'৭১-এর সেই দিনগুলো ভুলতে দেন না মৃণাল সেন
পাড়ার ভালো মেধাবী ছেলেদের কাদের কাদের যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না
- Total Shares
ছোটবেলার কিছু স্মৃতি এবং মৃণাল সেন...
গত কদিন ধরে মনটা বেশ বিষণ্ণ এবং খারাপ। না, তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় বা সাক্ষাৎ হয়নি কখনও যদিও আমার আত্মীয়-কাছেরজনদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ পরিচয়। আমি শুধুই ছিলাম তাঁর গুণমুগ্ধ এবং ভক্তও বটে। তাই অনেকবার ইচ্ছে করেছে একবার বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে আসি তাঁকে কিন্তু শুনেছিলাম সচরাচর প্রণাম তিনি করতে দেন না কাউকেই। তাই শেষপর্যন্ত আর সাহসে কুলিয়ে ওঠেনি। দূর থেকেই শ্রদ্ধা করে এসেছি তাঁকে।
মৃণাল সেন (সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)
আমি জানি এরকম আমি একা নই, আপামর বাঙালিদের মধ্যে আমার মতো এরকম অনেকেই আছেন যাঁরা, তিনি চলে যাবার পর এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করেছেন হৃদয়ে। আর এখানেই বোধহয় একজন চলচিত্র-নির্মাতা হিসেবে তাঁর সার্থকতা। তিনি বাঙালি সমাজজীবনের এমন এক তন্ত্রীর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন যে তাঁর চলে যাওয়া মনের মধ্যে একান্ত আপনজনের বিয়োগব্যথার জন্ম দেয়।
গতকাল দেখছিলাম পদাতিক। তার আগে কলকাতা ৭১। বাড়িতে এখন একটা রেট্রোস্পেক্টিভ চলছে নিজেদের মধ্যেই। খারিজের ডিভিডিটা পাইরেটেড ভার্সন ছিল, কিছুক্ষণ চলার পর ছবি চলতে লাগলো ধীর গতিতে আর সাউন্ড ট্র্যাক লাফিয়ে লাফিয়ে। ফ্রিজ হয়ে যেতে থাকল বারবার আর তার মধ্যে আমার মনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়গুলো...
কলকাতা ৭১ (ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব)
আমি তখন নেহাতই ছোট। রাত্রিবেলা ব্ল্যাক আউট। কে যেন এসে চিৎকার বলে যেতেন- আলোগুলো বন্ধ করে দিন... বন্ধ না করলে বাড়ি এসে রীতিমতো ধমক: বম্বিং হলে ভালো হবে? বাবা গিয়ে তাড়তাড়ি ব্রাউনপেপার কিনে মুড়ে দিল বাড়ির জানলার শার্সিগুলো।
পাড়ার ভালো মেধাবী ছেলেদের কাদের কাদের যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাশের বাড়ির ডাক্তার-মেসোকে রাতদুপুরে নিয়ে যায় পাড়ার দাদারা ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য অথবা আহত কারোর শুশ্রূষা করার জন্য। ফিসফিস করে কে যেন বলে- জানিস ওদের বাড়ি থেকে রাতে রোজ রুটি যায়...। কোথায়-? কোনও উত্তর নেই। বড়দের মুখ থমথমে, আগলে রাখেন উঠতি ছেলেদের। অনেকে বিদেশে চলে যায় পড়তে...।
ঘুমোতে যাবার আগে আধো তন্দ্রার মধ্যে শুনতে পাই পেটো আর সোডার বোতল ছোড়াছুড়ির শব্দ। একদিন সকালবেলায় বাবা হাত ধরে নিয়ে যায়: রাস্তায় উর্দিপরা রাইফেলধারী সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি সার দিয়ে যাচ্ছে। বরাহনগর থেকে এক আত্মীয় আসেন একটা ফুটো ট্রানজিস্টর রেডিয়ো নিয়ে। রাতে জানলা ফুটো করে গুলি ঢুকে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে পাইপগানের গুলি। বাবার অফিসে লক-আউট যেদিন শুরু হলো আমি জন্মেছিলামই তো সেদিন!
কলকাতা ৭১ ছবির পোস্টার
দাদা বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, চিন্তিত মা রাতে আমাকে নিয়ে রাস্তায়- কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় কারা যেন ফলো করছিল দাদাদের...। প্যাচপ্যাচে গরমে দুপুর রোদের বাসে দাঁড়িয়ে ঘামছি- রাস্তা জুড়ে লাল পতাকা নিয়ে চলেছে দীর্ঘ মিছিল। হাওড়া স্টেশনের বাইরে কঙ্কালসার বহু মানুষ ইতস্তত বসে আছে এদিক ওদিক- শূন্যদৃষ্টি নিয়ে। বাংলাদেশ বর্ডার থেকে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের রিপোর্টিং করে চলেছেন আরেক মামা, কাগজ পড়িতে পারি না কিন্তু গোটা গোটা ইংরেজি হরফে শুধু হেডলাইন আর নামটা পড়তে পারি তাঁর।
আর এ সবের মধ্যেই একএক করে মুক্তি পেতে থাকে তাঁর নতুন নতুন চলচ্চিত্র। যেগুলো দেখে আসার পর বাড়ির বড়রা মেতে ওঠে তর্জায়। আমিও দেখবো একদিন সেইসব, আরেকটু বড় হবার পর...।
এ রকমটাই ছিল আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়ের একটা অংশ। আজ হয়তো সে সব অতীত, আজকের ছোটরা জানে না সেই সব। কিন্তু মৃণাল সেন আমাদের তা ভুলতে দেবেন না কখনও, বিবেকের মধ্যে দংশায়, কী যেন একটা বোধ কাজ করে...।