কম বাজেটে কেমন করে থিম বানান শিল্পীরা
কলসের নীচে জলের এফেক্ট কাগজ দিয়ে, খরচ কমাতে অরিগ্যামী পদ্ম
- Total Shares
থিম নিয়ে যখন আমি চিন্তা করি তখন প্রথমেই দেখে নিই যে কতটা জুড়ে সেই মণ্ডপ হবে, মণ্ডপটি কেমন জায়গায় – রাস্তার উপরে নাকি পাড়ার মধ্যে। সেটা দেখেই ভাবি কেমন থিম করা যায়। তিন ভাবে আমরা কাজ করে থাকি। প্রখমত নিজেই নিজের মতো করে ভেবে তাকে রূপদান করা। দ্বিতীয়ত কোনও পুজোকমিটির হয়তো কোনও ভাবনা আছে। সেটা শুনে, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে রূপদান। আরেকটি হল কোনও সহশিল্পীকে তাঁর থিমে রূপদানে সহায়তা করা বা ভাবনার ক্ষেত্রে সহায়তা করা।
কাজ চলছে মণ্ডপে (নিজস্ব চিত্র)
যে ভাবেই কাজ করা হোক না কেন, ভাবনার সঙ্গে বাজেট কষার যে খুব একটা সম্পর্ক আছে এমন নয়। তবে সেই ভাবনাকে অল্প খরচে রূপায়িত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
কলকাতার বড় বাজেটের পুজোকমিটিগুলির ক্ষেত্রে কল্পনাকে রূপ দিতে ব্যবহার করা হয় ফাইবার, লোহা, ফাইবার মোল্ড, প্লাস্টার অফ প্যারিস প্রভৃতি। কিন্তু আমরা সেখানে ব্যবহার করছি বাঁশ, বাটাম, কাগজ, পলিথিন, থার্মোকল – এই ধরনের শস্তার জিনিসপত্র।
আমি এ বছর ত্রিশূলের থিম দিয়ে একটি পুজো করছি। বড় বাজেটের পুজো হলে তারা লোহার পাত কেটে সেই ত্রিশূল তৈরি করবে। কম বাজেটের পুজোর ক্ষেত্রে পাতলা প্লাইউড দিয়ে আমরা ত্রিশূল তৈরি করি। আমরা কম পয়সায় পাতলা প্লাই কিনে তাকে কাটিং করে লোহার রং করে লাগাচ্ছি। এই ভাবেই আমরা কাজ করে থাকি।
আমি এ বছর যে পুজোগুলো করছি সেগুলির প্রতিমা ও মণ্ডপের বাজেট মোটামুটি ভাবে তিন থেকে দশ লক্ষ টাকা। চারটি পুজোর মধ্যে একটির থিম হল ভিন্ন রূপে গণপতি পার্বতীনন্দন। এক সঙ্গে অনেকে বিখ্যাত গণেশজননীর মিল খুঁজতে পারেন, তবে তা না খোঁজাই ভালো। বেঙ্গল স্কুলের ধাঁচের সঙ্গে এই থিমকে মেলানো ঠিক হবে না।
বাজেট কম রাখতে ধাতুর বদলে ত্রিশূল তৈরি হয়েছে প্লাইউডের (নিজস্বচিত্র)
সাঁতরাগাছি তরুণ সঙ্ঘের এই থিম সাজানো হয়েছে গণেশের নানা রূপ দিয়ে। সঙ্গে তাঁর অস্ত্র গদা, ত্রিশূল প্রভৃতি। গণেশজননী হিসাবে দুর্গারও বিভিন্ন রূপ রয়েছে, এগুলি টেরাকোটার আদলে। পুরোটাই মূলত ম্যুরাল। তা ছাড়া ওঁ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলি মূলত থার্মোকল দিয়ে বানানো, তবে তার উপরে এমন রং ব্যবহার করা হয়েছে যাতে দর্শক তা নিছক থার্মোকল বলে বুঝতে না পারেন। এ জন্য পুট্টির সঙ্গে একটি বিশেষ ধরনের আঠা ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে দর্ণকের মনে হবে এগুলি কাঠ বা পাথরের মতো কঠিন কোনও কিছু দিয়ে তৈরি।
মণ্ডপ তৈরির সময় বৃষ্টির কথাও বিবেচনা করতে হয়। কাজ করতে হয় এমন ভাবে যাতে জলে তা কোনও ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর মণ্ডপ তৈরির পরে পুজোর সময়ও বৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়। সে জন্য বাইরের অংশ যথাসম্ভব ল্যামিনেট করতে হয়, এনামেল রং ব্যবহার করা হয়। গালার ব্যবহারও করতে হয়।
