পূজা-অর্চনার সময় হিন্দুরা কেন প্রদীপ জ্বালান?
বৈদিক যুগে প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা ছিল না
- Total Shares
প্রদীপ জ্বালানো হিন্দু পুজোর আবশ্যিক ব্যাপার। বৈদিক যুগে অবশ্য প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা ছিল না। কারণ তখন হোম-যজ্ঞ হত। মনে করা হয় যে বৈদিক হিন্দুত্বের বাইরেও যে সনাতন ধর্ম রয়েছে সেখান থেকে এই প্রথাটি এসেছে। যদিও বৈদিক হিন্দুত্বের বাইরে যে সনাতন ধর্ম রয়েছে সে সম্বন্ধে আমরা খুব একটা জানি না। যবে থেকে হিন্দুরা সাকার দেব-দেবীর পূজা শুরু করে তবে থেকে এই প্রথা শুরু। ভাগবত গীতার ৯.২৬ শ্লোকে ভগবান কৃষ্ণ বলছেন যে শুধু মাত্র একটি ফল, একটি ফুল, গাছের একটি পাতা ও অল্প জল দিয়ে যদি ভক্তরা তাঁকে পুজো করেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। এই শ্লোকটিতে ভগবান কৃষ্ণ কোথাও দীপ জ্বালানোর কথা বলেননি।
সমস্ত হিন্দুর মধ্যে, তা সে বৈদিক হোক বা পৌরাণিক, নিগমীয় হোক বা অগমীয় অথবা শ্ৰৌত বা স্মার্ত-- তাঁদের পুজোর ধরন অনেকটা একই রকম: তাঁরা প্রথমে ঈশ্বরকে আহ্বান করেন, তারপর তাঁকে নৈবেদ্য উৎসর্গ করে ভক্ত সেই প্রসাদ পান। এরপর ভক্ত তাঁর কাছে কোনও বর চান। সব শেষে বিসর্জন।
বৈদিক যুগে এ ভাবেই ঈশ্বরের পুজো হত। তখন প্রদীপের জায়গায় ছিল মাটির হোমকুণ্ড। হোমকুণ্ডে কাঠ জ্বালান হত। এই যজ্ঞকুণ্ডকে পূজা করা হত ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হত, সঙ্গে চলত বৈদিক মন্ত্রপাঠ।
দু'হাজার বছর আগে যখন পুরাণ রচিত হল, তখন ঈশ্বর আর নিরাকার রইলেন না, ওই সময় তাঁরা সাকার হয়ে উঠলেন। সেই সময়ের পুজোর সঙ্গে এখনকার পুজোর অনেক মিল পাওয়া যায়। পুজোর অঙ্গ হিসেবে যেমন - স্নানাভিষেক, বস্ত্র, নৈবেদ্য, গন্ধদ্রব্য, ধুপ ও দীপ সহযোগে পুজো শুরু হয়। এই পুজোয় অবশ্য ঘৃতাহুতি দেওয়ার জন্য আগুন জ্বালানো হত না, পুজোর চারপাশ যাতে আলোকিত হয়ে ওঠে, কোথাও কোনও অন্ধকার না থাকে সে জন্য আলো বা দীপ জ্বালানো হত।
ছবি:জয়পুরের ঘরানার প্রদীপ
এই প্রথায় আগেকার যুগে ভারতে গাছ, পাথর, নদী, পাহাড়, রক্ষ এমনকী সাপকেও ঈশ্বররূপে পুজো করা হত। তখন সন্ধ্যা নামলে লোকজন তাঁদের ঘরে বাতি জ্বালাতেন যাতে পথচারীরা প্রয়োজন হলে সেই বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারেন। এমনকি এখনকার দিনেও অনেকে সদর দরজার আলো জ্বেলে রাখেন, যাতে পথচারীর কোনও সমস্যা না হয়। মূলত মাটির প্রদীপ জ্বালানোর রীতি থাকলেও, ধনীরা পিতলের প্রদীপ জ্বালাতেন। কেউ তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালাতেন, গোপালকরা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালাতেন। কে কেমন প্রদীপ জ্বালাবেন, সেটা যে তাঁর সাধ্যের উপরে নির্ভর করত, তা স্পষ্ট। তা ছাড়া পারিবারিক রীতি এবং সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব তো ছিলই।
