একদিন কলকাতা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর
ব্রিটিশ জাহাজ লুসিয়ে প্রথম সুইং ব্রিজ পেরিয়ে ডকে ঢুকল ১৮৯২ সালের ২০ জুন
- Total Shares
অন্যান্য পুরোনো বন্দর এবং বন্দর শহরের মতো আজকের শহর কলকাতার ইতিহাসও জল ও ভূখণ্ডের মধ্যে সংঘর্ষ এবং বিনিময়ের ইতিহাস। বাংলার সামুদ্রিক ইতিহাস তাম্রলিপ্তির সঙ্গে শুরু, যার উল্লেখ রয়েছে মহাভারতেও। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর বা তারও আগে থেকে এই ভাগীরথী, পরবর্তীকালে হুগলী নদীর বুকে জাহাজ এসেছে নানা সাম্রাজ্যলোভী দেশের নানা পতাকা উড়িয়ে। কলকাতা বন্দরের পূর্বকাল বলা যায় তখন থেকেই শুরু। তাদের জাহাজ ভিড়ত সপ্তগ্রাম, হুগলি, হিজলী, চন্দননগর, চুচুঁড়াতে। একদিকে ব্যবসা, অন্যদিকে সাম্রাজ্য বিস্তার, এই ছিল উদ্দেশ্য।
আজকের কলকাতা বন্দরকে সেদিনকার তাম্রলিপ্তির উত্তরসূরি বলা চলে, যেদিন, ১৬৯০ সালে মুঘলদের কাছে কিছুটা তাড়া খেয়ে বেনিয়াটোলা আর শোভাবাজারের মাঝামাঝি কোথাও জোব চার্ণক তার ‘মাড্ডাপল্লাম’ নামক ছোট যুদ্ধপোত থেকে অবতরণ করেন , তার মাথায় শহর পত্তন এর ভাবনা ছিল একথা মনে করার বিশেষ কারণ নেই। বরঞ্চ, জাহাজর নোঙর করার একটি নিরাপদ স্থান, তার সঙ্গে সুতানুটির সুতা বা কটনের প্রতি ব্যবসায়িক প্রলোভন এবং হয়ত একটি দুর্গ নির্মাণের উপযোগী জায়গা সন্ধান, এই ছিল তাঁর কলকাতা আবিষ্কারের নৈমিত্তিক কারণ। তাঁর চেষ্টায় না হলেও, ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠে বন্দর এবং দুর্গ, দুইই। বাংলার রেশম, তুলো বস্ত্র প্রভৃতি আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে কলকাতা বন্দর এবং বাংলার বাণিজ্যের সচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামগ্রী। লন্ডন বন্দরের পর কলকাতা বন্দর উঠে আসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বন্দর হিসেবে, সঙ্গে গড়ে ওঠে শহর কলকাতা, আজকের কল্লোলিনী।
ব্রিটিশ জাহাজ লুসিয়ে
অনেকদিন পর্যন্ত কলকাতা বন্দর চলত একটি মেরিন এস্টাব্লিশমেন্ট হিসেবে। বোম্বে, করাচি, রেঙ্গুন ও মাদ্রাজেরও পূর্বে ইংরেজ আইন মোতাবেক জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বন্দরগুলির মধ্যে প্রথম কলকাতা বন্দর। ১৮৭০ সালের ১৭ অক্টোবর এই বন্দরের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা, যদিও পথ চলা শুরু প্রায় দু’শতাব্দী আগে। বন্দরের ওঠাপড়ার ইতিহাস জুড়ে ধ্বংস ও সৃষ্টির উপাখ্যান। এই জোয়ার-ভাটার নদীর ভয়ঙ্কর চপলতা এবং কলকাতায় বিধ্বংসী সাইক্লোনের প্রাত্যহিক তাণ্ডব থেকে কলকাতা বন্দরের ডক সিস্টেমের সূচনা।
জাহাজ বন্দর, অথচ তাদের মাল বা যাত্রী ওঠানো নামানোর নিরাপদ জায়গা নেই। কয়লাঘাট জেটি, আর নদীর মাঝ বরারবর মুরিংস, অর্থাৎ জাহাজ বাঁধার গভীর নোঙর, এ ছাড়া জাহাজ দাঁড়াবার জায়গা ছিল না। ফলে ভয়ঙ্কর ঝড়ের বা উত্তাল জোয়ারের মুখে জাহাজগুলি ছিল নিতান্তই অসহায়। ঝড়ের দাপটে জল থেকে উপড়ে ছোটখাট জাহাজ গিয়ে পড়ত ডাঙায়| ১৮৪২ সাল থেকে যার ভাবনা শুরু, তার রূপায়ণ, অনেকটাই সে সময়কার বাণিজ্যমহল, বিশেষ করে তখনকার কলকাতা চেম্বার অফ কমার্সের তাড়নার ফসল।
কয়লাঘাট জেটি, যা এখন মিলিনিয়াম পার্ক হিসেবে পরিচিত
খিদিরপুরে কলকাতা বন্দরের প্রথম ইমপাউন্ডেড ডকস, অর্থাৎ যেখানে যান্ত্রিক উপায়ে জলের গভীরতা নিয়ন্ত্রিত হয়, চালু হল ১৮৯২ সালে। ব্রিটিশ জাহাজ লুসিয়ে প্রথম সেই লক গেট আর ঘূর্ণায়মান সুইং ব্রিজ (ওয়েস্টউড বেইলি নির্মিত) পেরিয়ে ডকে ঢুকল ২০ জুন ১৮৯২। এর পর থেকে, বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ পর্যন্ত বন্দর দেখেছে বহু উত্থান-পতন, নির্মাণ-বিনির্মাণ, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, হলদিয়ার পত্তন, আরো কত কী!
