ডিজিটাল যুগে কলকাতার রেডিয়ো চ্যানেলগুলো এক অদ্ভুত বৈচিত্র্যহীনতায় ভুগছে
আগে জকিদের দেখা যেত না, এখন ফেসবুকে লাইক বাড়াতে হয় উৎকর্ষতা প্রমাণে
- Total Shares
আজকের বাণিজ্যিক রেডিয়ো কি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থানের কারণে বিপন্ন? বাণিজ্যিক রেডিয়োর গ্রিনরুমে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে একটাই কথা, শুধু রেডিও নয়, ডিজিটালি ভাব। ডিজিটাল, ডিজিটাল, ডিজিটাল! রেডিয়ো হোক না হোক, ডিজিটালটা যেন হয়। পাঁচ বছর আগেও আমরা এই উত্তেজনা দেখিনি। তাহলে হঠাৎ কেন এই বিপন্নতাবোধ? এই ক্রাইসিস কি তৈরি করা, নাকি, এটার সত্যিই কোনও ভিত্তি আছে? কেন তৈরি হচ্ছে এই সব সংলাপ? আসুন উত্তর খোঁজা যাক!
রেডিয়োর প্রতিশ্রুতি
কেন শুনেছি রেডিও আমরা? কেন আজও লোকে রেডিয়ো শোনে? রেডিও কী দেয় আমাদের? বিনোদন। কিসের মাধ্যমে? গানের মাধ্যমে, তথ্যের মাধ্যমে, জমাটি উপস্থাপনার মাধ্যমে। তাছাড়া, রেডিয়ো হল 'নন অবস্ট্রুসিভ' মিডিয়াম। অর্থাৎ, কাজ করতে করতে রেডিয়ো শোনা যায়। গাড়ি চালাতে চালাতে রেডিয়ো শোনা যায়। আর, এছাড়া রেডিয়োর সঙ্গে মানুষ ইন্টার্যাক্ট করতে পারে। রেডিওর উপস্থাপক হয়ে ওঠে 'কাছের মানুষ' কারণ তার সঙ্গে কথা বলা যায়, যোগাযোগ করা যায়। রেডিও একটা 'পার্সোনাল' মিডিয়াম।
ন্যাশনাল চ্যানেলগুলো প্রাদেশিক ভাবধারাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে
ডিজিটালের প্রতিশ্রুতি
ডিজিটাল যে বিল্পবটি ঘটালো, সেটা হল-- জনগণের হাতে বেছে নেবার ক্ষমতা তুলে দিল। আমি কী গান শুনব, সেটা আমি ঠিক করব। আমি গান না শুনে খেলা দেখতে পারি, খবর পড়তে পারি, সিনেমা দেখতে পারি, নিজে ব্লগে লিখতে পারি, ফেসবুকে বক্তব্য রাখতে পারি। আমার যা ইচ্ছে আমি করতে পারি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের সামনে সাজিয়ে দিল অবাধ ব্যক্তি-স্বাধীনতা।
রেডিয়ো বনাম ডিজিটাল মাধ্যম
ডিজিটাল যে বিশাল জগৎ আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে, তার সঙ্গে রেডিয়ো বা টেলিভিশন বা প্রিন্টের কোনো তুলনা চলে না। আমাদের আঙুলের ডগায় মহাপৃথিবীকে তুলে এনেছে ডিজিটাল। কিন্তু, তার মানে কি এই, যে আগামীর পৃথিবীতে শুধু ডিজিটাল থাকবে, আর বাকিরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে? এটা হওয়া কখনও সম্ভব? কই পাশ্চাত্যে তো এই সংশয় নেই। তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। তারা তো কই 'গেল গেল' রব তুলছে না। সেখানে দিব্যি রেডিও চলছে রেডিয়োর মতো। ডিজিটাল ডিজিটালের মতো। কিন্তু, এদেশে এই রব উঠছে কেন? এটার পেছনে অন্য একটা ভাবনা কাজ করছে ওদেশে, যেটা হয়তো এখানে করছে না। আর সেই কারণেই হয়ত ভারতের বাণিজ্যিক রেডিওতে একটা ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে।
পাশ্চাত্যের রেডিয়ো বৈচিত্র্যময়, কত অজস্র রকমের মিউজিককে তারা প্রমোট করছে [ছবি: রয়টার্স]
বাণিজ্যিক রেডিয়োর জলছবি
