সাফল্যে গর্ববোধ আর অপরকে 'আওয়াজ' দেওয়ায় আনন্দ: কলকাতা ডার্বির জনপ্রিয়তা অটুট
কলকাতায় উত্তরে ঘটি আর দক্ষিণে বাঙালরা আটকে নেই, এখন তারা মিলেমিশে শহরজুড়ে
- Total Shares
ষাটের দশকের এক ফুটবলার এই গল্পটি করেছিলেন। সে বছর তিনি ইস্টবেঙ্গলে সই করেছেন। সেদিন নিজেদের মাঠে ইস্টবেঙ্গলের লিগের প্রায় শেষ পর্বের একটি ম্যাচ খেলার কথা ছিল। প্রাক্তন ফুটবলারটি স্কুটার পার্ক করে ক্লাব তাঁবুতে প্রবেশ করতে যাবেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি গেল এক প্রবীণ ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের দিকে। বেশ রুক্ষ খুস্ক চুল, গালে বেশ ক'দিনের না কাটা দাড়ি গোফ, চেহারাতেও যেন বেশ একটা নিষ্প্রভ ভাব।
সমর্থকটিকে ফুটবলারটি চিনতেন, মানে রোজই ক্লাবে দেখতেন। দল খারাপ খেললে অভিমানে হল্লা করতেন আবার ইস্টবেঙ্গল জিতলে আনন্দে নৃত্য করতেন। কোনও দিনও এই রকম নিষ্প্রভ দেখায়নি তাঁকে। সে বছরের লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে। সেদিন জিতলেই কাগজে কলমে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে। অথচ তিনি এরকম একটা চেহারায় ক্লাব তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে কী করছেন?
যারপর নাই আশ্চর্য হয়ে ফুটবলারটি কুশল বিনিময়ে করতে যাবেন। কিন্তু তার আগেই প্রবীণ সমর্থকটি বলে ফেললেন, "যাক, নিশ্চিন্ত হলাম! আসলে, আমার ছোট ছেলেটা দীর্ঘ রোগভোগের পরে আজ ভোররাতে গত হয়েছে। তাঁকে দাহ করে শ্মশান থেকে মাঠে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। আপনাকে তাঁবুতে ঢুকতে দেখে আশ্বস্ত হলাম যে খেলা এখনও শুরু হয়নি।"
ভাবা যায়! ছেলেকে দাহ করে সেদিনই পুত্র হারা পিতা ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে এসেছেন। শুধু ইস্টবেঙ্গল কেন, চিরশত্রু মোহনবাগান সমর্থকদের নিয়ে এমন মর্মস্পর্শী গল্প কান পাতলেই শোনা যায়। প্রাক্তন ফুটবলারের সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার কথা অবিশ্বাসের কোনও জায়গা নেই। আসলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের রেষারেষিটাই তো অনেকটা রূপকথার মতো। আর, রূপকথা হৃদয় স্পর্শ করবে না? তাই কখনও হয় নাকি?
শহরের পূর্বপ্রান্তে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ভারতীয় দল ফুটবল খেললে বা শহরের কেন্দ্রস্থলে ইডেন গার্ডেনসে ভারতীয় দল ক্রিকেট খেললে গোটা শহর তেরঙ্গা হাতে স্টেডিয়ামমুখী হয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশাত্মবোধ। ভারত খেলছে, অর্থাৎ আমাদের দেশের জাতীয় দল খেলছে। আইপিএল নিয়েও কলকাতাবাসীর আবেগের একটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। টুর্নামেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। অর্থাৎ এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শহরের নাম। তাই, কেকেআর-কে সমর্থন জানাতেও গ্যালারিতে উপস্থিত থাকে কলকাতাবাসী।
ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান নিয়ে উৎসাহের ঘাটতি অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও ধরা পড়ছে না [ছবি: পিটিআই]
তাই বলে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান নামক দুটি ক্লাব বাঙালির মননে এতটা আবেগের সঞ্চার করল কী করে?
