হোলি পার্টির সেকাল-একাল: খোলামেলা থাকার বদলে তারকারা কেন এত আড়ষ্ঠ?
একসময় তারকারা পান করে নিজেদের মতো নাচানাচি করতেন, এখন সবই সাজানো
- Total Shares
দোল উৎসব একটা ব্যাপার প্রমাণ করে যে সবসমই আমরা ধর্মের ধ্বজা ধরে থাকি তা নয়, ঈশ্বর চান আমরা আনন্দে থাকি।
একটা ‘ধর্মীয়’ তিথি যেখানে কোনও বিধি-নিষেধের কড়াকড়ি নেই – কোনও পুজো নেই, মন্দিরে যাওয়া নেই, উপোষ করা নেই এমনকি এই উৎসবে কোনও কেউই ব্রাত্য নয়। এমনকি এই আনন্দে সামিল হতে আহ্বান করা হয় নারীদেরও। অফুরন্ত খাবার, এবং অবশ্যই পানীয়। যতদিন পর্যন্ত হুইস্কি ছিল না ততদিন পর্যন্ত ছিল শক্তিদায়ী ঠান্ডাই থেকে মুখের আগল খুলে দেওয়া ভাঙ – যা ইচ্ছে তাই করো, কোথাও কোনও বাধা নেই। হিন্দুদের উৎসবে এটাই একমাত্র যেখানে মাংস খেতে বাধা নেই, আরও ভালো ভাবে বলতে গেলে, মাংস খেতে হয়। এটা মানুষের উৎসব, সকলের উৎসব।
তারকা – বিশেষ করে চলচ্চিত্র জগতের তারকারা – থেকে শুরু করে কেউই এই উৎসবের মাঝে কোনও দিন কোনও প্রাচীর খাড়া করেনি। কোনও পর্দায় নয়, সিক্ত শরীরে মন্দাকিনীকে চাক্ষুস করার সুযোগ আর কোথায় পাওয়া যেতে পারে, এবং আরকে স্টুডিয়োয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে চটকদার ব্যক্তিত্ব রাজ কাপুরকে দেখার সুযোগ কি ছাড়া যায়?
হোলি হাঙ্গামা বলিউডের বর্ণময় অতীতে হোলির দিন কোনও কৃত্রিমতা ছিল না (উৎস: ঋষি কাপুর/টুইটার। শিল্পভাবনা ডেইলিও)
তাঁর প্রয়াণের আগে পর্যন্ত বলিউডে সত্যিকারের বিখ্যাত সেই ব্যক্তি – এবং যাঁরা অতটা জনপ্রিয় ছিলেন না তাঁরাও – আরকে স্টুডিয়োর জন্য একটি রেখা টেনে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণা রাজ কাপুর ছিলেন সেই কিংবদন্তী কর্ত্রী যদিও এ ব্যাপারে যা শোনা যায় তার বেশিরভাগটাই জনশ্রুতি। সে যাই হোক, এখানে অতি সাধাসিধে ভাবে রং মাখা অবস্থায় দেখা যেত রাজেন্দ্র কুমার, অমিতাভ বচ্চনদের, যেন তাঁরাও আর পাঁচজনের মতোই এক্কেবারে সাধারণ।
ওহ! কত জন যে ‘হোলি উইদ দ্য কাপুরস’-এর সেই সব অনবদ্য ছবিগুলি দেখার জন্য স্টারডাস্ট ও ফিল্মফেয়ার পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতেন!
রেখার সেই আলুলায়িত ছবি দেখার জন্য আমরা লালায়িত হয়ে থাকতাম কিংবা হেমা মালিনীর সেই নিদারুণ মাতাল করে দেওয়া মুহূর্তের ছবির অপেক্ষায় থাকতাম। গান-বাজনাটা ছিল তাদের নিজেদের ব্যাপার তবে পুরনো সাদাকালোয় ঢোলক হাতে রাজ কাপুরের ছবি এবং তার একাংশ জুড়ে শঙ্কর জয়কিষাণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাঁর ছবি আর সেই অনবদ্য সুরের কথা, বুঝিয়ে দেয় দশকের পর দশক ধরে কেন তাঁর ছবির সঙ্গীত অত সুন্দর হয়েছে। আর উদ্মাদিনীর মতো সিতারা দেবীকে দেখে মনে হত যে তিনিও রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষ – তারকারাও আমাদের মতো সাধারণের মাঝে নেমে আসতে পারেন সে সব না দেখলে বিশ্বাস হত না।
তবে তা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না...
