নিয়ম না মেনে সংরক্ষণ করলে অচিরেই ধ্বংস হবে ঐতিহ্যের নিদর্শন

সংরক্ষণ মানে বিনাশ ঘটানো। কারণ তার মধ্যে নতুন উপাদান ব্যবহার করা হয়

 |  5-minute read |   14-04-2018
  • Total Shares

সাধারণত আমরা হেরিজেট বা ঐতিহ্য বলতে বুঝি, দেশে যত পুরোনো স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা এবং এমন সংস্কৃ্তি যা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে, সে সবকিছুই। উদাহরণ হিসাবে আমরা বলতে পারি বিভিন্ন উৎসব, অজন্তা-ইলোরার মতো কলা, সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে রামায়ণ-মহাভারত, বৌদ্ধদের জাতক প্রভৃতি। এ ছাড়া অগণিত স্থাপত্য-ভাস্কর্যও রয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানও রয়েছে, যেমন দুর্গাপুজা, টুসু-পরব প্রভৃতি।

আমাদের যত রকম ঐতিহ্য আছে, তাকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। ট্যানজিবল হেরিটেজ এবং ইনট্যানজিবল হেরিটেজ। যেটা স্পর্শ করতে পারি, দেখতে পারি সেটা ট্যানজিবল এবং যুগ যুগ ধরে যে সব প্রথা চলে আসছে, সে সবকে আমরা ইনট্যানজিবল হেরিটেজ বলে থাকি। আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে এই সব ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে রাখা খুবই দরকার। ট্যানজিবল হেরিটেজ রক্ষা করতেই হবে আগামী প্রজন্মের জন্য এবং তা নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে রক্ষা করতে হবে।

pur_body1_041418033408.jpgপ্রাচীন কনকদুর্গা মন্দির, প্রয়োজন আশু সংরক্ষণের

প্রশ্ন হল এই সব ঐতিহ্যকে কী ভাবে আমরা ভালো ভাবে রক্ষা করতে পারব। ট্যানজিবল ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হবে নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে। এ জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করছে ইউনেস্কো। তারা বিভিন্ন দেশকে এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টাও করছে, যাতে প্রতিটি দেশ তাদের নিজ নিজ ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ঐতিহ্য হল দেশের পরিচয়ের বাহক। তার মধ্যে যেমন স্থাপত্য রয়েছে, তেমনই রয়েছে শিল্পকলা, সংস্কৃ্তি প্রভৃতি, যা থেকে সেই দেশ সম্বন্ধে আমরা ধারণা করতে পারি। তাই আমরা যদি ঐতিহ্য রক্ষা করতে না পারি, তা হলে আমাদের নিজস্ব যে পরিচয় আছে, সেই পরিচয় নষ্ট হয়ে যাবে। তা হলে আমাদের পৃথক পরিচয় আর থাকবে না, তখন আগামী প্রজন্ম সেই ঐতিহ্য ধ্বংস করার জন্য আমাদেরই দুষবে।

এ সব ঐতিহ্য তো আমাদের প্রজন্মের কারও তৈরি করা নয়, হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা যা করে গিয়েছেন, আমাদের কাজ হল শুধুমাত্র সেগুলিকে রক্ষা করা। তিনটি পদ্ধতিতে এ সব রক্ষা করা যায়, প্রিজার্ভেশন (রক্ষণাবেক্ষণ), কনজার্ভেশন (সংরক্ষণ) ও রেস্টোরেশন (পুনরুদ্ধার)। রক্ষণাবেক্ষণ করা হল, যা আছে, যে অবস্থায় আছে, তাকে সেই অবস্থায় রক্ষা করা, অর্থাৎ নতুন করে তার যেন কোনও ক্ষতি না হয়। তাকে নির্দিষ্ট কৌশলে পরিচর্যা (ট্রিটমেন্ট) করে, সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক ব্যবহার করে, উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে তাকে বাঁচাতে পারি।

pur_body2_041418033426.jpgখাজুরাহের ঘণ্টাই মন্দির, পড়ে আছে অনাদরে

যেটা ভেঙে গেছে সেটা ঠিক করার জন্য সংরক্ষণের কাজ করতে হয়। তবে সংরক্ষণ মানে এক ধরণের বিনাশ ঘটানো। কারণ তার মধ্যে নতুন উপাদান ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যখনই কোনও নতুন উপাদান ব্যবহার করা হবে তাকে ঠিক করার জন্য বা পুনরুদ্ধারের জন্য, সে কোনও শিল্পকলা হোক বা স্থাপত্য, তাতে ইট, কাঠ, পাথর, সিমেন্ট, চুন – যা কিছু আমরা ব্যবহার করব, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে প্রকৃতপক্ষে যে সব জিনিস তখন ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়েছিল, এখনও আমরা সেটাই ব্যবহার করছি। যদি তার বাইরে অন্য কিছু ব্যবহার করি, তার অর্থ হবে সেই ইতিহাসকে আমরা নষ্ট করে ফেলছি। পরে যাঁরা সেই ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখবেন, তাতে তাঁরা আসল জিনিসটি দেখতে পাবেন না, তাঁরা দেখবেন অন্য কিছু, তাই বলছি ইতিহাসের বিনাশ ঘটানো হচ্ছে। এ ভাবে সংরক্ষণের চেষ্টা করা মানে মস্ত বড় ভুল করা।