দীপ বা আলোকের নানা ধরণ হত। যেমন বাড়ির কর্ত্রী যে দীপ জ্বালতেন, সেই দীপের আগুন ছিল যজ্ঞের আগুনের থেকে একদম আলাদা। যজ্ঞশালায় ব্রাহ্মণ হোম করার জন্য আগুন জ্বালাতেন। যজ্ঞশালার আগুন আবার ধুনির আগুনের থেকে থেকে আলাদা। সন্ন্যাসীরা ধুনি জ্বালাতেন। ধুনী জ্বালাতে ইটের কোনও বেদী তাঁরা ব্যবহার করতেন না। বনের কাঠপাতা দিয়ে আগুন জ্বালানো হত। যজ্ঞের আগুনে একটা ঘরোয়া ব্যাপার থাকত। হিন্দুরা যখন থেকে যাযাবরদের মতো এদিক সেদিক ঘোরা বন্ধ করে স্থায়ী ভাবে বসবাস ও চাষবাস করতে শুরু করল, তখন থেকেই তারা তাদের বাড়ির আঙিনায় বাতি দেওয়াও শুরু হল।
ধনীদের বাড়িতে একাধিক প্রদীপ জ্বালানো হত। যে কোনও অনুষ্ঠানেও প্রদীপ জ্বালান হত। বাড়ির দেওয়াল সাজান হত প্রদীপ দিয়ে। উৎসবের সময় নদীতে ও ছোট পুকুরে ছোট নৌকা গড়ে প্রদীপ দিয়ে সাজিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হত। লণ্ঠন জ্বালিয়ে একটা উঁচু মাচা বা বাঁশের সঙ্গে সেই লণ্ঠনকে বেঁধে দেওয়া হত। তারপর সেই লণ্ঠনটিকে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত। একে বলে কান্দিল বা আকাশদীপ।
ছবি:উইকিমিডিয়া কমন্স
দার্শনিকদের মত বলতে হলে বলতে হবে যে, জীবকুলে মানুষই একমাত্র যে আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই সন্ন্যাসীদের ধুনি থেকে যজ্ঞশালার আগুন, সেখান থেকে লক্ষ্মী ঠাকুরের পুজোর জন্য দীপ জ্বালান: প্রদীপের এ হেন দীর্ঘ যাত্রাপথের হাত ধরে আমাদের সমাজের সংস্কৃতিও অনেক বদলে গেছে। প্রদীপ যে শুধু সংস্কৃতি বদলের সাক্ষ্যপ্রমাণ দিচ্ছে তাই নয়, দীপের বদল জানান দেয়, মানুষ এখন সমৃদ্ধি থেকে প্রাচুর্যের ঘরে এসেছে। প্রত্যেকটা বড় বড় মন্দিরের ছাদে জ্বালানো থাকত প্রদীপ। এত থেকে বোঝা যেত হিন্দুদের মন্দির আর প্রাসাদের অবস্থান কোথায়। পুরাণে রয়েছে যে, আগুনের একটা স্তম্ভের মাধ্যমে ভগবান শিব পৃথিবীতে পদার্পন করেছিলেন। এই একই বিশ্বাস থেকে মহারাষ্ট্রে মানুষ একটা খুব উঁচু স্তম্ভে বসিয়ে রাখে একটি প্রদীপকে।
নানা শিল্পকলায় দেখা যায় যে দেব-দেবীদের হাতের তালুতে আগুন জ্বলছে, এবং তাদের চুল থেকে সেই আগুনের জ্যোতি বেরোচ্ছে। তাই আগুনের একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। পুরাণে আগুনকে প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আগুন এমন যে সবকিছু কিছু গ্রাস করতে পারে, আবার এই আগুনে তাপ মনে শান্তি আনে, জ্ঞান প্রদান করে। তাই কালীপুজোর সময় প্রদীপ জ্বালানো হয়। দেশের কোথাও কোথাও দীপাবলির দিনই নতুন বছর শুরু হয়। দেবদেবীর আহ্বান করার জন্য লোকজন নিজেদের বাড়িতে প্রদীপ জ্বালান। প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবদেবীর মধ্যে প্রথমে ভগবান রামকে ও তারপর সমৃদ্ধির দেবী ভগবান লক্ষ্মীকে আহ্বান করা হয়।