বলিউডের সেই স্বতস্ফূর্ত হোলি পার্টির কী হল?
এর জন্য বিপণন ও সোশ্যাল মিডিয়াই দায়ী। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে হোলিতে যাতে তাঁর মক্কেলকে সুন্দর দেখায় সে জন্য স্টাইলিস্টরা তাঁদের সেরা চেষ্টাটি করে থাকেন – মাড়ের রঙের কুর্তা ও টাইট চুড়িদার, চোখে সেই চিরপরিচিত রোদচশমা!
খোঁপার জন্য বিশেষ এক ধরনের তেল যাতে চুলের বিন্দুমাত্র কোনও ক্ষতি না হয়।
বিশেষ কয়েকটি ক্রিমও থাকে যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ত্বকের ঔজ্বল্য যেন সমস্ত সময়ই একই রকম থাকে, যেন কোথাও কোনও রকম বিচ্যুতি না ঘটে।
হোলির এও এক নজির! কিংবা রণবীর যে উইলিয়ামসের সঙ্গে মস্করা করতে পারেন এ যেন তারই এক উদাহরণ। (উৎস: ইনস্টাগ্রাম)
এই সব ছবিগুলিকে যত্ন করে সাজিয়েগুছিয়ে উপস্থাপন করা হত, এগুলিই লোকের মনে ব্যাপক ভাবে ছাপ ফেলত – গণমাধ্যমে ছবিগুলি পাঠানো হত আর তারা এ থেকে অন্য একটা আঘ্রাণ পেত। যখন রণবীর কাপুরকে দেখি ফারেল উইলিয়ামসের সঙ্গে তখন আমাদের মনে হতে থাকে যে এদেশর সত্যিকারের পার্টি আসলে কেমন তার একটা আস্বাদ নিশ্চয়ই পাচ্ছেন ওই ফিরঙ্গিটি – তবে সত্যি কথা বলতে কি, এটাই কি শেষ কথা? একেবারে নিঁখুত দুটি ছবি পাঠানো হয়েছে লাল ও হলুদ রঙের আবির মাখা অবস্থায়, যা খুব যত্ন সহকারে তাঁদের থুতনিতে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের পোশাকে সেই রং আগে থেকেও মাখানো ছিল।
এটাই কি হোলির উদাহরণ নাকি এটা প্রমাণ করছে যে উইলিয়ামসের সঙ্গে মস্করা করতে পারেন রণবীর সিং, সেই কথা?
যাঁরা আরকে পার্টিতে গিয়েছিলেন এবং পরবর্তী কালে বলিউডের বাদশাদের চোখমুখ চকচক করত উন্মাদনায়। শুধু একগ্লাস পেরিয়ার পান করার জন্য তা হত না। সেখানে প্রচুর পরিমাণে হুইস্কি ও বিয়ার দেখা যেত। সুইমিং পুলের জল পুরো ঘোলা হয়ে যেত আর সেখানে ডুব দিয়ে উঠলে পরে একজন যুবতীকে যেন জলপরী বলে মনে হত।
এটা যেন ছিল অনুষ্ঠানের প্রবেশপথ – যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি সেই সুইমিং পুলে না নামছ ততক্ষণ পর্যন্ত বলিউডে তোমার অভিষেকই হয়নি।
আমরা এখন সেই হারানো দিনগুলোর কথা ভেবে শুধুই হা-হুতাস করতে পারি! এখন সকরলেই রাজনৈতিক ভাবে ঠিক থাকতে চান, আর একটা কথা ভেবে আমার খারাপ লাগে যে আমাদের তারকারা তাঁদের ভাবমূর্তি নিয়ে এতটাই ভাবিত যে তাঁদের শুধুই মনে হয় যে এই বুঝি ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেল।
এ জন্য কি আমাদের দোষ দিচ্ছেন?
