এখন ব্যয়বহুল বিয়েতে হৈচৈ হলেও আন্তরিকতার বড় অভাব
ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের চল তখন ছিল না, বিয়েবাড়িটাই ছিল গন্তব্য
- Total Shares
একদিন ফেসবুকে কাশ্মীরি বিয়ের একটা সাদা কালো ছবি দেখতে পেলাম।এরপর মেল বক্সে একটা স্প্যাম বা অবাঞ্ছিত মেল দেখে অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। বিয়ে নিয়ে একটি প্রদর্শনী যার নাম- 'বিগেস্ট ওয়েডিং এগজিবিশন অফ দা ইয়ার'।প্রদর্শনীতে যে শুধু সুন্দর করে চুল বাঁধাই ছিল তা নয় দেখার মতো ছিল নানা ধরনের ডিজাইনার ভ্রূ ও হেনার ব্যবহার।আর প্রত্যেকটাতেই ছিল দারুণ সব অফার।
আমার বিয়ের বয়স অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। তাও আমার মনে পড়ে গেল আগেকার দিনের বিয়ের কথা। আগেকার বিয়ে আজকালকার বিয়ের মতো এত পরিকল্পিত ও সাজানোগোছানো হত না। তখন পাকা কথা হওয়ার পর পাত্রীর ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে পাত্রের বাড়িতে পাঠান হত। হবু বৌয়ের ছবি দেখান হত পাত্রের বাড়ির কর্তাব্যক্তিদের। তারপর পাত্রপাত্রীর শিক্ষাদীক্ষা, পারিবারিক ইতিহাস ও আরও খুঁটিনাটি জানতে চলত চিঠি চালাচালি। বিয়ের চিঠির কোণে লাগান থাকত সিঁদুর-হলুদ ও চালগুঁড়ি।এত কিছু হওয়ার পর বিয়ের চিঠিটি যখন হাতে এসে পৌঁছত তখন তাতে সিঁদুর-হলুদ লাগান থাকলেও চালের গুঁড়ো আর থাকত না।
দূরদূরান্ত থেকে যে সব আত্মীয়স্বজন আসতেন তাঁদের আবেগ ছিল চোখে পড়ার মতো।আজকালকার মতো ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের চল তখন ছিল না।এখন লোকে নিজেরদের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোনও সুন্দর জায়গায় বিয়ের অনুষ্ঠান করে। কেউ আর বিয়ের খরচ নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায় না।অনেককেই এখন বিয়ের যাবতীয় খরচপাতি ক্রেডিট কার্ডে মেটায়।যাঁরা দূরদূরান্ত থেকে আসতেন তাঁদের কাছে বিয়ের বাড়িটাই ছিল আসল আকর্ষণ। আজকাল যেমন অনেকে বিয়ের কার্ডের সঙ্গে বাস বা ট্রেনের টিকিটটাও পাঠিয়ে দিচ্ছেন তখন কিন্তু এমনটা হত না। সে সময় বিয়ের খবর আত্মীয়স্বজনের কাছে অনেক আগেই পৌঁছে যেত। তাই বিয়েবাড়িতে যাবেন বলে লোকে অনেক আগে থেকেই কিছু কিছু করে সঞ্চয় করা শুরু করতেন। শুধু একটাই মিল রয়ে গেছে সে যুগ আর এ যুগের মধ্যে - হিন্দি সিনেমার মতো পোশাক পরা। পাইপিং বসান ও সুন্দর নকশা করা ববি ফ্রকটার কথা আমার এখনও মনে আছে। আমার মা খুব ভালো সূচের কাজ করতেন।বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই সেলাই মেশিনের খুটখাট শব্দ শুরু হয়ে যেত। ফ্রক সেলাই করতে করতে আমাকে বারবার জামাটা পরিয়ে দেখতেন ঠিকঠাক হল কি না।
'থিম' বিয়ে এখন নতুন এক চল
