আজ শ্রীঅরবিন্দেরও জন্মদিন, তাঁর প্রথম আবির্ভাব মহোৎসবের সূচনার কথা
সুসজ্জিত ট্রলিতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আলিপুর বোমা মামলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের
- Total Shares
১৫ অগস্ট, ১৯৪৮। সারা দেশ মেতে উঠেছে সদ্য পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে। কিন্তু এক ৩৫ বছরের যুবকের মনে তখন একটা অশান্তি কাজ করছে। যুবকটি সেই আনন্দোৎসবের আমেজটুকু গায়ে না মেখে হাজির হলেন তৎকালীন বাংলার কৃতী বিদ্বজ্জন কালিদাস নাগের কাছে।
কালিদাস নাগকে তিনি খুলে বললেন মনের কথা। এই একই দিনে জন্ম বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবের যুগনায়ক ঋষি অরবিন্দের। অথচ আজ মানুষ তাঁকে স্মরণ করল কই! সেই যুবকটি সেদিনই ব্রত নেন এক মহান কর্মকাণ্ডের। একটা বছর শুধুই অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়া।
প্রথম শ্রীঅরবিন্দ মহোৎসবের ছবি (সৌজন্য: লেখক)
১৯৪৯ সাল। সেই ৩৬ বছরের যুব বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতার হাজরা পার্কে আয়োজন করলেন অরবিন্দ আবির্ভাব মহোৎসবের, শ্রীঅরবিন্দের ৭৭তম জন্মজয়ন্তীতে। মহোৎসবের সভাপতি হলেন বিমলচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ অগ্রজ বিচারপতি নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সদ্যপ্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা), সম্পাদক বিমলচন্দ্র। পরের বছর সভাপতি হন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সেই আবির্ভাব মহোৎসবের সূচনা করেন বীর সাভারকর।
সাতদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানে সামিল হননি কে! দিলীপকুমার রায়, পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর...। সুরসাগর জগন্ময় মিত্রের উপরে ভার ছিল উদ্বোধনী সঙ্গীতের। পণ্ডিচেরী থেকে স্বয়ং শ্রীমা পাঠালেন শ্রীঅরবিন্দের মৌখিক সম্মতি লিখিত রূপ ও শুভেচ্ছা।
তৈরি করা হল শ্রীঅরবিন্দের শরীরের মাপজোক অনুযায়ী মাটির মূর্তি, যেটি শোভাযাত্রার সামনে রাখা হয়েছিল। এই মূর্তিটি পরবর্তীকালে বিমলচন্দ্র দাম করে দেন রানিকুঠির শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম লক্ষ্মী হাউসে। মূর্তিটি এখনও রয়েছে। জগন্ময় মিত্র তাঁর শাওন রাতে যদি গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন কী ভাবে অনুষ্ঠান শুরুর আগে মা ও অরবিন্দের আশীর্বাদ এসে পৌঁছেছিল।
পণ্ডিচেরী থেকে আসা সম্মতিপত্র (সৌজন্য: লেখক)
জগন্ময় মিত্র লিখছেন: কলকাতায় বিরাট আকারে শ্রীঅরবিন্দ আবির্ভাব মহোৎসব করা হবে বলে ঠিক করা হল। শ্রীবিমল চ্যাটার্জি সেই মহোৎসব নিয়ে মেতে উঠেছে। বিমলদা যেখানে থাকবে, আমাকেও থাকতেই হবে সেখানে। বিমলদার এরকম অত্যাচার সইতে হয় মাঝে মাঝে। আমি মরেছি ভালোবেসে। বিমলদার ভালোবাসার ডাকে ভিড়ে গেলাম। শ্রীঅরবিন্দ মহোৎসবের কমিটি তৈরি করা হল। সব বড় বড় মনীষী যেমন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ডঃ কালিদাস নাগ, লালগোপাল রায়, শ্রী বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়, শ্রী নির্মলচন্দ্র চ্যাটার্জি প্রমুখ যোগ দিলেন এই কমিটিতে। আমাকেও টানাটানি করে ভিড়িয়ে নিল প্রোগ্রাম কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করে।