পাশ্চাত্যের রেডিয়ো বলতেই যেটা সবচেয়ে চোখে পড়ে, সেটা হল, ওদের অজস্র ফরম্যাটের রেডিয়োর উপস্থিতি। কেউ ক্ল্যাসিক্যাল বাজাচ্ছে তো কেউ রক। কেউ লোকসঙ্গীত বাজাচ্ছে তো কেউ জ্যাজ। কিন্তু আমাদের দেশের বাণিজ্যিক রেডিয়ো চ্যানেলগুলো প্রায় সবই এক ধরনের। তাদের সাউন্ডস্কেপ প্রায় এক। আমাদের দেশে মূলত দুধরনের ফরম্যাট রয়েছে- CHR বা কন্টেম্পোরারি হিটস্ আর রেট্রো। কোনও কোনও রেডিয়ো স্টেশনে অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল হিটস্ও চালানো হয়। কোথাও কয়েক ঘণ্টা গজল। কিন্তু এর বাইরে প্রায় আর কিছু নেই। কেন নেই, তার পেছনে একটা কারণ আছে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ (সবাই নয়) বাণিজ্যিক রেডিয়ো পৌঁছতে চাইছে ১৮-২৫ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। তাদের কথা মাথায় রেখেই সাজানো হয় রেডিয়োর অনুষ্ঠান। যে গান, যে কথা এই বয়সের শ্রোতাদের ভালো লাগবে না, সেই গান, সেই অনুষ্ঠান চালানো হবে না। এর কারণস্বরূপ তুলে ধরা হচ্ছে একটি বাণিজ্যিক যুক্তি। যুক্তিটি কী? ১৮-২৫ বছরের শ্রোতারা ইমপ্রেশনেবল্ অর্থাৎ তাদের প্রভাবিত করা যায়। তাদের নামী দামি ব্র্যান্ডের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। তাদের চকচকে ঝকঝকে জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। কিন্তু তারা জানে না যে তারা কোন প্রোডাক্টটা কিনবে। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আর ঠিক এই জায়গায় ঢুকে পড়ছে ব্র্যাান্ডগুলি। এখানেই তাদের উর্বর জমি। নবীন প্রজন্মের হাতে তুলে দাও অজস্র অপশন, যাতে তারা বিভিন্ন অপশন চেখে দেখে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে ২৫-৩০-এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়। এর পর তাদের প্রভাবিত করা শক্ত। তাই তাদের জন্য আলাদা করে বিজ্ঞাপন দিয়ে লাভ নেই। আর সেই জন্য বাণিজ্যিক রেডিয়োর কাছে বয়স্ক শ্রোতাদের কোনও জায়গা নেই। এবং এর ফলে বিশাল একদল শ্রোতা রেডিয়ো শোনা বন্ধ করে দিচ্ছ। এতে, আমার মতে রেডিয়োর একটা মস্ত ক্ষতি হচ্ছে।
একঘেয়ে বৈচিত্র্য হীন গানের সম্ভার, এবং লোকাল ফ্লেভারহীনতার কারণে মানুষ রেডিও শোনা কমিয়ে দিচ্ছে, ডিজিটালের জন্য নয়
কলকাতার বাণিজ্যিক রেডিয়ো
এদিকে, কলকাতার বাণিজ্যিক রেডিও চ্যানেলগুলো এক অদ্ভুত বৈচিত্র্যহীনতায় ভুগছে। কন্টেম্পোরারি হিটস এবং রেট্রো ছাড়া আর কিছুই চলে না। আস্তে আস্তে রেট্রো মিউজিকও অস্তগামী। এরপর হয়তো কন্টেম্পোরারি হিটস্ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। অন্যদিকে বেসিক অ্যালবামের গান খুব কম চলে আর চললেও তা পুরোনো। সাম্প্রতিক কালের বেসিক ডিস্ক চলে না। ফোক নেই, গজল নেই, ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক নেই, রবীন্দ্রসঙ্গীতও কমে এসেছে। আছে মূলত হিন্দি সিনেমার গান সঙ্গে কয়েকটা বাংলা ছবির গান।
কিন্তু পাশ্চাত্যের রেডিও বৈচিত্র্যময়, কত অজস্ররকমের মিউজিককে তারা প্রমোট করছে। এবং তার জন্যে নিশ্চয়ই অর্থের প্রয়োজন। সেটা তারা জোগাড়ও করছে। কী করে? তাদের বিজনেস মডেলটা কী? সেটা কি আমরা জানবার চেষ্টা করেছি?
