেন। কোনও অনুষ্ঠানে গেলে আমাদের সঙ্গে অনেক গল্প করতেন। বিদেশ সফরে গিয়ে একবার আমি মঞ্চ থেকে পড়ে যাই তখন বেশ কিছুদিন আমি হাসপাতালেও ভর্তি থাকি, ওই সময় মান্নাদা আর বৌদি আমাকে সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুলেছিলেন। ওঁর মৃত্যুর খবরটা পেয়ে আমি মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম। আমি ভাবতেই পারিনি।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Comment