বিমলচন্দ্র প্রথমেই যে কর্মসূচিটি গ্রহণ করেছিলেন সেটি হল, এই বিরাট কর্মকাণ্ড সফল করার জন্য তিনি কলকাতার একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেন এবং প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে সারা ভারতের গুণিজনদের উপস্থিত করার সম্মতি আদায় করেন। বাংলার প্রায় সমস্ত বিশিষ্টজনকে দিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন কমিটি। প্রতিটি আলোচনাসভার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ একটি মিনিট বইয়ে লিপিবদ্ধ করে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আজ সেই আলোচ্যসূচিই হয়ে উঠেছে এক অনবদ্য সংগ্রহ।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সই করা সেই চিঠি (সৌজন্য: লেখক)
উৎসবের চূড়ান্তপর্বের প্রথম আলোচনাটি হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১১ জুন কলেজ স্ট্রিটের শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরে। লালগোলারাজ ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায় ছিলেন এই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক। সমস্ত দেশবাসীর কাছে ইংরেজি ও বাংলায় দুটি আবেদন করা হয় এই অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য। সেই আবেদনে সই করেছিলেন বাসন্তীদেবী, মতিলাল রায়, তুষারকান্তি ঘোষ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা দত্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, কালিদাস নাগ, আলামোহন দাস প্রমুখ।
আলোচনাকারীদের সই করা সময়ের সেই দলিল! (সৌজন্য: লেখক)
মহোছসবের একটি দিন মধ্য কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্ক থেকে হাজরা পার্ক অবধি এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল, যার পুরোভাগে একটি বিশেষ সুসজ্জিত ট্রলিতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আলিপুর বোমা মামলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের: হেমচন্দ্র কানুনগো, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখ। তাঁদের নিজের চোখে দেখতে সেদিন কলকাতার হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।
বিচিত্র জীবন বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। যৌবনে রাজনীতি করেছেন বড়দা নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরবর্তী জাবনে জড়িয়ে পড়লেন শ্রীঅরবিন্দ আবির্ভাব মহোৎসবে। আরও পরে সুরের নেশায় বিভোর হলেন। মজিদ খাঁর কাছে তবলায় নাড়া বাঁধা। বাজাতে পারেতেন বাঁশি, বেহালা, শ্রীখোল, অর্গ্যান। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল না, এমন মানুষ পাওয়া ভার। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব কিছুদিন থেকেছেন তাঁর পৈতৃক বাড়িতে। রবিশঙ্কর, আলি আকবর খাঁ, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, হীরু গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো সঙ্গীতজ্ঞদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত ওঠাবসা। কাজি নজরুল ইসলাম, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, দাদাঠাকুর, উদয়শঙ্কর, ধীরাজ ভট্টাচার্যের তিনি ছিলেন অনুজপ্রতিম। শেষ বয়সে এলেন অভিনয়ে, অনুজ বন্ধু সত্যজিৎ রায়ের ডাকে। অভিনয় করলেন সোনারকেল্লা, জনঅরণ্য, জয়বাবা ফেলুনাথ, হীরকরাজার দেশে, ঘরে বাইরে এবং মৃণাল সেনের ছবি খারিজে।
বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গের প্যারাসাইকোলজিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনি। আর ছিল সংগ্রাহক হিসাবে তাঁর খ্যাতি। দেশী-বিদেশি দুষ্প্রাপ্য জিনিস বই ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিঠি ছিল তাঁর সংগ্রহে।
ওপার বাংলা থেকে আসা চিঠি (সৌজন্য: লেখক)
তাঁর সমস্ত সংগ্রহের দায় আমার। পুত্র হিসাবে সেগুলির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছি।