আরবান নকশাল শব্দবন্ধের উৎপত্তি হল কী ভাবে
মাওবাদীদের ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশনগুলোর তালিকা বানায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক
- Total Shares
'আরবান নকশাল' -- এই শব্দবন্ধ নিয়ে এখন দেশে তোলপাড় হচ্ছে। ভীমা কোড়েগাঁও হিংসার জেরে কয়েকমাস আগে দেশের প্রতিষ্ঠিত সমাজকর্মী ও অধ্যাপিকা মিলিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছিল মহারাষ্ট্র পুলিশ। সেই গ্রেফতারির জের ধরে এ বার গ্রেফতার করা হল সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা ও ভারাভারা রাও-সহ পাঁচ মেধাজীবী সমাজকর্মীকে। এই গ্রেফতারির সূত্রেই আরবান নকশাল শব্দবন্ধটি পুলিশের মুখে শোনা যাচ্ছে।
গ্রেপ্তারির পরে ভারাভারা রাও (ফাইল চিত্র)
এই শব্দবন্ধ ও গ্রেফতারির প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষ, রামচন্দ্র গুহ, অরুন্ধতী রায়, রোমিলা থাপার, প্রভাত পট্টনায়কদের মতো দেশে ও বিদেশে খ্যাতি কোড়ানো মেধাজীবীরা সরব হয়েছেন। এই 'আরবান নকশাল' শব্দটি হঠাৎ পুলিশের অভিধানে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এর ভিত সম্ভবত তৈরি হয়েছিল ইউপিএ সরকারের আমলে চিদম্বরম যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন।
২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রিপোর্টে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ বলে মাওবাদীদের চিহ্নিত করেছিলেন। তার আগে ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৬৭ সালে আনলফুল অ্যাক্টিভিটি (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট-কে জোরালো করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। এই আইনটি ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলার পর ২০১২ সালে সংশোধিত হয়েছিল। এই আইনে সংশোধন করে সন্ত্রাসবাদী কাজের সংজ্ঞার পরিধি বাড়ানো হয়েছিল। তাতে যোগ হয়েছিল আর্থিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিপদ, জাল নোট তৈরি করা, অস্ত্র সংগ্রহ করা।
২০১২ সালে সংসদীয় কমিটিকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব জানিয়েছিলেন, এই সংশোধনীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের ফাইনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)-- যা জঙ্গিদের আর্থিক জোগান ও মানি লন্ডারিং রুখতে কাজ করে -- তাকে আরও শক্তিশালী করা।
এ বারও যে সমাজকর্মীদের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি আনা হয়েছে— তার মধ্যে মাওবাদীদের অর্থ জোগানোর অভিযোগও রয়েছে।
চিদম্বরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময়ই নগর ও শহরাঞ্চলে কারা মাওবাদীদের সাহায্য করছে, কোন সংগঠনগুলি মাওবাদীদের ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশন হিসাবে কাজ করছে তার তালিকা তৈরি করেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। সেই তালিকাতেও পিইউসিএলের (পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবারেটস) মতো বহু মানবাধিকার সংগঠনের নাম ছিল। এমনকী কয়েক দশক ধরে যে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন ভোটে লড়ে আসছে তাদেরও নাম ছিল এই তালিকায়। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলির সেই তালিকায় নাম থাকলেও এই ভাবে ধরপাকড়ের পথে যায়নি ইউপিএ সরকার।
নকশালপন্থী আন্দোলন সত্তরের দশকের প্রথমার্ধ্ব থেকেই গতি হারাতে শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর নকশালপন্থীরা বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে যান। চারু মজুমদারের নির্দেশিত পথেই অন্ধ্রপ্রদেশে কোন্ডাপল্লি সীতারামায়া পিপলস ওয়ার বা জনযুদ্ধ গোষ্ঠী তৈরি করেন। চারু মজুমদারের মতোই সীতারামায়াও জনযুদ্ধের সংগঠন তৈরি করতে ছাত্র-যুবদের উপরেই ভরসা রেখেছিলেন।
চারু মজুমদার (ফাইল চিত্র)
এই মাওবাদী সংগঠন নকশালবাড়ি আন্দোলনের দুর্বলতা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে। সেই আলোচনায় চারু মজুমদার লাইনের যে বিচ্যুতি উঠে এসেছিল, তা হল গণসংগঠন ছাড়াই বৈপ্লবিক কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ধারনা। সীতারামায়ারা মনে করেন, বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মজবুত গণসংগঠন গড়ে তুলতে হবে। সেই লক্ষ্যে তৈরি হয় রেভোলিউশনারি রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন, জননাট্যমণ্ডলী, র্যাডিক্যাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, র্যাডিক্যাল ইউথ লিগ ও রায়তু কুলি সঙ্গমের মতো শাখা সংগঠনগুলি।