ভারতীয় তথা কলকাতার বাণিজ্যিক রেডিও বর্তমানে গা বাঁচিয়ে চলতে চায় এবং এই রেডিয়োর কোনও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব আছে বলে মনে হয় না। রেডিয়ো কী ভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে, সমাজকে, সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে, রেডিয়ো কতটা বৈচিত্র্যময় হতে পারে, তা আকাশবাণী করে দেখিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, গত দশ-বারো বছরে বাণিজ্যিক রেডিয়োতেও আমরা অসাধারণ কিছু অনুষ্ঠান শুনেছি, অসাধারণ কিছু উপস্থাপকদের পেয়েছি, বাংলার বেসিক গানের জনপ্রিয়তার পেছনে অবশ্যই বিশেষ করে একটি এফ এম চ্যানেলের মারাত্মক অবদান ছিল।
কিন্তু এখন সে সব অতীত। সে সব দিন এখন আর নেই।
ন্যাশনাল ও প্রাদেশিক
আরও একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে ইদানীং বাণিজ্যিক রেডিয়োতে, সেটি হল, ন্যাশনাল চ্যানেলগুলো প্রাদেশিক ভাবধারাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে। কলকাতার মানুষ কী চাইছে, সেটা দিল্লি, মুম্বাই বা বেঙ্গালুরুতে বসে কী করে বোঝা যাবে? রেডিয়ো হল লোকাল মাধ্যম। প্রাদেশিক সেন্টিমেন্ট না বুঝলে রেডিয়োর সঙ্গে মানুষের সংযোগ হবে কী করে? কিন্তু, ন্যাশনাল স্তরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা এ কথা মানতে নারাজ। সেখানেই একটা গুরুতর সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রাদেশিক রেডিয়ো তার প্রাদেশিক স্বাদ হারিয়ে ফেলছে।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে, একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন গানের সম্ভার, একটি বিশেষ এজ গ্ৰুপের জন্যে কন্টেন্ট এবং লোকাল ফ্লেভারহীনতার কারণে মানুষ রেডিয়ো শোনা কমিয়ে দিচ্ছে, ডিজিটালের জন্য নয়। রেডিয়োয় শোনার মতো জিনিস না পেয়ে, সে ডিজিটালের দিকে ধাবিত হচ্ছে কারণ সেখানে সে তার পছন্দের জিনিসটা পাচ্ছে।
রেডিয়োর ডিজিটাল উন্মাদনা
এই মুহূর্তে ভারতের বাণিজ্যিক রেডিও খানিকটা দিশেহারা। তারা নিজেরাই বুঝতে পারছে না যে তারা কী চাইছে। ডিজিটাল না রেডিয়ো! একসময়ে উপস্থাপক বা রেডিও জকিরা শুধু তাঁদের কনটেন্ট নিয়ে ভাবতন। তাঁদের দেখা যেত না। তাঁদের ঘিরে একটা রহস্যের আবরণ ছিল। কিন্তু, এখন একজন রেডিয়ো জকিকে তার উৎকর্ষতা প্রমাণ করতে হয় ফেসবুকে লাইক বাড়িয়ে, চেহারা দেখিয়ে, ফলোয়ার বাড়িয়ে, ডিজিটাল ভিডিয়ো করে, ফেসবুক লাইভ করে। অর্থাৎ বিরাট কোহলিকে শুধু ক্রিকেট খেললেই হবে না, তাঁকে ফেসবুকে জনপ্রিয় হতে হবে-- তবেই তিনি খেলোয়াড়, নয়তো নন।
পরিসমাপ্তি
রেডিয়োর সঙ্গে ডিজিটালের কোনো বিরোধ আছে বলে আমি মনে করি না। বর্তমানে ভারতের বাণিজ্যিক রেডিয়োতে যে ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে, তা ইচ্ছাকৃত ভাবে তৈরি করা হয়েছে। ডিজিটাল কখনও রেডিয়োর জায়গা নিতে পারবে না। দুটো মাধ্যম দু'রকম। কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়তে গেলে রেডিয়োকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে হবে, খোলনলচে পাল্টে এগোতে হবে। হয়তো কোথাও মেকি কথাবার্তা, মেকি হাল্কা সংলাপ ছেড়ে আরও স্বাভাবিক, সহজ অথচ ওজনদার হয়ে উঠতে হবে। যদি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, হটস্টারের যুগে বিদেশে রমরমিয়ে রেডিয়ো চলতে পারে, তা হলে এ দেশেই বা সেটা হবে না কেন? রেডিয়ো স্টেশনের হাতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিজের ব্র্যান্ডকে ছড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হয়ে উঠুক, কিন্তু রেডিয়ো চ্যানেলগুলো যদি রেডিয়ো নিয়ে না ভেবে ডিজিটালে ডুবে যায়, সে ক্ষেত্রে ভারতীয় রেডিয়োর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠবেই!