হাজারিবাগে উৎখননে আবিষ্কৃত হল হিন্দু বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নিদর্শন
পালি ভাষায় 'ইতি খই' শব্দের অর্থ আমি ওকে হারিয়েছি, তা থেকই ইটখড়ি
- Total Shares
কয়েক সপ্তাহ আগে ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলায় গিয়েছিলাম সংরক্ষণের জন্য কাজ করা ইনট্যাক-হাজারিবাগের আমন্ত্রণে। সঙ্গে ছিলেন আমার সহকারী গবেষক সুজাতা চট্টোপাধ্যায়। আমরা দু’জনে ঝাড়খণ্ড সরকারের অতিথি হয়েই হাজারিবাগে ছিলাম।
বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে যুক্ত ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান নিয়ে কাজ করার সুবাদে আন্তর্জাতিক মহলে আমার পরিচিতি অনেক দিনের। ১৯টি দেশের বৌদ্ধ ঐতিহ্য নিয়ে আমি তথ্যচিত্র তৈরি করেছি। “বুদ্ধইজম: দ্য পাথ অফ কম্প্যাশন” খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে ভারত সরকারের গ্রন্থন বিভাগ থেকে।
বুদ্ধগয়াকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের তালিকায় আনার জন্য আমি চিঠি লিখে আবেদন করেছিলাম ইউনেস্কোতে। পরবর্তী কালে ইউনেস্কা আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় বুদ্ধগয়া।
উৎখননে আবিষ্কৃত হয়েছে এই নিদর্শন। বিনয় বেহল ও বুলু ইমাম
হাজারিবাগে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বুলু ইমাম, তিনি বিগত ৩০ বছর ধরে হাজারিবাগে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস ও বৌদ্ধ ঐতিহ্য নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন। আর সুজাতাও বৌদ্ধ ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, রাশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে।
এবার হাজারিবাগ সফর বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ হাজারিবাগের ইটখড়ি গ্রামে হিন্দু ও বৌদ্ধ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ইটখড়ি একেবারে প্রান্তিক বিহারী গ্রাম, এখানেই লুকিয়ে ছিল সেই পুরাতাত্ত্বিক সম্পদ। ইটখড়ি থেকে বৌদ্ধ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের একটা অন্য তাৎপর্য রয়েছে। কারণ গৌতমবুদ্ধ বোধিলাভের আগে ইটখড়ি থেকেই বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলেন। এই জায়গাটা কুলেশ্বরী মন্দিরের খুব কাছেই। মনে করা হয়, এই কুলেশ্বরী মন্দিরেই মস্তক মুণ্ডন করেছিলেন গৌতমবুদ্ধ।
উৎখনের ফলে এই ধরনের নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ায় হাজারিবাগ খুব শীঘ্রই বৌদ্ধদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।
আমার মনে হয়, বৌদ্ধ ঐতিহ্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে ইটখড়ি এলাকার বিশেষ তাপর্য আছে, কাছে বোধিলাভের আগে এই গ্রাম থেকেই অধুনা বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলেন গৌতম সিদ্ধার্থ। সে জন্য বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা তো বটেই, পর্যটকদের কাছেও এই জায়া যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। আমরা ভারতীয়রা ঐতিহ্যের মধ্যেই বসবাস করি। যদি আমরা উৎখনন করি, তা হলে হয়ত দেখব আমরা যেখানে বসবাস করছি, সেখানেও মাটির নীচে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে।
হাজারিবাগের ইটখড়ি গ্রামে হিন্দু ও বৌদ্ধ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে
মূলত মাটির অনেক গভীর থেকে ও পুরোনো ইঁদারার নীচ থেকে এই সব নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। নিদর্শনগুলি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের মধ্যের, এগুলি হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত।
সত্যের সন্ধানে যখন বোধিসত্ত্ব হিসাবে তিনি অধুনা বুদ্ধগয়ায় যাচ্ছেন, সম্ভবত তাঁর এই যাত্রা শুরু হয়েছিল মোহনা নদীর নিম্নবাহিকা ধরে ইটখড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে, নৈরঞ্জনা নদীর তীরে। ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত স্যার এডুইন আর্নল্ডের লেখাতেও এই জায়গার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
Thou, who would see where dawned the Light at last, North-westwards from the “Thousand Gardens”
এখানে Thousand Gardens হল হাজারিবাগ আর ইটখড়ি থেকে বুদ্ধগয়ার দিক নির্দেশ করা হচ্ছে উত্তর-পশ্চিম শব্দের মধ্যে। তিনি লিখছেন,
On the green hills where those twin streamlets spring, Nirajan and Mohana; follow them,Winding beneath broad-leaved mahua-trees, Till on the plain the shining sisters meetIn Phalgu’s bed, flowing by rocky banksTo Gaya and the red Barabar hills…Uruvela (ancient name of Bodh Gaya site) named in ancient days,
এখানে সিস্টার বা ভগিনী বলতে দুই নদীর কথা বলা হয়েছে।
আবিষ্কৃত নিদর্শনের সঙ্গে স্থানীয় তরুণরা
ইটখড়ি নামের সঙ্গেও বৌদ্ধ ধর্মের সম্পর্ক আছে। সিদ্ধার্থ তাঁর মাসী প্রজাপতি গৌতমীর কাছে বড় হয়েছেন। তিনি গৌতম সিদ্ধার্থকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। যখন তিনি তাঁকে পেলেন না, তখন বললেন ইতি খই, পালি ভাষায় যার অর্থ, আমি ওকে হারিয়েছি। ইতি খই থেকেই ইটখড়ি নামের উৎপত্তি। তাই এই জায়গার সঙ্গে যে বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু ধর্মের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা স্পষ্ট। সম্পর্কটা এখনও রয়েছে।
এখান থেকে বহু হাজার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, স্থানীয় জাদুঘরে ৭০০টি নিদর্শন রাখা আছে। নিদর্শনগুলির সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মবিশ্বাস জড়িয়ে রয়েছে। নিদর্শনগুলি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খিস্টীয় দ্বাদশ শতক, অর্থাৎ পাল-সেন শাসন পর্যন্ত সময়ের শিল্প-নিদর্শন হিসাবেও এগুলি খুবই উচ্চমানের।