রণবীরের কেন বিয়েতে লেহেঙ্গা পরা উচিত হবে না? তাঁর থেকে পুরুষরা যা শিখতে পারেন
দীপিকা পাড়ুকোন যদি বিয়েতে নৈশভোজের পোশাক পরেন আপনি কি এতটাই অবাক হবেন?
- Total Shares
কয়েকদিন আগেই তাঁদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বিয়ের কথা ঘোষণা করেছেন অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন ও অভিনেতা রণবীর সিং। স্বভাবতই প্রত্যেকেই বেশ আলোড়িত। তাঁদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবরা তো বটেই, যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তাঁরাও বেশ আলোড়িত ছিলেন।
সারা দিন ধরে তাঁদের বিয়ের খবরই প্রচার করে যাচ্ছিল সমস্ত সংবাদমাধ্যম আর যত রকম সোশ্যাল মিডিয়া রয়েছে, অন্তত ভারতে যেগুলো রয়েছে, তার সবগুলোতেই সারাদিন ধরে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল এই বিয়ের খবর। বিয়ের মতো একটা বিশেষ দিনে তাঁরা কে কী পোশাক পরতে পারেন সে বিষয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছিল।
তিনি কী পরবেন এখনও সে কথা কেউ জানে না: লেহেঙ্গায় রণবীর সিং মোটেই নতুন নন (ছবি : ইন্ডিয়া টুডে)
আমি একেবারেই পোশাক বিশেষজ্ঞ নই, তবে রণবীর সিংকে যে ধরনের পোশাক পরতে দেখি আমি অন্তত মূলধারার হিন্দিছবির কোনও নায়ককে আগে কোনও দিন সেই ধরনের পোশাক পরতে দেখিনি। শুধু তাই নয়, হাফপ্যান্ট পরে শুধুমাত্র আমার নিজের ঘরের মধ্যে যেমন ভাবে স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করি উনি সেই ধরনের পোশাক পরে জনসমক্ষে একেবারে সেই ধরনের স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করেন, বলা ভালো, লোকসমক্ষে নেচে বেড়ান।
তবে যে মুহূর্তে তাঁর বিয়ের খবর প্রচারিত হল, সেই মুহূর্ত থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার নানা ধরনের চুটকি পোস্ট শুরু হয়ে গেল যে ওই বিশেষ দিনে তিনি ঠিক কী পোশাক পরতে চাইবেন এবং কী ভাবে সেই দিনের অনুষ্ঠান শেষ হবে একটি লেহেঙ্গা তাঁর ও দীপিকার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। আমি তখনই গুগল করে রণবীরের লেহেঙ্গা পরিহিত ছবি দেখলাম – তাঁরা যে কথা বলছিলেন – তেমন বহু ছবি দেখলাম রণবীরের।
কেউ হয়তো বলতে পারেন যে এটা অতি সাধারণ একটা ব্যাপার – অত শব্দ জানি না বলে বলতে পারি – এটা রীতিবিরুদ্ধ এক শৈলী।
তবে একটা বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে ভাবনার দরকার আছে।
আচ্ছা, একটা দৃশ্য কল্পনা করুন যেখানে বিয়ের অতিথি আপ্যায়নের সময় রণবীর ও দীপিকা দু’জনে দু’টি টুক্সেডো বা নৈশভোজের বিশেষ জ্যাকেট পরে আছেন। আমার সন্দেহ আছে যে কেউ মজা করে এ কথা বলবেন কিনা, দীপিকা কী ভাবে রণবীরের ওয়াড্রোব থেকে সেই পোশাকটি হাতিয়ে নিয়েছেন – আসলে আমরা অবচেতন মনে ভাবি যে সফল নারীরা স্যুট পরেন।
উল্টোটা অবশ্যই ব্যতিক্রমী।
কারণ সাধারণ ভাবে যে পোশাক নারীদের পরতে দেখেই আমরা অভ্যস্ত সেই পোশাক যদি পুরুষ পরেন তা হলে সেটি তাঁর পৌরুষের সঙ্গে খাপ খায় না বলেই আমাদের চিরাচরিত বিশ্বাস।
স্কার্ট পরিহিত মহাশয়: বিভিন্ন সময়ে রণবীরকে কালো রংয়ের স্মার্ট স্কার্ট পরতে দেখা গিয়েছে...
