কারওয়ান: ইরফানের সঙ্গে একটা অসাধারণ সফরের গল্প
মস্তিষ্কের টিউমার ধরা পড়ার আগে এটাই ইরফানের অভিনীত শেষ হিন্দি ছবি
- Total Shares
হিন্দি সিনেমা জগতে অভিনেতা ইরফানের পদবি আর এখন ব্যবহার করা হয় না। ইরফান খানের ছবি দেখলে তাঁর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়াটা খুব কঠিন। 'পিকু' ছবিটিতে দীপিকা পাড়ুকোন এবং অমিতাভ বচ্চন তাঁর সহযাত্রী ছিলেন।এবার তাঁর সফর সঙ্গী হলেন মালয়লি চিত্রতারকা দুলকার সলমান ও মিথিলা পালকর যিনি বহু ওয়েব সিরিজে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। দক্ষিণ ভারতে একটি রোডট্রিপে ইরফান খানের সঙ্গে এঁদের দেখা হয়। ইরফান খানের অনবদ্য অভিনয় দক্ষতাই ছবিটিকে তাঁর শেষ গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে।
আকর্ষ খুরানা পরিচালিত 'কারওয়ান' ছবিটি দেখলে দর্শকের মনে হবে পরিচালক দিশা হারিয়ে ফেলে ছবিটি মূল চিত্রনাট্য থেকে সরে গেলেও ছবিটিকে তার মূল চিত্রনাট্য অনুসরণ করে একটা ঠিকঠাক সমাপ্তি দেওয়ার কাজটা ইরফান খান নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়েছেন। তার মানে এই নয় যে ছবিতে সলমন এবং পালাকর দর্শকের মন জয় করতে পারেনি বরং সলমানের একজন আত্মভোলা যুবকের চরিত্রে অভিনয়টা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। ইরফান যতগুলো হাস্যকৌতুক চরিত্রে অভিনয় করেছেন সেই তালিকায় এবার শওকত নামটিও যুক্ত হল। ছবিতে ইরফানের চরিত্রের নাম শওকত। ছবিতে তাঁর হাস্যরস বোধ ও জীবনের প্রতি তাঁর একটা অদ্ভুত নিরীক্ষণ শক্তি দিয়ে দর্শকে মাতিয়ে রাখে। হাস্যরসের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় দক্ষতা এর আগেও আমরা পিকু, গুণ্ডে, হিন্দি মিডিয়াম এবং করিব করিব সিঙ্গেল ছবিতে দেখেছি।
'কারওয়ান' ছবিটিতে তিনজনের মধ্যে শওকত বয়সে বড়। নিজের ধর্ম তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাঁর জীবনের সবটাই তাঁর ধর্মকে ঘিরে। নিজের বন্ধু অবিনাশকে (সলমন) একটা অদ্ভুত সমস্যার হাত থেকে বাঁচাতে ব্যাঙ্গালোর আসে শওকত। অবিনাশের পিতার মৃত্যু হলে সেই মৃতদেহ অবিনাশের কাছে না এসে ভুল করে চলে যায় কোচি শহরের কোনও একটি পরিবারের কাছে আর সেই পরিবারের মৃতদেহ ভুল করে চলে আসে অবিনাশের কাছে। তাই অবিনাশকে নিজের পিতার মৃতদেহ নিয়ে আসতে হবে এবং ওই পরিবারকে তাঁদের মৃতদেহ দিয়ে আসতে হবে। তাঁরা শওকতের নীল রঙের ভ্যানে যাত্রা শুরু করেন সঙ্গে শওকতের অনর্গল বকবক ছবিটির যেন নেপথ্য সঙ্গীতের কাজ করেছে।
চিত্রনাট্যটি যৌথ ভাবে খুরানা এবং অধীর ভট লিখেছেন। তাঁরা ছবিটিতে শুধুমাত্র প্রধান চরিত্রটিকেই বড় করে দেখতে চাননি। শওকত একজন বেশ রক্ষণশীল মানুষ এবং ছবিতে তানিয়া যে বেশ খোলামেলা পা না ঢাকা পোশাক পড়ে ও মদ্যপান করে সেটা শওকত পছন্দ করেন না। বিশেষ কয়েকজন মানুষের বিরুদ্ধে সে একটা অন্যরকম মনোভাব পোষণ করেন, বিশেষ করে সাদা চামড়ার মানুষদের। ছবিতে তিনি ঠাট্টা করে বলেন সাহেবরা মাদকদ্রব্য আসক্ত এবং তাঁরা একসময় আমাদের দেশে রাজত্ব চালিয়ে গেছে। শওকতের একটা নিজস্ব মতামত আছে। তিনি অবিনাশ এবং তানিয়ার কয়েকটি কার্যকলাপ সহ্য করতে না পেরে তাঁদের মাঝে মধ্যেই জ্ঞান দেয়।