এক বন্ধু মনোবিদের সঙ্গে কিছুদিন আগে ঠিক এই বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল। বন্ধুটি ফুটবল ভক্ত। ইস্টবেঙ্গলের অন্ধ সমর্থক। আর তাঁর দেওয়ার ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি একদম একমত।
মানুষ মাত্রই সাফল্যে গর্বিত হওয়ার পাশাপাশি অন্যকে 'আওয়াজ' দিয়েও আনন্দবোধ করে। ভারত বা কেকেআরের ম্যাচে সাফল্য পেলে গর্ববোধ করা চলে। কিন্তু কাউকে 'আওয়াজ' দেওয়ার সৌভাগ্য আর ক'জনেরই বা ভাগ্যে জোটে? সেই সুযোগ ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান সমর্থকদের অনেক বেশি। বস্তুত পক্ষে, ডার্বি ম্যাচের দিন এই দুটি ক্লাবকে কেন্দ্র ভাগ হয়ে যায় টালা থেকে টালিগঞ্জ। একে অপরের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে মেতে ওঠে আবালবৃদ্ধ বঙ্গবাসী। সব মিলিয়ে কোথাও যেন শহরজুড়ে একটি 'যুদ্ধ-যুদ্ধ' গন্ধ।
একটা সময়ে ছিল যখন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচকে কেন্দ্র করে রণংদেহী মেজাজ শুধুমাত্র অফিসকাছারিতেই লক্ষ করা যেত। অফিস ফেরত নিজেদের পাড়ার সান্ধ্য আড্ডাতে নয়। কিন্তু দিন যতই এগিয়েছে শহরের ঘটিরা শুধুমাত্র উত্তর কলকাতা আর বাঙালরা শুধুমাত্র দক্ষিণ শহরতলীর কলোনি এলাকাগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই। বৃহত্তর কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাদের বসবাস।
আজ তাই 'বাঙাল' দাশগুপ্ত বাড়ির প্রতিবেশী 'ঘটি' মুখোপাধ্যায় পরিবার। কালের নিয়মে বাঙাল বাড়ির বউ হয়েছেন ঘটি বাড়ির মেয়ে। আবার, উল্টোটাও হয়েছে। পাড়ার চায়ের দোকানের সান্ধ্য আড্ডাতেও তাই ঘটি-বাঙাল প্রতিবেশী ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান নিয়ে তর্ক করেন। ডার্বিতে এ জয়ে পেলে ওকে 'আওয়াজ' দেয় আবার ও জয় পেলে একে 'আওয়াজ' দেয়। সাফল্যে গর্ববোধের পাশাপাশি চিরশত্রুদের সামনে তাদের নিয়েই একটি ঠাট্টা মস্করা - কেমন যেন এক অনাবিল আনন্দ। যে দল হারবে সেই দলের সমর্থকরা তখন সব অপমান সহ্য করেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে - এক মাঘে শীত যায় না, দিন আমাদেরও আসবে।
অবশ্য শুধুমাত্র মানুষের চরিত্রের জন্যেই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া হয়নি। আবেপ্রবণ বাঙালির এই দুই ক্লাবকে ঘিরে আবেগের পিছনে ইতিহাসেরও প্রভূত ভূমিকা রয়েছে।
সেই ১৯১১ সালে সবুজ-মেরুন জার্সি পরে খালি পায়ে এগারোজন বাঙালি (এক জন অবশ্য বুট পরে খেলেছিলেন) গোরা পল্টনকে হারিয়ে শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। অনেকেই মনে করেন অসম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের সেই জয় শুধুমাত্র বাঙালির মননে নয়, দেশজুড়েই দেশাত্মবোধের সলতে পাকিয়েছিল। অনেকেই বিশ্বাস করেন, সেই শিল্ড ফাইনাল আদতে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। আর বাঙালি তখন থেকেই মোহনবাগান সমর্থক।
মোহনবাগানের সেই ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ের ন'বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। কথিত আছে ১৯২০ সালের কোচবিহার কাপের মোহনবাগান জোড়াবাগান ক্লাবের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯২০ সালের ২৮ জুলাই জোড়াবাগান মোহনবাগানের মুখোমুখি হয়েছিল। কোনও এক অজানা কারণে সেই ম্যাচে জোড়াবাগান দল থেকে বাদ পড়েছিলেন দলের প্রতিভাবান ডিফেন্ডার 'বাঙাল' শৈলেশ বসু। এতে যারপর নাই ক্ষিপ্ত হয়ে জোড়াবাগান ক্লাবের সহ-সভাপতি (যিনি নিজেও বাঙাল ছিলেন) ক্লাব ত্যাগ করেন। মাত্র চারদিনের মাথায়, ১৯২০ সালের পয়লা আগস্ট, তিনি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন।
ইস্টবেঙ্গল নামের বাংলা অর্থ পূর্ববঙ্গ। তাই পূর্ববঙ্গে (মানে মোটামুটি ভাবে অধুনা বাংলাদেশ) বসবাসকারী ফুটবল ভক্তরা এই ক্লাব সম্পর্কে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালি পূর্ববঙ্গ থেকে ভিটেমাটি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। 'গৃহহীন', সহায় সম্বলহীন পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের বেঁচে থাকার, আনন্দ পাওয়ার, গর্ববোধ করার অন্যতম শিখর হয়ে ওঠে এই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।
ফুটবল মাঠে ইস্টবেঙ্গলের জয় মানে তাদেরও জয়। ফুটবল মাঠে ইস্টবেঙ্গল জয়ে মানে ভিটেমাটির ছেড়ে আসা দুঃখ বেদনা ভুলে একদিনের জন্যে হলেও কিঞ্চিৎ আনন্দ উপভোগ করা। প্রতিদিন বেঁচে থাকার অক্লান্ত লড়াইয়ের থেকে কিছুটা সময়ের জন্য মুক্তি। সেই আবেগ আজও বাঙালদের তাড়া করে বেড়ায়।
ফেসবুক সোশ্যাল মিডিয়া যুগে এই আবেগ যেন আরও ঘন হয়েছে। এখন আর চায়ের দোকান বা অফিসকাছারিতে যেতে হয় না, সোশ্যাল মিডিয়াতেই একে অপরকে 'আওয়াজ' দেওয়া যায়। মাঠে না গেলেও নেটে ম্যাচের সরাসরি স্কোর দেখে নেওয়া। আর, স্কোর নিজেদের অনুকূলে হওয়া মানেই তৎক্ষণাৎ সোশ্যাল মিডিয়াতে বিপক্ষ দলের সমর্থককে 'আওয়াজ' দেওয়া। সব মিলিয়ে, উন্মাদনার পারদ যে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী।
তাই তো, ২০১৮ সালের শেষলগ্নে দাঁড়িয়েও ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে ঘিরে আপামর বাঙালি আবেগপ্রবণ। কলকাতা ফুটবলের 'ডার্বি' ম্যাচের জৌলুস অবশ্য কোনও অংশে অ্যাসেজ কিংবা ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট সিরিজের চেয়ে কম নয়। অদূর ভবিষ্যতে এই আবেগে ভাঁটার পড়ার কোনও কারণ এখনও অবধি কোনও শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও ধরা পড়ছে না।