... আর এই হল তাঁর পিনস্ট্রাইপ পোশাক,
আর এটা খুব সম্ভবত পালাজো,
আর এটা হল লুঙ্গি ও তোয়ালের মাঝামাঝি কিছু একটা (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
ঘটনা হল আমরা কেউই ওই ধরনের বিশ্বাস নিয়ে জন্মাইনি। কোনও শিশুকে যদি বনে ছেড়ে দেওয়া হয় সে হয়তো মোগলির মতো জংলি হয়ে বেড়ে উঠবে, হয়তো ১৯৪০-এর গোড়ায় সেই জার্মান নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে ১৩ বছর বয়সের যে ছোট্ট মেয়েটা চিলেকোঠায় কোনওরকমে লুকিয়ে পড়েছিল সেই হয়ে উঠল বিশ্বের সর্বকালের সেরা দিনলিপিকার। আমরা সব জীবই আমাদের পারিপার্শ্বিকতার উপরে নির্ভর করে বেড়ে উঠি, সেই একই ভাবে পৌরুষও সমাজের তৈরি করে দেওয়া একটা ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয়। অক্সফোর্ড অভিধান পৌরুষের যে অর্থ ব্যাখ্যা করেছে তার বাংলা তর্জমা করলে হয় – পুরুষের চারিত্রিক গুণাবলি বলতে যা বোঝানো হয় সেটিই পৌরুষ।
তবে সংজ্ঞায় বলা হয়নি যে কী ভাবে ওই গুণাবলি সেই ব্যক্তির মা-বাবা, তার পরিবার এবং আরও বৃহৎ অর্থে সমাজ সেগুলি তুলে ধরবে।
শৈশব থেকেই আমাদের খেলার জিনিসগুলি আলাদা হয়ে যায় – মেয়েদের দেওয়া হয় পুতুল আর ছেলেদের গাড়ি এবং বন্দুক।
আরেকটু বড় হয়ে তারা যখন স্কুলে যেতে শুরু করে তখন থেকেই আমাদের ও ওদের মধ্যে পার্থক্য করতে শুরু করে দেয় তাদের পোশাক দেখে: ছাত্রীদের জন্য স্কার্ট অথবা সালোয়ার (ভারতে) এবং ছাত্রদের জন্য প্যান্ট – সকলেই যে এক সেই ধারনা তৈরি করার জন্য একই রং থাকে বটে তবে একই সঙ্গে ‘ওরা’র ধারনাও প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।
ভারতের ছাত্ররা কলেজে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে বুঝে যায় যে তারা একটি গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে, তারা সেই গোষ্ঠীর মধ্যে ধূমপান করতে শেখে, মদ্যপান করতে শেখে, অন্য দলের সঙ্গে মারামারি করে আর অন্য দলটাও সেই একই কাজ করে থাকে।
যদি না করেন তা হলে আপনাকে বলা হবে বালকসুলভ, মেনিমুখো, ক্যাবলা বা এই ধরনের কিছু একটা। কখনোই আপনাকে মদ্দ বা পুরুষালী বলা হবে না।
আমাদের ছায়ীছবিগুলোতে যতক্ষণ পর্যন্ত সেই মেয়েটি রাজি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নায়ক তার পিছনে পড়ে থাকে আর মন্দ লোকেদের থেকে নায়িকার সম্মান রক্ষা করে সেই নায়ক, তা তিনি না করলে তাঁর ছবিতে তাঁর ভূমিকা খাটো হয়ে যায় অথবা তাঁর ভূমিকাকে পার্শ্বচরিত্র বলে মনে হয়। এই বৃত্ত আবর্তিত হতেই থাকে।
সবাই এক রকম নয়: স্কুলে ইউনিফর্ম চালু থাকলেও ছাত্র ও ছাত্রীদের পোশাক আলাদাই হয় (ছবি: পিটিআই /ফাইল)
টক্সিক মাসকুলিনিটি (ভীষণ ভাবে পুরুষালী) শব্দটি এসেছে মেসোপোয়েটিক মেনসস মুভমেন্ট থেকে ‘১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে সহায়তা করে তাদের বর্ণনা করার জন্যই,’ উইকিপেডিয়া অনুযায়ী এমন একজন শক্তপোক্ত পুরুষ যিনি মহিলাদের রক্ষা করতে পারেন।