অন্যদিকে দর্শকের কাছে অবিনাশের চরিত্রটি একটু ধোঁয়াশা রয়ে গেছে তাঁরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি যে কেন এই চরিত্রটা এমন। কারণ তাঁর চরিত্রের খুঁটিনাটি তেমনভাবে ছবিতে দেখানো হয়েনি। বরং বেশি নজর দেওয়া হয়েছে শওকতের চরিত্রের দিকে। ছবিতে শওকত একজন হাস্যরসিক মানুষ। তবে ছবিটার একটা দুর্বল দিকও রয়েছে। অবিনাশের মতো শওকতের জীবনেও একজন কড়া পিতার প্রভাব রয়ে গেছে এবং তাঁরা দুজনেই সেই বিষয়টা নিয়ে বারবার কথোপকথনও করেন। কিন্তু এই সব ছোটোখাটো ত্রুটি ইরফান খানের অভিনয় দক্ষতার সাহায্যে ঢাকা পড়ে গেছে। ছবিতে বাকি দুজন খানিকটা হিন্দি এবং খানিকটা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেছে কিন্তু শওকত হিন্দিতে কথা বলেছে তাই সে দর্শকের কাছে অনেক বেশি আপন হয়ে উঠেছে।
ছবিটির সংলাপ লিখেছেন হুসেন দালাল। ছবিটির ট্রেলার দেখলে বোঝা যাবে যে শওকতের সংলাপগুলো বোধহয় খুব যত্নসহকারে দালাল লিখেছেন। শওকতের সংলাপ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ছবিটিতে হাসিঠাট্টা ছাড়াও রয়েছে মৃত্যু এবং বিয়োগের যন্ত্রণা। দুঃখের অংশগুলো বোধহয় একটু কম নাটকীয় করে দেখানো হলে ভালো হত, কারণ ছবিটি দেখতে দেখতে বিশেষ করে দুঃখের অংশগুলো দেখলে ইরফান খানের বর্তমান অসুস্থতা এবং অসুখের সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের কথা মনে পড়ে যায়।
মস্তিষ্কে নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার ধরা পড়ার আগে এটাই তাঁর অভিনীত শেষ হিন্দি ছবি। এছাড়াও 'পাজল' নামে আরেকটি ছবি দর্শক দেখতে পাবেন। এই ছবিটিতে তিনি একজন বিপত্নীকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন যাঁর সঙ্গে একজন বিবাহিত মহিলার পরিচয় হবে (কেলি ম্যাকডোনাল্ড)। এঁরা দুজনেই বিভিন্ন ধাঁধার সমাধান করতে ভালোবাসেন।
কারওয়ান ছবিটিতে শওকতের নীল রংয়ের ভ্যানের উপরে মজরু সুলতানপুরীর একটি গানের একটি অংশ লেখা রয়েছে:
“ম্যা আকেলা হি চলা থাকা জানিব-এ-মঞ্জিল
লোগ আতে গয়ে অউর কারওয়ান বনতা গয়া"
ইরফান যে যাত্রাটা শুরু করেছেন তাতে তিনি একা নন তাঁর পাশে রয়েছে তাঁর সব অনুরাগীরাও এবং তাঁরা সব সহকর্মী। সবার একটাই প্রার্থনা যে ইরফান খান যেন খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারেন এবং আবার কাজের জগতে ফিরতে পারেন। লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের আনথেমের একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করে দিলাম, “তুমি তোমার যাত্রায় একা নও” (You’ll never walk alone)।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন