চারদিনে আর সীমাবদ্ধ নয়, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ দুর্গোৎসব এখন সপ্তাহব্যাপী
নব্বইয়ের দশকে মেরেকেটে আড়াই দিনেই শেষ হয়ে যেত পুজো পরিক্রমা
- Total Shares
সেই সময় পুজোর কয়েকদিন আগে শহরের বড় বড় পুজো মণ্ডপগুলোকে নিয়ে একটি ম্যাপ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হত কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে। আজও এই প্রথা বিদ্যমান। কিন্তু এখন সেই মানচিত্রটিকে কেমন জানি বেখাপ্পা লাগে। আগের থেকে তা এখন অনেক বেশি অপরিষ্কার। আসলে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহরের অনেক 'ছোট' পুজোই এখন 'বড়' হয়ে গিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে সেই মানচিত্র প্রকাশিত হলেই বন্ধুরা মিলে বৈঠকে বসে পড়তাম। ঠিক করে নিতাম কোনোদিন শহরের কোন প্রান্তের পুজোগুলো দেখতে যাব। সঙ্গে, বানিয়ে ফেলা হত একটা সম্ভাব্য রুট ম্যাপ। যাতে রাতের বেলা, ভিড় ঠেলে বাড়ি ফিরতে অসুবিধা না হয়।
সাধারণত, সপ্তমীর দিন আমরা রাসবিহারী অ্যাভেন্যুতে জমায়েত করে মেট্রো বা বাসে চড়ে শ্যামবাজার পৌছাতাম। তার পর সেখান থেকে কখনও সেন্ট্রাল অ্যাভ্যেনু বা কখনও এপিসি রোড ধরে একের পর এক বড় প্যান্ডেলগুলো ঘুরে দেখতাম। সপ্তমীর অভিযানে আমাদের শেষ গন্তব্য নেবুতলা (রাজা সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার) হয়ে শিয়ালদাহ অ্যাথেলিটিক। এই রুট ম্যাপের একটি কারণও রয়েছে। আমরা বন্ধুরা দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। শিয়ালদাহে শেষ মণ্ডপটি দর্শন করে শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরতে সুবিধা হবে বলে।
এখন মহালয়ার পর থেকেই পুজো পরিক্রমা শুরু হয়ে যায় [ছবি: পিটিআই]
অষ্টমীতে আমাদের গন্তব্য ছিল দক্ষিণ কলকাতার পুজো মণ্ডপগুলি। সেই সময় যাদবপুর বা সন্তোষপুরের পুজোগুলোর এতটা নামডাক হয়নি। সেলিমপুর বা যোধপুরপার্কেই 'বড়' পুজোর চৌহদ্দি শেষ। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে যতদ্রুত সম্ভব একডালিয়া এভারগ্রীন দেখতে হবে। সন্ধ্যে নামার পর একডালিয়া মণ্ডপে প্রবেশ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এর পর আসতে আসতে দেশপ্রিয় পার্ক, শিবমন্দির, মুদিয়ালী সেরে আমাদের শেষ গন্তব্য পার্কস্ট্রিট। অষ্টমীর রাতের নৈশভোজ বলে কথা। এই রুট ম্যাপের পিছনেও একটা কারণ রয়েছে। শিবমন্দির বা মুদিয়ালী দেখে শরৎ বোস রোডে হেটে আসা যেত। আর এই রাস্তায় 'বড়' কোন পুজো কমিটি না থাকায় সহজেই পার্কস্ট্রিট পৌছিয়ে যাওয়া যেত।
নবমীর দিন কিছুটা সময় বিধাননগর ও লেকটাউনের পুজোগুলো দর্শন করে কোথাও একজটা বসে নিখাদ আড্ডা।
চারদিনের পুজো। আড়াই দিনেই দর্শন শেষ। কারুর মনে কোনও আফসোস নেই। কারণ, শহরের প্রতিটি 'বড়' পুজোর ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স তখন আমাদের পকেটে।বাড়ির বড়োরাও সেই সময় গাড়ি ভাড়া করে সারারাত ঠাকুর দেখতে বেরোতেন। কিন্তু তাদের সেই মণ্ডপ অভিযানও আড়াই দিনেই সীমাবদ্ধ ছিল।
উদ্বোধনী অনুষ্টানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে [ছবি: পিটিআই]
এখন অবশ্য আড়াই দিনে পুজো পরিক্রমা শেষ করা যায় না। রীতিমতো, পাঁচ-ছয়ে দিন ধরেই মণ্ডপে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। আর, এর পিছনে রয়েছে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ।
১) 'বড়' পুজো
কলকাতায় শহরে নতুন পুজোর অনুমতি দেওয়া হয় না কলকাতা পুজোর পক্ষ থেকে। শেষ কয়েক বছরে তাই শহরে পুজোর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু গত দেড় দশকে শহরে 'বড়' পুজোর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক পুজো কমিটিই শেষ ১৫ বছরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সন্তোষপুর, বেহালা, ভবানীপুর বা ভিআইপি রোডের বেশ কিছু পুজো এই শেষ ১৫ বছরে পুজো পরিক্রমার তালিকায় আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। পুজোর সংখ্যা পাল্লা দিয়ে ভোর বৃদ্ধির সৌজন্যে মানুষের আর আড়াই দিনে কলকাতার পূজন দর্শন হয় না।
২) উদ্বোধন
শুধু তো আর দর্শনার্থীদের ইচ্ছেতে পুজো পরিক্রমা সম্ভব নয়। এর জন্য আয়োজকদেরও দর্শণার্থীদের মণ্ডপে ঢুকতে দিতে হবে। শহরের অনেক পুজো কমিটির উদ্বোধন এখন মহালয়ের পর থেকেই শুরু হয়ে যায়। আর, উদ্বোধন হয়ে যাওয়া মানেই দর্শণার্থীদের অবাধ প্রবেশ।
এর জন্যে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটাই কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পুজো উদ্বোধনে তৃণমূল নেত্রীর চাহিদা তুঙ্গে। আর, মুখ্যমন্ত্রীও খুব একটা পুজো কমিটিগুলোকে নিরাশ করেন না। মহালয়ার পর থেকেই তিনি বেরিয়ে পড়েন একের পর এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বাঙালিও জেনে গিয়েছে পূজামণ্ডপে মমতার উপস্থিত মানেই পরের দিন থেকেই সেই মণ্ডপে সাধারণ দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারেন।
৩) ভিড় এড়ানো
অনেকেই আছেন যাঁরা ভিড়ের কারণে প্রতিমা দর্শন বা মণ্ডপ দর্শনে যেতেন না। তাদের কাছে এ এক সুবর্ন সুযোগ। ষষ্ঠীর আগে যতই দর্শনার্থীদের প্রবেশ অবাধ করে দেওয়া হোক না কেন, দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেকটাই কম থাকবে। আর, এই সুযোগটাই নিতে চান তারা।
সব মিলিয়ে, বাঙালির শ্রেষ্ট উৎসব এখন আর চারদিনে সীমাবদ্ধ নয়। এখন লিখতে বসলে লিখতে হয় সাত দিন ব্যাপী দুর্গোৎসব।