আমার বাবা শৈল চক্রবর্তীই আমার আঁকার শিক্ষক, হয়তো সত্যজিৎ রায়েরও
কলকাতা কর্পোরেশন বাবাকে 'কার্টুন সম্রাট' উপাধিতে ভূষিত করে
- Total Shares
আমার ছবি আঁকার হাতেখড়ি বাবা শৈল চক্রবর্তীর কাছেই। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে আমি দু'জনকে খুব কাজ থেকে দেখেছি, একজন আমার বাবা অন্যজন আমাদের সবার প্রিয় সত্যজিৎ রায়।
এঁরা দুজনেই বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশনই আঁকতেন বেশি সংখ্যায়।
সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবির আমি একজন বিরাট ভক্ত। আমার মনে হয় মানিকদার সিনেমা না বানালেও চলত, শুধুমাত্র ছবি এঁকেই উনি ঠিক একই রকম খ্যাতি পেতে পারতেন। স্কেচ বা অন্য কোনও ছবি আঁকার জন্য তিনি যখন হাতে তাঁর কালো কালির কলমটা তুলে নিতেন তখন সেটা যে ভাবে চলত তা দেখতে দারুণ লাগত। আমার বাবারও ওই ভাবে কলম চলত না। মানিকদা একটি রেখা দিয়ে একটা গোটা ছবি এঁকে ফেলতে পারতেন।
মানিকদার প্রথম গল্পের ইলাস্ট্রেশনও বাবারই হাতে করা। কার্টুন আঁকার অসাধারণ ক্ষমতার জন্য মানিকদা বাবাকে তাঁর গুরু বলে মানতেন। মানিকদা বলতেন, যে উনি বাবার ছবির উপর মকশো করে ছবি আঁকা শিখেছেন।
শৈল চক্রবর্তীর ১০০ বছর পূর্তিতে শিল্পী ওয়াসিম কাপুরের আঁকা ছবি
তবে বাবা কার্টুন বেশি আঁকতেন। কলকাতা কর্পোরেশন থেকে বাবাকে 'কার্টুন সম্রাট' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কর্পোরেশনের লোগোটিও বাবারই সৃষ্টি করা।
আমার জীবনের পাঁচটা বছর আমি মানিকদাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আর বাবাকে তো সবসময়ই পেয়েছি। তখন বিভিন্ন কাজে বাবার কাছে বহু বিখ্যাত মানুষ আসতেন, যেমন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আল্পনা বন্দোপাধ্যায় যিনি 'হাট্টিমাটিম টিম' গানটা গেয়েছিলেন, লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবী, গজেন্দ্র মিত্র ও আরও কতজন। সবাই আসতেন আমাদের বাড়িতে। আবার অনেক সময় আমিও বাবার সঙ্গে এঁদের অনেকের বাড়িতে গিয়েছি যেমন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ। একজন চিত্রশিল্পী বা একজন ইলাস্ট্রেটরের এ হেন জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি খুব কমই দেখেছি। বাবার যে 'সিলিব্রিটি স্টেটাস'টা ছিল সেটা তখন অনেককেরই ছিল না, তার জন্য অবশ্য বাবার সুদর্শন চেহারাও ভূমিকা রয়েছে-টিকোলো নাক, ফর্সা গায়ের রং এবং তাঁর চুল আঁচড়াবার কায়দা। অনেককেই বলতেন বাবার সঙ্গে লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মিল আছে।
শৈল চক্রবর্তীর আঁকা ইলাস্ট্রেশন
ছেলেবেলায় বাবা আমাদের নিয়ে যখন ছবি আঁকতে বসতেন কিংবা কী ভাবে ছবি আঁকতে হয় শেখাতেন তখন বাবা আমাদের বেশি করে হ্যান্ড পেন্টিং বা ফিঙ্গার পেন্টিং করতে বলতেন। যেহেতু তখনও ভালো ভাবে তুলি ধরতে পারতাম না এবং বিভিন্ন রঙের সঠিক ব্যবহার করার মতো তখনও আমাদের বয়স হয়নি তাই বাবা আমাদের এই পদ্ধতিতে ছবি আঁকা শেখাতেন। আমরা এখনও মনে আছে আমরা তখন ঢাকুরিয়ার বাড়িতে থাকতাম। মা অনেকটা অ্যারারুট গুলে একটা মন্ড বানিয়ে দিতেন এবং বাবা আমাদের প্রচুর সাদা কাগজ এবং রং দিতেন আর আমরা সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন রকম আকার গড়তে থাকতাম।
এছাড়া আমরা যখন বাবার কাছে আঁকা শিখেছি তখন বাবা আমাদের কোনও দিন অন্য কারও তো নয়ই, ওঁর নিজের আঁকা কোনও ছবি দেখেও সেটা আঁকতে বলতেন না। কারণ বিখ্যাত কারও আঁকা ছবি নকল করলে কখনওই সেটা আসল ছবির মতো হয় না, এর ফলে যিনি নকল করছেন তাঁর মধ্যে একটা হতাশা দানা বাঁধে। এভাবে বহু মানুষ ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছেন।
শৈল চক্রবর্তীর আঁকা ক্যারিকেচার
আমাদের কল্পনাশক্তি এবং কোনও জিনিষকে খুব ভালোভাবে নিরীক্ষণ করার শক্তির বিকাশ ঘটতে সাহায্য হয়েছিল। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বাবা আমাদের সীমাবদ্ধ করেননি, তাই আমরা নিজেদের মতো করে ছবি আঁকতাম। ছবি আঁকার বিষয় বাবা আমাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতাটা দিয়েছিলেন। আমাদের আঁকা ছবিগুলো শুকিয়ে গেলে বাবা সেগুলোকে সারা ঘরে সাজিয়ে রাখতেন।
কখনও আঁকা না পারলে বাবা আমাদের কোনও দিন বকাঝকা করেননি। যদিও অন্যান্য বিষয় বাবা হয়তো কখনও কখনও আমাদের বকাঝকা করেছেন কিন্তু ছবি আঁকার ক্ষেত্রে উনি আমাদের কোনও দিন শাসন করেননি।
শৈল চক্রবর্তীর আঁকা বইয়ের প্রচ্ছদ
বাবা নিজে যখন ছবি আঁকতেন তখন তিনি একটা মজার জিনিস করতেন সেটা হল তিনি আমাদের একটা রেখা কাটতে বলতেন এবং সেই একটা রেখার থেকে তিনি একটা গোটা ছবি এঁকে ফেলতেন। বাবার ছবি আঁকার এই পদ্ধতি পরে অবশ্য জাদুর সম্রাট পিসি সরকার (সিনিয়র)-ও তাঁর অনুষ্ঠানে ব্যবহার করেছেন। আমিও এই পদ্ধতিতে ছবি এঁকে থাকি।
পরবর্তী কালে আমিও বহু ইলাস্ট্রেশন এঁকেছি। 'সন্দেশ' পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছবি এঁকেছি।
চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর ক্যানভাসে সত্যজিৎ রায়
আমি আমার বাবা শৈল চক্রবর্তীকে এমন একজন কার্টুনিস্ট হিসেবে মনে রাখতে চাই যিনি অনবদ্য কয়েকটি পলিটিক্যাল কার্টুন এঁকেছেন। তাঁর আঁকা বহু পলিটিকাল কার্টুনই বেশ সাড়া ফেলেছিল, সেই সব কার্টুন অনেকেই কোনও দিন ভুলতে পারবেন না।