এই শব্দটি আজকাল খুবই ব্যবহার করা হচ্ছে, বিশেষ করে #মিটু ঝড় যখন এই আধুনিক দুনিয়াকে আঘাত করেছে তখন থেকে, তখন থেকেই সমাজে বেশ কয়েকটি অতি দরকারি সংস্কৃতিগত ও আচরণগত বদল শুরু হয়েছে।
এটি হল পুরুষদের পুরুষালী ভাব অতিমাত্রায় ফুটিয়ে তোলা – তারা মনে করে দল বেঁধে একসঙ্গে পানভোজন করাই যেন জীবনের একমাত্র মোক্ষ এবং তারা যা কিছু দেখে সেই সবকিছুকেই উপহাস করে।
টক্সিক মাসকুলিনিটি বলতে বোঝায় শারীরিক ক্ষমতা – মনুষ্যত্ব কমিয়ে আরও বেশি মারমুখী হয়ে ওঠা আর কাপুষদের প্রতি ঘৃণাভাব পোষণ করা।
এই রকম সময়েই এক একজন রণবীর সিং আমাদের সামনে এলেন যাঁকে আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না, আমরা তাঁকে ঠাট্টা করি, বিদ্রুপ করি, হাসাহাসি করি এমনকি গালিগালাজও করি কারণ আমরা আমাদের মাথায় যে বিভিন্ন ধরনের ভাবনা-চিন্তার পরিসর নিয়ে জন্মেছি বেড়াই তার কোনওটিকেই তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারি না।
আমরা কল্পনা করি আর তার সঙ্গে মেলাই!
ঠিক এই কারণেই আমাদের, মানে পুরুষ ও নারী উভয়েরই, তাঁর থেকে দু’একটা জিনিস অন্তত শেখা উচিত, তা হল কী ভাবে নিজের পৌরুষ পুরোমাত্রায় বজায় রেখে জনসমক্ষে উপনীত হওয়া যায়।
আরকটা কথাও বলতে হয়, ওই ঠাট্টা-তামাশাগুলো এখন জলো, বোকাবোকা, সাদামাটা ও একঘেঁয়ে হয়ে গেছে।
আমরা যদি সকলে একই নিয়ম অনুসরণ করি তা হলে আমরা একে অপরের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠব (উপস্থাপনামূলক চিত্র: রয়টার্স)
আমার এক খুড়তুতো ভাই, যার বয়স এখনও কুড়ি ছোঁয়নি, প্রায়ই ফতুয়ার মতো ঢোলা জামা পরে ও জপমালা দিয়ে ছবি পোস্ট করে, কিছুদিন আগে চুলের একাংশ সোনালি করেছিল, সে কানে ঝোলা দুল পরে, কালো নখপালিশ লাগায় আর শরীরে ট্যাটুও করেছে। সব ছবিতে যেটা দেখা যায় তা হল অদ্ভুত ভাবে সে হাসছে। সে বড়ই অদ্ভুত, সব সময়ই একটা হাসি হাসি ভাবের মধ্যে থাকে। এটাই তার মধ্যেকার অদ্ভুত ভাব হয়তো তার পরিবারের লোকজন তার মধ্যে অদ্ভুত কিছু দেখতে পায় না। আমরা কিছু না বুঝে তাদের দোষও দিতে পারি না। কারণ আমার ওই ‘অদ্ভুত’ খুড়তুতো ভাইয়ের মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠার মধ্যে কখনও কোনও বিরোধিতা আসেনি।
তবে এই অদ্ভুত ভাবকে অমাদের মান্যতা দিতেই হবে এবং এমন কিছু করাও ঠিক হবে না যে যাতে নিজের বাড়িতে থাকতেই তার মনে হবে যে সে যেন অন্য কোনও গ্রহ থেকে এখানে এসেছে। অথবা তার বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের মাঝে থাকার সময়ও তার এই ধরনের কোনও অনুভূতি যেন না হয়।
নচেত এমন একদিন আসবে যেদিন আমরা একে অপরের কাছে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে পারব না। আর তখন আমার ওই উনিশ বছরের ভাইপো জড়সড় হয়ে থাকবে, তার ভিতরটা উথালপাথাল করতে থাকবে আর তার ওই পরিচিত হাসিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে