আমরা হাসি কেন, সেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুকুমার রায় স্বয়ং
আমরা কখনও মুচকি হাসি, কখনও প্রাণখুলে হাসি, আবার অট্টহাসিও হাসি
- Total Shares
হাসছি কেন কেউ জানে না
পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই।
হাসি নিয়ে এমন সরল এবং গভীর রচনা সুকুমার রায়ের পক্ষেই বোধহয় করা সম্ভব। আহ্লাদী কবিতায় তিনি নানা ধরনের হাসির কথা লিখছেন।
পাচ্ছে হাসি চাইতে গিয়ে
পাচ্ছে হাসি চোখ বুজে
পাচ্ছে হাসি চিমটি কেটে
নাকের ভিতর নোখ গুঁজে।
আমরা যেমন বলি পেটের ভিতর থেকে হাসি গুলিয়ে উঠছে, তার বর্ণনাও দিয়েছেন সুকুমার রায় এই কবিতাতেই—
উঠছে হাসি ভসভসিয়ে সোডার মতো পেট থেকে।
সুকুমার রায়ের আহ্লাদি
আহ্লাদী না হয়ে কেউ গোমড়ামুখে থাকলে আমরা তাঁকে রামগরুড়ের ছানা অথবা হুঁকোমুখো হ্যাংলা বলি, সেটাও সুকুমার রায়েরই অবদান। হাসি ছাড়া কোনও মানুষই বোধহয় বাঁচতে পারে না, এই হাসি হতে পারে সুখের, হতে পারে দুঃখের আবার হতে পারে গভীর শোকের মধ্যে এক টুকরো আলোর মতো। যেমন রাম যখন বনবাসে সীতাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে রাজি হলেন তখন কৃত্তিবাস লিখছেন,
এতেক শুনিয়া সীতা হরিষ অন্তরে।
খুলিলেন অলঙ্কার যে ছিল শরীরে।।
আমরা কখনও মুচকি হাসি, কখনও প্রাণখুলে হাসি, আবার অট্টহাসিও হাসি। অবহেলা-অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্যের হাসি তো হেসেই থাকি। যেমন ভোঁদড় বাহাদুরে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন,
শেয়াল হো হো করে হেসে উঠে বলল, “তোমাদের সাধ্য কী যে ওদের এখান থেকে নড়াতে পার।...”
আবার এই ভোঁদড় বাহাদুরেই অতি সহজে কোনও কাজ সম্পন্ন করাকেও গগন ঠাকুর বর্ণনা করেছেন ...এই সুযোগে রাক্ষস নিচুয়াকে বগলদাবা করে এক লাফ মেরে তোমাদের তেঁতুল গাছের উপর পড়ল—তারপর সেখান থেকে বিকট রকম চিৎকার করে হাসতে হাসতে আরেক লাফে গঙ্গা পার হয়ে কোন দিকে যে চলে গেল...
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসার একাংশ
ভয় ঢাকতেও অনেক সময় আমরা ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখি, যেমন কমলা নাপিত গল্পে: হেসে বল্লে কমলা নাপিত, “আমি বাঘের চাঁই, বাঘের ঘাড়ে চড়ি আর সিংহ ধরে খাই।”
হাস্যের সঙ্গে পরিহাসও যুক্ত। বিলাসব্যসেনর সঙ্গেও যেন এর যোগ আছে। যেমন মাহিষ্মতীর রাজ্যের চন্দ্রবংশীয় রাজা কার্তবীর্যার্জুনের কাছে দূত গিয়ে যখন জানালেন রাবণ তাঁকে যুদ্ধে আহ্বান করছেন, তার বর্ণনা দেওয়ার সময় কবি রামায়ণের কবি বলছেন,
স্ত্রী লইয়া করে রাজা হাস্যপরিহাস।
তোর বাক্যে কেন আমি যাব তার পাশ।।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুমারসম্ভবের কবি রচনায় হাস্যরসের বিপুল উপাদান আছে, কিন্তু সেখানে কালীদাসের ভূমিকা অনেকটা ভাঁড়ের মতো, কিন্তু পরিবেশনার গুণে সেটি অন্য মাত্রা পেয়েছে। হাসির মধ্যেও আবার মাত্রাগত পার্থক্য রয়েছে। গোপাল ভাঁড়ের গল্প ও বীরবলের গল্পের মধ্যে যে পরিবেশনগত পার্থক্য রয়েছে, হাসির মধ্যেও সেই পার্থক্য রয়েছে।
মুচকি হাসা আর অট্টহাসির মধ্যে আরও নানা ধরনের হাসি রয়েছে। যেমন খিলখিল করে হাসা, খিক খিক করে হাসা, হাহা করে হাসা, মুচকি হাসা, ফিক করে হাসা, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হাসা, মন খুলে হাসা এমন আরও কত রেয়েছে। মানুষ দুঃখেও হাসে। গানের ভাষায়,
এমন হাসিয়াছে
বেদনা মনে হয়
জলে ভরে দুনয়ন,
সুখেও কেঁদে ওঠে মন
ত্যাগের মধ্যে যে হাসি যে অনন্য, তা বোঝা যায় রবি ঠাকুরের রচনায়।
সুকুমার রায়ের রামগরুড়ের ছানা
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে
জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়
হাসিতে হাসিতে আলোক সাগরে
আকাশের তারা তেয়াগে কায়
মোনালিসার হাসি আজও যেন রহস্যে মোড়া। সব হাসির কারণ জানা যায় না। বরং বিশ্ব হাসি দিবসে হাসি নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা ছেড়ে প্রাণ খুলে হাসুন।