সারাদিন সেলাইফোঁড়াই নিয়ে মা এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাদিনে হয়ত একবার একটু চা খাওয়ার সময় পেতেন। মা এত সুন্দর জামাকাপড় বানাতে পারতেন যে আমাদের কখনও রেডিমেড পোশাক কিনতে হয়নি। প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানের আগে মা নিজে হাতে আমাদের জামাকাপড় বানিয়ে দিতেন। আমাদের জামাকাপড় বানিয়ে নিজেও খুব খুশি হতেন তিনি। সেই সময় রান্নাবান্না করে সময় নষ্ট করতেন না তাই সকাল বিকেল আমাদের দুধ-পাঁউরুটি দিয়ে পেট ভরাতে হত।
মনে আছে মা তাঁর দামি বেনারসি শাড়ি কেটে আমাকে জামা বানিয়ে দিয়েছিলেন, আর ভাইকে দারুণ নকশা করা গরম জামা বানিয়ে দিতেন। 'কভি কভি' সিনেমায় যেমন খুব সুন্দর খুব সুন্দর একটা গরম জামা পরে ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, ঠিক তেমন একটা গরম জামা মা আমার ভাইকে বানিয়ে দিয়েছিলেন। নানা রং দিয়ে বোনা নিখুঁত ছিল ওই গরমজামাটা। গরম জামাটার হাতা ও বুকে ছিল দারুণ সুন্দর কাজ। মায়ের সেলাইয়ের মূল্য তখন বুঝিনি। একবার পারভিন বাবির মতো চুল কেটে মা বাড়ি এলেন। তারপর চুল আবার বড় না হওয়া অবধি মায়ের সঙ্গে আমি কথা বলিনি। আর এখন দেখি পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়েরা তাদের দিদিমার সঙ্গে গিয়ে নিজেদের জামার সঙ্গে মিলিয়ে চুল কেটে আসে। দেখে বুঝতে পারি না কে কাকে সাজে হারাবার চেষ্টা করছে?
নর্থ ইস্ট এক্সপ্রেসে চেপে আমরা পৌঁছে যেতাম বিয়েবাড়ি। আত্মীয়-স্বজনের বিয়েতে কখনও গেছি বরেলি, আগ্রা, লখনৌ কিংবা শাজাহানপুরে। বাঁধ ভাঙা আবেগ নিয়ে বিয়ে বাড়ির সবাই যখন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতেন তখন আনন্দে চোখে জল চলে আসত। সেকালের অভ্যর্থনা ছিল একালের থেকে অনেক আলাদা। এখন জমকালো জামাকাপড় পরে আর মেকি হাসি হেসে যে ভাবে লোকে অভ্যর্থনা জানায় তাতে আন্তরিকতা থাকে না। মুখগুলো চেনা, কিন্তু তারা কেউই যেন ঠিক নিজের নয়।
বিয়ে বাড়ির সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার ছিল খাওয়াদাওয়া। বাড়ির মহিলারা রান্না করতেন। একজন রান্নার 'মহারাজ' (ঠাকুর) থাকত। তিনি উনানে ভারী হাঁড়ি-কড়া-ডেকচি চাপাতেন আর নামাতেন। এখনও মনে আছে এক আত্মীয় মায়ের হাতের 'পর্দারশি' (রুমালি) রুটি খুব পছন্দ করতেন। বাপের বাড়ি ছিল লখনৌয়ে, তাই মা এই রুটি সবচেয়ে ভালো বানাতেন।
বিয়ের পাঁচ দিন আগে থেকে বাড়িতে ভিয়েন বসান হত। অনেক দিন ভালো থাকে এমন সব মিষ্টি যেমন লাড্ডু ও বালুশাহী-এই সব অনেক আগে থেকে তৈরি করা হত। ভাঁড়ারঘরে একটা লাল রঙের কাগজে মোড়া ঝুড়িতে রাখা হত মিষ্টিগুলো। কিন্তু আমি ভালোবাসতাম একটা পাঁচ কেজির পাত্রে ভর্তি করে রাখা আখের রসে ডোবানো কাঁচা আমের আচার। এক ধরণের টক জাতীয় আখের রসে ডোবানো হত আমগুলো।