কোনও এক সময় দেশের প্রায় অর্ধেক বিদেশি বাণিজ্য হত এই কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে। রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এই বন্দর থেকে নানা কারণে পাড়ি দিয়েছেন। তেমনি ভগিনী নিবেদিতা প্রথম কয়লাঘাট জেটি-তে (আজ যেখানে মিলেনিয়াম পার্ক) এসে নামেন ১৮৯৮ সালে।
১৮৩৪ সাল থেকে প্রায় ১৯১৭ সাল অবধি এই বন্দর থেকে লক্ষাধিক মানুষ ভাগ্যান্বেষণে 'কালাপানি' পেরিয়ে চুক্তিমূলক শ্রমিকের কাজে গিয়েছেন মরিশাস, ব্রিটিশ গায়না, মালয়, ত্রিনিদাদ, জামাইকা, পূর্ব আফ্রিকা, সুরিনাম ও ফিজির মতো উপনিবেশে। এই হুগলি নদীর পাড়ে সার দিয়ে ছিল ডিপো, যেখানে বিহার, বাংলা, ত্রিপুরা, ইউনাইটেড প্রভিন্স, এমনকি পঞ্জাব গুজরাট থেকেও শত সহস্র পুরুষ মহিলাকে রাখা হত প্রাক-যাত্রা পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। অনেকেই বিধিনিষেধে আটকে যেতেন।
কলকাতা বন্দরের ক্লক টাওয়ার
"ইনডেনচার্ড লেবার" (বিদেশে প্রেরিত ভারতীয় শ্রমিক) নন, এঁদের অনেকেরই স্থান হত বন্দরের কাজে, বা অন্য কোথাও। বন্দরের আট নম্বর ওয়ার্কশপ, যা এক সময় এশিয়ার সর্ব্ববৃহৎ জাহাজ মেরামতি কারখানা ছিল, তারই তীরে গ্লোবাল অর্গানাইজেশন অফ পিপল অফ ইন্ডিয়ান অরিজিন (জিওপিয়াইও) কলকাতা বন্দর এবং ভারত সরকারের যৌথ স্মারক ইনডেঞ্চের মেমোরিয়াল এবং কিছুদূরে অবস্থিত সুরিনাম মেমোরিয়াল আজ বহু মানুষ দেখতে আসেন। এই বন্দরে ১৯২৭ সালে বৃহত্তর জাহাজ নেওয়ার ব্যবস্থা হয় কিং জর্জের নামে একটি নতুন ডক নির্মাণ করে, তখন তার নাম ছিল কিং জর্জেস ডক, যা নামান্তরিত হয় নেতাজি সুভাষ ডক হিসেবে।
১৯৪৩, যখন এই শহর বন্দর মুহুর্মুহু জাপানি বোমা বর্ষণে বিধ্বস্ত, তখন কলকাতা বন্দর এক রাতের অন্ধকারে প্রায় নিঃশব্দে দু-পারের মানুষের স্বার্থে খুলে দিলেন এ শহর ও রাজ্যের বিমূর্ত প্রতীক, হাওড়া ব্রিজ বা আজকের রবীন্দ্র সেতু। আজ ফেয়ারলি ওয়্যারহাউস, যেখানে বন্দরের মেরিটাইম হেরিটেজ সেন্টার অবস্থিত, তা ছিল স্ট্র্যান্ড রোডের ধারে সার দিয়ে থাকা বন্দরের বিপুলাকায় গুদামের একটি, যার মধ্যে স্থাপত্যে নয়নাভিরাম স্ট্র্যান্ড ওয়্যারহাউস আমরা ২০১০ সালে আগুনে হারিয়েছি।
কলকাতা বন্দরে ইনডেঞ্চের মেমোরিয়াল
কলকাতা বন্দরের অতীত গৌরব তার শক্তির উৎস। খুব সম্প্রতি এই কলকাতা বন্দর, হলদিয়া এবং কলকাতা মিলিয়ে, মাল ওঠানামায় নতুন শিখর ছুঁয়েছে। গত বছর চার হাজারের কাছাকাছি জাহাজ এসেছে বন্দরে। নতুন নতুন দিশায় উদ্যোগী এই বন্দর সর্বপ্রথম চালু করেছে জলে এবং স্থলে ঐতিহ্য সফর। কলকাতাকে যাঁরা চিনতে চান, কলকাতা বন্দরকে তাঁদের ফিরে ফিরে দেখতেই হবে।