মানুষের উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, হৃদপিণ্ড, যকৃৎ প্রভৃতি ট্রান্সপ্ল্যান্ট যে ভাবে করা হয়, অর্থাৎ রক্তের গ্রুপ মেলানো হয়, সেই ভাবে ঐতিহ্যের সংরক্ষণও দরকার। আলাদা রক্তের গ্রুপ হলে যেমন মানুষ বাঁচে না, সে ভাবে ঐতিহ্যও বাঁচে না। এ জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

আমার মতে, পুনরুদ্ধার বা রেস্টোরেশন ত্যাগ করা উচিৎ। ধরা যাক, কোনও মন্দিরের একটা স্তম্ভ ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তখন তার পাশে একটি স্তম্ভ বানিয়ে মন্দিরটি রক্ষা করতে হবে, যদি আগের স্তম্ভের সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করা হয়, তা হলে নতুন করে নির্মিত অংশটি চিহ্নিত করে রাখতে হবে, যা দেখে দর্শক স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারেন কোনটি নতুন আর কোনটা আসল। আর এই নির্মাণও এমন ভাবে করতে হবে, যাতে নতুন কোনও প্রযুক্তি এলে বা ওই স্থাপত্য যে উপাদানে তৈরি তার কাছাকাছি কোনও উপাদান ভবিষ্যতে পেয়ে গেলে, নির্মাণটি সরিয়ে দিতে সমস্যা না হয়, মূল নির্মাণের কোনও ক্ষতি না হয়।

আমাদের দেশে এখন বহু শিল্পকলা, ঐতিহ্যবাহী ভবন প্রভৃতি সংরক্ষণ করা চলছে। অনেক ক্ষেত্রেই ঐতিহ্যের প্রতি আমরা সুবিচার করছি না। আমরা সংরক্ষণের নামে তার মধ্যে নতুন উপাদান দিয়ে দিচ্ছি, যা আসলে তার মধ্যে ছিল না। এর ফলে শুধুমাত্র ঐতিহাসিক ভুলই হচ্ছে না, ওই পুরাবস্তুর আয়ুও কমে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সংরক্ষণের ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান যদি না থাকে এবং লোকে যদি নিজের ইচ্ছামতো সংরক্ষণ করে যেতে থাকে, সংরক্ষণের মূল নীতি যদি না মানে তা হলে, তা হলে তা হবে বড়সড় ভুল। এমন অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন সংরক্ষণের কাজ করছে যারা এ কাজে পারদর্শী নয়। উপযুক্ত ভাবে সংরক্ষণ করতে হলে সম্যক ব্যবহারিক জ্ঞান থাকা জরুরি, সচেতনও হতে হবে। ব্যবহারিক জ্ঞান বা ওরিয়েন্টেশন হল যাঁরা এই সব কাজ করছেন, তাঁদের প্রশিক্ষিত করতে হবে, যে কোনও কাজ কী ভাবে করতে হবে। দুর্ভাগ্যের কথা হল, আমাদের দেশে এখনও এ নিয়ে এখনও কোনও উপযুক্ত নির্দেশিকাই নেই। তবে ইউনেস্কোর একটা গাইডলাইন আছে।

pur_body3_041418033442.jpgরক্ষা পেয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার টাকির এই ঠাকুরদালান

আমাদের দেশে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণকে (এএসআই) মান্যতা দিয়েছে ইউনেস্কো, সংরক্ষণের ব্যাপারে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে। তাদের এই কাজ উপযুক্ত ভাবে করার ব্যাপারে দেড়শো বছরের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। শুধু এ দেশেই নয়, কাম্বোডিয়া-সহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বড় বড় কাজ করেছে এএসআই, তারাই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পুরোনো সংরক্ষণকারী সংস্থা।

আইনগত একটা দিকও অবশ্য রয়েছে। একে অ্যান্টিকুইটি আইন বলা হয়। বিভিন্ন সময়ে এই আইন বদলও হয়েছে। আগ্রহীরা এই সংক্রান্ত আইন দেখে নিতে পারেন ইন্টারনেট ঘেঁটে। আমাদের দেশের অনেক সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে, অনেক কিছু চোরাচালানও হয়েছে। সে সব রক্ষা করতেই এই সব আইন তৈরি করতে হয়েছে। সাধারণ লোকের এ ব্যাপারে ধারণা প্রায় নেই। তাই আপনাদের এই মাধ্যম ব্যবহার করে সাধারণ লোককে একটা বার্তা আমরা দিতে চাই, তাঁরাও এগিয়ে আসুন দেশের ঐতিহ্য রক্ষা করতে।

আমাদের মৌলিক অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনই আমাদের মৌলিক কর্তব্যও রয়েছে। লিখিত ভাবে ঐতিহ্য রক্ষার কথাও বলা হয়েছে। ভারতের প্রতিটি নাগরিকই এই সম্পদের অধিকারী, তাই এই সম্পদ রক্ষার দায়িত্বও দেশের নাগরিকের উপরেই বর্তায়। যে কোনও মূল্যে আমাদের এইসব ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে।

আমরা ভারতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে এ বছর একটা পাঠক্রম চালু করছি, যাতে যাঁরা এ ব্যাপারে জানতে চান, তাঁরা এই সুবিধা নিতে পারেন। এখানে শুধু আমরা নিজেরা নই, বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিরা এই পাঠক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে হবেন।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

DR RAJESH PUROHIT DR RAJESH PUROHIT

Director, Indian Museum| Archaeologist

Comment