রাঁধুনীদের থেকে আমি কয়েকটা রান্নার খুঁটিনাটি শিখে নিয়েছিলাম। চেটে চেটে দুধের সর খেতাম আর চায়ের সঙ্গে খেতাম আচারের টাকনা দিয়ে গুটকে কচুরি ও মিষ্টি 'মাঠাই' বা মশলাদার মিঠে কচুরির মতো জিনিস ভেঙে চা দিয়ে খাওয়াই হোক বা আচার দিয়ে কচুরি খাওয়াই হোক। সারাদিন ধরে একটা বড় পাত্রে দুধ ফুটতে থাকত আর সেই দুধ দিয়ে দিন-রাত বানান হত চা। অবিরাম দুধ-চা বানান হত বাড়ির লোকজনের জন্য।
আমাদের বাড়ির লোকজন যখন বরযাত্রী যেতেন সেদিন বাড়ির সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ত। নানা সমস্যা হত সেই দিন। কোনও আত্মীয় হয়ত তার জামাকাপড়ের সুটকেসের চাবি হারিয়ে ফেলতেন বা বাড়ির কোন জামাইকে ভালো ভাবে অভ্যর্থনা করা হয়নি বলে তাঁর মুখ ভার থাকত অথবা আমার মা হয়ত তখনও কোনও জামায় বোতাম লাগাচ্ছেন। তারপর কোনও মতে তাড়াহুড়ো করে কোনও বাসে ধরে ট্রেন ধরতে যাওয়া হত। তারপর ঠেলাঠেলি করে ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কামরায় উঠে যাত্রা শুরু করতাম আমরা। ট্রেনে তাস খেলতে খেলতে আর নানা খাবার খেতে খেতে গন্তব্যে পৌঁছতাম। কিন্তু কেউ মদ খেতেন না। বরযাত্রীর বাসটিকে নানা রঙের পতাকা দিয়ে সুন্দর করে সাজান হত। অনেক সময় বাসের গায় বড় করে পাত্রপাত্রীর নাম যেমন - 'রিতা ওয়েডস সঞ্জয়' লেখা হত।
কনের বাড়িতে বরযাত্রীদের গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা করা হত। কিন্তু গাঁদা ফুলের গন্ধটা আমার ভালো লাগত না কেমন যেন মাথা ঘুরত। দুঃখের ব্যাপার হল কোনও দিনও একটা পশমিনা সালও পাইনি। কায়স্থ বিয়ের একটা রীতি হল 'টিকা'। এই টিকার সময় টাকা দেওয়া হত। আমরা এই টাকাটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। তারপর সেই টাকা দিয়ে অর্চনা আর্কেডে গিয়ে আমরা ভিডিও গেম খেলতাম। বিয়ের পর্ব অনেকক্ষণ ধরে চলত বলে বাড়ির বড়রা বালিশে ঠেসান দিয়ে চা এবং ডালমুট খেতে খেতে বিয়ে দেখতেন। আর বাচ্চারা মায়েদের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ত। পরদিন সকালে পুরী, কচুরি, মিষ্টি আর তরকারি খেয়ে বাড়ি ফেরা হত। খাবার গরমকালে সামান্য গরম থাকলেও শীতকালে তাতে জমে থাকত বনস্পতি, কিন্তু সেই খাবারটাও আমরা বেশ মজা করেই খেতাম। আজকাল বিয়ে বাড়িতে খাবারের অনেক স্টল থাকে, কিন্তু তাও যেন বাড়ি ফিরে খিদে পেয়ে যায়।
আজকালকার বিয়ে খুব জমকালো হয়। আজকাল ব্যয়বহুল বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেক হৈচৈ হলেও হৃদয়ের বড় অভাব। আমি হয়ত একটু বেশি ভাবছি তবু আমার মনে হয় বিয়েবাড়িতে জমক আছে আন্তরিকতা নেই।