থিম অনুযায়ী প্রতিমা হলে আমরা মৃৎশিল্পীকে প্রতিমা এঁকে দিই। অনেকে প্রতিমায় পরিবর্তন চান না। তখন প্রতিমা নিয়ে ভাবতে হয় না। আমরা সারা বছর ধরেই থিমের ভাবনা ভাবি। দরকারে আমার সহকারী মৃৎশিল্পী আমার নির্দেশনায় প্রতিমা গড়েন।
মণ্ডপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় থার্মোকল, কাগজ। থাকে না ফাইবার ও ধাতু (নিজস্ব চিত্র)
এ বছর যেমন ঘোষপাড়া সংকল্প সঙ্ঘে এ বারে থাকছে সবচেয়ে বড় মহিষাসুর। ২২ ফুটের এই মহিষাসুর কেমন তা দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড় হবে বলে আশা করছি। এখানে থিম হল থিম অবশ্য নারীই শক্তি নারীই সৃষ্টি। যে নারী এই জগৎকে সৃষ্টি করছেন, যিনি জগতের মাতা তিনি কখনও শান্ত, কখনও উগ্রচণ্ডা। এখানে প্রতিক হিসাবে রয়েছে শাঁখাপলা, আশীর্বাদরত হাত রয়েছে। অশুভ শক্তির বিনাশে অনেকে মানত করে থাকেন, তার প্রতীক হিসাবে মাটির ঘোড়া আছে, বহু সংখ্যায় ত্রিশূল রয়েছে। মাটির ঘণ্টাও রয়েছে। কী কী ব্যবহার করা হয়েছে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সবই খুব কম বাজেটে হয়েছে।
মণ্ডপ জুড়ে রয়েছে মহিষাসুর, দেবী তাঁকে শূলে বিদ্ধ করছেন। এখানে দেবীর মনুষ্যরূপ, যিনি অপরাজেয় অসুরের বিনাশ ঘটাচ্ছেন।
আজও বৃষ্টি হচ্ছে তিতলির প্রভাবে। রামকৃষ্ণপুর ব্যায়াম সমিতির থিম হল মেঘ আকাশের বাদলধারা, সেজে উঠল বসুন্ধরা। সারা বছরের বৃষ্টির জল সংরক্ষণই এই থিমের মূল প্রতিপাদ্য। কারণ জল সবচেয়ে বড় সম্পদ। এখানে প্রচুর কলস থাকবে, কলসের নীচে জলের আদল এনেছি কাগজ দিয়ে। আর থাকছে অরিগ্যামী পদ্ম। অন্তত তিন মাস ধরে এই পদ্মফুল তৈরি করেছেন মৌমিতা মণ্ডল।
আড়াই থেকে তিন মাস সময় লাগে এক একটি মণ্ডপের জন্য।
মণ্ডপসজ্জায় রঙের ব্যবহার নিয়ে আলাদা ভাবনা থাকে
একই সঙ্গে দুই থিমের মণ্ডপও গড়ছি। গান্ধীজির জীবনের বিভিন্ন সময়কে প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে। সমসাময়িক সংবাদপত্র থেকে গান্ধীজির সময়ের ব্যবহৃত বহু জিনিস—সাইকেল, রেকর্ড প্লেয়ার থেকে মুদ্রা – নানা জিনিসের রেপ্লিকা ও আসল জিনিস রাখা হচ্ছে এই প্রদর্শনীতে। সারা দেশ থেকে সে সব সংগ্রহ করা হয়েছে। গান্ধীর জন্মের দেড়শো বছরে অবশ্য গান্ধী পার্ক শূন্য। সেখানে বাচ্চারা আসছে না। সেই খেলার সরঞ্জাম নিয়ে হয়েছে মূল মণ্ডপ। রামকৃষ্ণপুর তরুণ সঙ্ঘের এই কাজ করে আমি খুবই তৃপ্ত। তবে এই কাজটি অবশ্য আমার একার নয়।
এই মণ্ডপে আমার নিজের আঁকা ছবিও রয়েছে, যার থিম হল ঠিকানার ঠিক নেই দৌড়ানো তবু চাই, ছেলেবেলা দিনগুলো মনে পড়ে সবটাই ।
কলকাতার বড় পুজোগুলোর তুলনায় আমাদের পুজোর বাজেট প্রায় কিছুই নয়। তাও ছোট বাজেটের পুজোগুলো এখন নজর কাড়ছে থিমের দৌলতে।