প্রভাকরণের এলটিটিই-র কাছেও অস্ত্র তৈরির তালিম নিয়েছে কিষেনজির মাওবাদীরা

অবাক হয়ে দেখলাম বন্দুক ছাড়াও প্রতিটি স্কোয়াড সদস্যর হাতে একটি করে টিফিন কেরিয়ার রয়েছে

 |  3-minute read |   09-05-2018
  • Total Shares

২০০৪ সালের কথা।ইন্দ্রাবতী নদী পেরিয়ে ছত্তিসগড়ের অবুঝমারো অঞ্চলে ঢুকেছি। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা এই সবুজ অঞ্চলটিকে এক ঝলক দেখলে মনে হবে বুঝি বিদেশের কোনও পর্যটনকেন্দ্রের পোস্টকার্ড। তবে এই পার্বত্য -জঙ্গলে সাধারণ মানুষের প্রবেশ কিন্তু অবাধ নয়। সাধারণ মানুষ তো দুরস্ত, কেন্দ্রীয় সরকারকেও মানতে নারাজ এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। এ হলো মাওবাদীদের রাজ্য। প্রায় কুড়ি হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের জন্য এখানে জনতানা সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন মাওবাদীরা।

মাওবাদী সৈনিকদের বেশ কিছু বিভাজন রয়েছে। একেবারে প্রথম সারিতে যাঁরা থাকেন তাঁদের 'মিলিশিয়া' বলা হয়। এদের কেউই ইউনিফর্ম পড়েন না। সাধারণ পোশাকে একেবারে সাদামাটা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এরা মাওবাদী এলাকার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো পাহারা দেন। নদীর অন্য পার থেকে এক দল মিলিশিয়া আমাদের পথ দেখিয়ে এই গ্রামে নিয়ে এসেছে। পড়ন্ত বিকেলে আমাদের একটি মাটির বাড়ির উঠোনে খাটিয়া পেতে বসতে দেওয়া হয়েছে।

কিছুক্ষনের মধ্যে এক 'স্কোয়াড' মাওবাদী সেখানে উপস্থিত হলো। স্কোয়াড হলো মাওবাদী সৈনিকদের দ্বিতীয় ধাপ। স্কোয়াডের সদস্যরা ইউনিফর্ম পড়েন। গেরিলা যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণও তাঁদের রয়েছে। মাওবাদী এলাকার দুর্বেধ্য অঞ্চল গুলোতে প্যাট্রলিং করে এই স্কোয়াডের সদস্যরা। আমরা (আমার সঙ্গে আর একজন চিত্রগ্রাহকও ছিলেন) যে উঠোনে বসে ছিলাম সেখানে এসে তাঁরা তাঁদের অস্ত্র নামিয়ে রাখলেন। আমি খুব অবাক হয়ে দেখলাম প্রতিটি স্কোয়াড সদস্যর হাতে একটি করে টিফিন কেরিয়ার রয়েছে। কয়েকজনের কাছে আবার দুটো কি তিনটে করে টিফিন কেরিয়ার রয়েছে। কিছুটা অবাক হলেও, পরে ভাবলাম যে সারাদিন ধরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় তাঁরা। তাই হয়ত সারাদিনের খাবার তাঁদেরকে সঙ্গে করে নিয়েই ঘুরতে হয়।

body_050918051626.jpgছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের প্রশিক্ষণ শিবির

ওই অঞ্চলে মাওবাদীদের জীবনধারা কী রকম তাই সরজমিনে দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। আমাদেরকে অঞ্চলটা ঘুরিয়ে দেখবার দায়িত্ব ছিল মাওবাদীদের এক এরিয়া ডিভিশনাল ম্যানেজারের উপর। কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি উপস্থিত হলেন। খোশ গল্প শুরু হলো। কৌতূহলবশত আমি টিফিন কেরিয়ারগুলো দেখিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম "সারাদিন ধরে স্কোয়াড সদস্যরা কী কী খায়।"