আমরা যে ভাবে আমাদের তারকাদের ট্রোল করি তার অর্থ হয়েছে যে ব্যক্তিগত জীবন মানে পুরোটাই রাখাঢাকা। যেই ভিডিয়োতে দেখা গেল যে ওয়াইনের গেলাস হাতে দীপিকা পাড়ুকোন তাঁর স্বামীর একটা ডায়ালগ বলছেন অমনি লোকজন তাঁর উপর প্রবল খেপে যেতে শুরু করে দিল, এটা তাঁরা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।
অনমনীয়? সবই আগে থেকে ঠিক করে রাখা, কেন আগেভাগে ক্যামেরা পৌঁছে যায়? (উৎস: ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব )
পরের প্রজন্মের কাছে হোলি হল আরেকটু আধুনিক ও নম্র ব্যবহারের নামান্তর। এখনও সাদা কুর্তায় অনেক জায়গাতেই রং পড়েনি। ঘটনা হল, নামী টেলিভিশন প্রযোজক বা তাঁর সন্তানতুল্য ছোট পর্দার কোনও তারকার কাছে হোলি মানে হযত আগে থেকে সুন্দর ভাবে ছকে রাখা কোনও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা – সেখানে আগে থেকে বলা থাকে যে সাজপোশাক কেমন হবে – তাঁদের প্রত্যেকেই হয়তো সেদিন চিকনের কুর্তা পরবেন, তাঁদের দেখে মনে হবে তাঁরা যেন এই মাত্র কোনও একটি মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন। রংটা আগলা ভাবে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে আর কাউকেই কিছু পান করতে দেখা যাবে না।
আমি নিশ্চিত যে তাঁরা এ সব করবেন তবে ক্যামেরার আড়ালে।
প্রশ্ন হল, যখন সবকিছুই সাজানো-গোছানো তখন ক্যামেরার দরকার কী?
তাঁরা কিন্তু তাঁদের ভাবমূর্তি ও ইগোর কণামাত্র এক মুহূর্তের জন্য ভাঙতে পারবেন না?
এ জন্য অবশ্যই আমরা, মানে যারা সাধারণ মানুষ, তারাই দায়ী কারণ ধনী ও নামী ব্যক্তিদের জীবন কেমন তা জেনে আমরা যেন কিছুতেই খুশি হতে পারি না, এ ব্যাপারে আমাদের অদম্য কৌতূহল আর আমরা সাংস্কৃতিক ধ্বজাধারী হয়ে গিয়ে কোনও অবস্থাতেই তাঁদের নিয়ে অনধিকার চর্চা করতে বা সমালোচনা করতে ছাড়ি না। একই ব্যক্তি মনে মনে ভাবি কোনও রমণীর কুচযুগল রাঙিয়ে দেওয়ার কথা ভাবি আর একজন বিখ্যাত ব্যক্তি যখন মজা করেন তখন চিৎকার করি। অনলাইনে অযাচিত মন্তব্যের জেরে এখন বিখ্যাত ব্যক্তিদের হাল এমন হয়েছে যে তাঁরা কিছু করলেই তাকে অভারতীয়সূচক বলা হচ্ছে!
যদি আজ সেই রাজ কাপুর থাকতেন!
সত্যিকারের ভারতীয় বলতে কী বোঝায় হয়তো সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারতেন। হয়তো সেইসব ট্রোলের জন্য তাঁর কাছে খোলাখুলি কোনও জবাবও ছিল – তিনি খাবার আর পানীয়ে এমন ভরিয়ে দিতেন যে সকলেই ভুলে যেতেন তাঁদের নিয়ে কে কী বলছে।
হ্যাপি হোলি!
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে