অকল্পনীয়: বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে জনগণ সামান্য একটা ছবি দেখা থেকেও বঞ্চিত হয়
দেশের প্রতিটি রাজ্যই লঙ্কা, আর লঙ্কায় বরাবর রাবণরাই ক্ষমতায় থাকেন
- Total Shares
এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। আমরা মানে ভারতীয়রা। দেশ জুড়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমদের সংবিধান বাকস্বাধীনতার সীকৃতি দিয়েছে। অথচ তা মানা হয়। সৃষ্টিশীল কোনও কিছু পছন্দ না হলেই কেউ কেউ সেই সৃষ্টি ধ্বংস করতে মত্ত হয়ে উঠছেন।
শুনলাম, শাসক দল নাকি পছন্দ করছে না বলে একটি হিন্দি ছবি এ রাজ্যের সিনেমা হলগুলোতে মুক্তি পাচ্ছে না। যে কোনও ছবি তৈরি হয় দর্শকদের জন্য। দর্শক পছন্দ করলে একটি ছবি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পছন্দ না করলে সেই ছবি আর বাজারে চলে না। কিন্তু যে ছবি দর্শকদের জন্য তৈরি সেই ছবি দেখা থেকে দর্শকদের কী ভাবে বঞ্চিত করা যেতে পারে? তা কখনই করা যায় না, গণতন্ত্রে তো আরও বেশি করে করা যায় না।
'দাঙ্গা: দ্য রায়ট' ছবিটি এখন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। এই ছবিতে শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে নায়ক হিসেবে দেখান হয়েছে বলেই কী তা পশ্চিমবঙ্গের কোনও হলে মুক্তি পায়নি? রাজ্যের বিরোধী দলের জনপ্রিয় নেতাকে কেন্দ্র করে যদি কোনও ছবির প্লট তৈরি হয় তাহলে সেই ছবি দেখাতে বাঁধা কোথায়? বরঞ্চ মুক্তির পর এই ছবির দর্শক সমাগমই তো ঠিক করে দিত যে এ রাজ্যের মানুষের মধ্যে সেই নেতার গ্রহনযোগ্যতা ঠিক কতটা।
রাজ্যের মানুষের কাছে শ্যামাপ্রসাদের গ্রহনযোগ্যতা প্রেক্ষাগৃহে দর্শক সমাগম ঠিক করে দিত
রাজনৌতিক নেতাদের বাদ দিন, দেশের 'সেন্সর বোর্ডের' কর্তারাও তো ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন যে তাঁরা সত্যি সত্যি সেন্সর বোর্ডের কর্তা। কিন্তু বোর্ডটির নাম তো সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন। অর্থাৎ তাঁদের মুখ্য কাজ একটি ছবি দেখে যাচাই করা যে ছবিটি কোন বয়েসের দর্শকদের জন্য উপযুক্ত। অথচ এখন ছবি থেকে দৃশ্য বাদ দেওয়াই তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু দৃশ্য কেন সংলাপও কাটছাঁট করা হচ্ছে। একটা ছবিতে যদি গুজরাট শব্দটি উচ্চারণ করা হয় তাহলে সমস্যাটা কোথায়? তার জন্য সেই সংলাপ কেটে ফেলতে হবে কেন? ভালো না লাগলে দর্শকই তার জবাব দেবে।
এই বোর্ডের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে গেলেও মুক্তি নেই। এবার আবার রাজনৌতিক দলগুলোর সবুজ সঙ্কেত পেতে হবে। তাঁদের জন্য বেশ কিছু রাজ্যে মুক্তি পায়নি 'পদ্মাবৎ'। এবার আরও একটি ছবি রাজনৈতিক কোপের মুখে পড়ল। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করছেন যে নবজাগরণের বাংলায় সৃষ্টিশীল কাজের উপর কোপ পড়ছে বলে আমি অবাক হচ্ছি কিনা। একদমই না। কারণ ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যই লঙ্কা। আর লঙ্কার ক্ষমতা সর্বদাই রাবণরা দখল করে এসেছেন।
কলকাতা নাকি দেশের সংস্কৃতি রাজধানী। আমার মতে এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা যা আমরা ছোটবেলা থেকে পোষণ করে আসছি। রাজ্যের বা দেশের অন্যত্র সংস্কৃতি নিয়ে অনেক ভালো ভালো কাজ হচ্ছে। মানছি এ রাজ্যে একটা সময় নকশাল আন্দোলন বা বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে গুলো তো আদতে নীতির লড়াই ছিল। আজকাল নীতি নিয়ে কেউই খুব একটা মাথা ঘামান না তাই আন্দোলনও আর হয় না। তৃতীয় শক্তি বলতে আমরা যা বুঝি, অর্থাৎ জনগণ যাঁরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবেন তাঁরা এখন শাসক শিবিরের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। তাহলে, আন্দোলন কে করবে?
দেশের পরিস্থিতি এখন অনেকটা মধ্যে প্রাচ্যের স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো
দেশের পরিস্থিতি এখন অনেকটা মধ্যে প্রাচ্যের স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো। যুদ্ধটা বাদ দিলে ভারতের সঙ্গে সিরিয়ার তফাৎ খুব একটা নেই। আমাদের দেশেও জনগণ কোনও কথা বলতে পারেন না। ভালো ছবি দেখার ইচ্ছে থাকলেও শাসক দলের অনিচ্ছার জন্য আপনি তা দেখতে পাবেন না। ভাবতে পারেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে সামান্য একটা ছবি দেখা থেকেও জনগণকে বঞ্চিত করা হয়।
তবে আমি কিন্তু এখনও আশাবাদি। কারণ, দেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাচ্ছে শাসকরা যখনই বাড়াবাড়ি করেছে জনগণ জবাব দিয়েছেন। কখনও পথে নেবে, কখনও বা নীরবে, নিভৃতে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি আমি।