আমার কথা শুনে সেই এরিয়া ডিভিশনাল ম্যানেজার হেসে ফেললেন। আমাকে একটি টিফিন কেরিয়ার তুলে আনার নির্দেশ দিলেন। আন্দাজ করেছিলাম ভিতরের খাবার শেষ এবং তাই ফাঁকা টিফিন কেরিয়ারগুলো অপেক্ষাকৃত হালকা থাকবে। কিন্তু তুলতে গিয়ে বুঝলাম এগুলোর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি। কেরিয়ারটি উল্টে দেখি তলা দিয়ে একটি কালো সকেট বেরিয়ে আছে। এরিয়া ডিভিশনাল ম্যানেজার এবার জানালেন যে এগুলোকে ডিরেকশন্যাল অ্যান্টি পার্সোন্যাল মাইন বা বলে ক্লেমর মাইন বলে।

এই প্রযুক্তি মাওবাদীরা কোথায় শিখলেন?

body1_050918051717.jpgএলটিটিই-র কাছে অস্ত্র তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছিল মাওবাদীরা

শুনলাম প্রভাকরণের এলটিটিই-র সদস্যরাই মাওবাদীদের এই প্রযুক্তি শিখিয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নর্মান ম্যাকলয়েড এই প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী কোরীয় যুদ্ধের সময় প্রথমবার এই মাইন ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তির বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে।

এক, জোলো জমিতেও এই মাইগুলো নষ্ট হয়না। এই মাইনগুলোতে এক ধরণের মেটাল বল ব্যবহৃত হয় যার সাহায্যে বিস্ফোরণ স্থলের ১০০ মিটার রেডিয়াস জুড়ে বিস্ফোরণের প্রভাব থাকে। দৈন্দদিন জীবনে ব্যবহৃত বহু জিনিসের (যেমন টিফিন কেরিয়ার, বাক্স বা পোস্টার বা প্যামফ্লেট) আকারে এই মাইন তৈরি করা যায় যা ২০০ মিটার দূর থেকেও এই মাইন সক্রিয় করা যায়। সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন, এই প্রযুক্তি খুব কম খরচেই তৈরি করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন, সার্বিয়া, ফ্রান্স ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই প্রযুক্তি নকল করে। এই দেশগুলোর মধ্যে কোনও একটি দেশ থেকে এলটিটিই এই প্রযুক্তি তৈরির প্রশিক্ষণ লাভ করেছিল। ২০০২ সালে কোট্টেশ্বর রাও ওরফে কিষেনজি মাওবাদী মিলিটারি কমিশনের মাথা ছিলেন। তখনই এলটিটিই জঙ্গিদের কাছ থেকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার মাওবাদীরাও শিখে নেয়।

২০০৩ সালের অক্টোবর তিরুমালা ঘাট রোডে চন্দ্রবাবু নাইডুর কনভয় লক্ষ করে প্রথমবার ক্লেমোর মাইনের ব্যবহার করে মাওবাদীরা। সেই ঘটনায় অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের ঝিটকার জঙ্গলে বা বান্দোয়ানেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন মাওবাদীরা।

রবিবার সন্ধ্যেবেলা খবর পেলাম যে কলকাতা পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছেন। এরা ইচ্ছাপুর রাইফেল কারখানা থেকে অস্ত্র পাচারের সঙ্গে জড়িত। সরকারি অস্ত্র কারখানা থেকে পাচার হওয়া এই অস্ত্র নাকি বিহার হয়ে মাওবাদীদের হাতে চলে যায়।

খবর শুনতে শুনতে আমার মন চলে গেল ইন্দ্রাবতী নদীর তীরে ওই ছোট্ট পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা গ্রামটিতে। যেখানে আমি স্বচক্ষে সারি সারি ক্লেমোর মাইন দেখে এসেছিলাম। এলটিটিই-র কাছ থেকে শিখে যখন তা পুরোপুরি 'মেক ইন ম্যাওল্যান্ড পণ্য'।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

BISWAJIT BHATTACHARYA BISWAJIT BHATTACHARYA

Veteran journalist. Left critic. Political commentator.

Comment