১৯৬৭ সালের ২২ মে উত্তরবঙ্গের তরাই এলাকার নকশালবাড়িতে ১৮ জন কৃষক, মহিলা ও শিশু পুলিশের গুলিতে নিহত হন। কৃষকদের তিরে মৃত্যু হয়েছিল পুলিশ ইন্সপেক্টর সোনম ওয়াংডির। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার। এই সরকারের শাসনে কোনও বিপ্লবী রূপান্তর সম্ভব নয়। তবে এই সরকার হয়তো জনগণের সুখ-সুবিধার জন্য সামান্য হলেও কিছু করবে, এই প্রত্যাশা ছাত্রদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল।
নকশালবাড়ির ঘটনার পর রাজ্যের ছাত্রদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছাত্র ফেডারেশনের ছাতা ছেড়ে কৃষকবিদ্রোহের সমর্থনে নেমে পড়েছিল। গড়ে উঠেছিল পাল্টা ছাত্র ফেডারেশন। চারু মজুমদারের লেখাপড়া ছেড়ে দাও বিপ্লবের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়, যে যত বই পড়ে সে তত মূর্খ হয় ও চেয়ারম্যানের চিন আক্রান্ত হতে পারে বিপ্লবের কাজ ত্বরাণ্বিত কর – এই ডাকে ছাত্রসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই ছাত্রসমাজের ৯০ শতাংশই ছিল নগর ও শহরাঞ্চলের বাসিন্দা। ফলে নকশালবাড়ি আন্দোলনের জন্মলগ্নে আরবান নকশালদের বড় ভূমিকা ছিল। এবং পরিহাসের বিষয় হচ্ছে গ্রাম ও কৃষকসমাজ সম্পর্কে ধারণাবিহীন এই ছাত্রসমাজই নকশালবাড়ি আন্দোলনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তেমনই খুব তাড়াতাড়িই দিশা হারিয়ে ফেলেছিল। আজ অবশ্য আরবান নকশাল বলে যাঁদের বেগ দেওয়া হচ্ছে তাঁরা ছাত্র বা যুব সমাজের প্রতিনিধি নন, তাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছাত্রদের দিশা হারানোর মূল কারণ ছিল সঠিক রাজনীতির অভাব। তার জন্যই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এসেছিল।
নামের উৎপত্তি এখান থেকেই (ডেইলিও)
চারু মজুমদারের গণসংগঠন ছাড়া চারু মজুমদারের এই লাইনের সমালোচনা করেছিলেন কানু সান্যাল, সুশীতল রায়চৌধুরী, শৈবাল মিত্রের মতো নকশালপন্থী নেতারা। সীতারামায়া সেই সমালোচনা থেকেই যে লাইন তৈরি করেছিলেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। তবে সেই পথে এগতে গেলে গণসংগঠনের শক্ত ভিত গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই লক্ষ্য থেকেই নগর ও শহরাঞ্চলে মাওবাদী আন্দোলনের প্রচার ও জনসমর্থন আদায় করার জন্য এই সংগঠনগুলি কাজ করবে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই ইউপিএ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদম্বরম মানবাধিকার সংগঠনগুলির দিকে নজর দিয়েছিলেন। সেই সময়েও সরাসরি আরবান নকশাল তকমা না এলেও শহর ও শহরতলিতে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীরা কেন্দ্রের নিশানায় ছিল।
উপস্থাপনামূলক ছবি (ফাইল চিত্র)
মানবাধিকার সংগঠনগুলির সঙ্গে সরকারের বিরোধ অনেক পুরোনো। অনেক সময়ই দলিত, আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষজনের পক্ষ নিয়ে লড়তে গিয়ে তাঁরা সরকারের রোষে পড়েছেন।
দীর্ঘ সময় ধরে বামপন্থী রাজনীতি কভার করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যেখানে যাঁরা প্রান্তিক মানুষের জন্য লড়াই করেন, এই ধরনের সংগঠনের কর্মীরা তাঁদের সমর্থন করেন কিন্তু তাঁদের হিংসাত্মক কাজকে সমর্থন করেন না। আমার যেমন ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, আদিবাসীপ্রধান অঞ্চলে জল-জঙ্গল-জমি বাঁচানোর জন্য এবং সঠিক মজুরি আদায়ের জন্য লড়াই করা প্রসংশনীয় কিন্তু গণশত্রু বলে নির্বিচারে হত্যা নিন্দনীয়।
কোনও মেধাসম্পন্ন মানুষই বিশ্বাস করতে পারেন না, ভারতের মতো একটি বৈচিত্রপূর্ণ দেশে কোনও একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় দেশের সব মানুষ দাঁড়িয়ে একযোগে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়বে। তেমনই সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াই এই শতাব্দীতে হাস্যকর। যাঁরা এই লাইনের প্রবক্তা তাঁরা আর যাই হোন মেধাসম্পন্ন হতে পারেন না।