মোগলসরাই স্টেশনের নাম বদল করে ইতিহাস বদল করা যাবে না
আগেও বদলেছে অনেক স্টেশনের নাম, বিতর্ক দীনদয়াল উপাধ্যায়কে নিয়ে
- Total Shares
“মোগলসরাই প্ল্যাটফর্মে এখনও এমন অনেক উনুন আছে, যে উনানে আগুন কোনও দিন নেভেনি। ওই স্টেশনে তো মিনিটে মিনিটে ট্রেন, তা ছাড়া সব বদলে যায়, ইঞ্জিন-ড্রাইভার-গার্ড-টিটি—স-অ-ব।”
বেশ কয়েকবার শুনেছিলাম সেই স্টেশনের কথা, রেলে চাকরি করা পিসেমশাইয়ের থেকে। তারপরে সম্ভবত ১৯৯০ সালে জীবনে প্রথম বার সেই স্টেশনে নামলাম। উনুনে ভাজা হচ্ছে বড় বড় লুচি, আটার তৈরি। জানলাম, একেই বলে পুরী। শালপাতায় চারটে দিয়ে উপরে শব্জি, মানে আলুর ঝাল তরকারি।
আধঘণ্টা মতো ট্রেন থামে। ভীষণ হুড়োহুড়ি। মালপত্রের পাহারায় মহিলারা, পুরুষরা কেউ স্নান করছেন প্ল্যাটফর্মের ট্যাপে, কেউ প্ল্যাটফর্মের বাইরে গেছেন ভালো খাবার আনতে। পাঁউরুটি ও কলা কিনে নিচ্ছেন অনেকে, অন্য কোনও স্টেশনে এতক্ষণ ট্রেন থামবে না। ভরা হচ্ছে জলের বড় বড় বোতল। তখন বোতলবন্দি জলের অত চল ছিল না।
এবার বদলাচ্ছে মোগলসরাই স্টেশনের নাম
যাঁরা সাবেক দ্রুত গতির চেপে দিল্লি যেতেন দিনে-দিনে পৌঁছবেন বলে, তাঁদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত ছিল। পাটনায় জলখাবার, মোগলসরাইয়ে মধ্যাহ্নভোজ, কানপুরে চা। বাকিগুলো ঠিকঠাক না হলেও, মোগলসরাইয়ে দুপুরের খাওয়াটা একটা ব্যাপার ছিল। সাবেক ডিলাক্স গাড়ির (নামবদলে পূর্বা) যাত্রীদের কাছেও এই স্টেশেনের প্রতি আবেগ আছে, অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ভোররাতে মোগলসরাইয়ে নেমে বারাণসী যাওয়ার অভিজ্ঞতাও অন্যরকম।
সময়ের সঙ্গে বদলেছে মোগলসরাই। উনুন নিভেছে প্ল্যাটফর্মের, প্ল্যাটফর্মে নেই সেই সব ট্যাপগুলোও, যেখানে কোনও মতে স্নান করা যেত। এ বার বদলে যাচ্ছে নামটাও। পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে হচ্ছে এই স্টেশন। শতবর্ষে সম্ভবত এটাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের।
উত্তরপ্রদশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নাম পরিবর্তনের সুপারিশ করেন, তা নিয়ে দেশের সংসদে বিতর্ক হলেও শেষ পর্যন্ত এই পরিবর্তনে সায় দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এ বার দরকারি বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়ে গেল, বাকি রইল শুধু পুরোনো নামটা মুছে ফেলে নতুন নাম লিখে দেওয়া— দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর জংশন , ব্যস।
এটুকু করলেই ইতিহাস বদলে যাবে? মোগলসরাই নামটার সঙ্গে অনেকের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে, আবেগ জড়িয়ে আছে।
এই স্টেশনের সঙ্গে জড়িত বহু মানুষের স্মৃতি
যতদূর জানা যায়, হুমায়ুনকে পরাজিত করে পেশোয়ার থেকে অধুনা কলকাতার পূর্বপাড় পর্যন্ত মৌর্যদের ব্যবহৃত পথ সংস্কার করেন পাঠান শাসক শের শাহ সুরি। পথের নাম হয় সড়ক-ই-আজম। তার আগে শের শাহের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার সময় এখানে নাকি তাঁবু ফেলেছিলেন মোগল শাসক হুমায়ুন। তিনি শের শাহের কাছে পরাজিত হন। শের শাহের মৃত্যুর পরে তাঁর উত্তরাধিকারীদের থেকে এই জায়গা আবার তিনি উদ্ধারও করেন।
১৮৬২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি হাওড়া থেকে শুরু করে মোগলসরাই পর্যন্ত লাইন পেতে ফেলে, আরও চার বছর লেগে যায় তৎকালীন ভারতের রাজধানীর সঙ্গে দিল্লির রেল যোগাযোগ স্থাপন করতে।
বারাণসী থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে যে জায়গায় অনেক পথিক ও পর্যটক বিশ্রাম করতেন, সেই জায়গাই লোকমুখে মোগলসরাই নামে পরিচিত হয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশের চান্দৌলি জেলার এই জায়গাতেই অনেকেই নাকি রাত্রিবাস করতেন। ধীরে ধীরে এই জায়গা মোগলসরাই নামে পরিচিত হয়।
ব্রিটিশদের হাতে পতন হয় মোগল সাম্রাজ্যের। শের শাহের সড়ক-ই-আজম নাম বদলে গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোড করে দেয় ব্রিটিশরা। ইতিহাস মনে রেখেছে সে সব কথা। যেমন ইতিহাস মনে রেখেছে মহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজধানী করেছিলেন দৌলতাবাদ, দেবগিরির নাম বদল করে, লক্ষ্মণাবতী হয়েছে লখনউ, লবপুর হয়েছে লাহোর। শেষ দুটি জায়গার নাম জোর করে বদল করা হয়েছে এ কথা অবশ্য শোনা যায় না।
নাম বদল করলে ইতিহাস যে বদলে ফেলা যায় না, সে কথা অবশ্য মনে রাখতে হবে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে। আলিনগরের নাম আর্যনগর, মিয়াঁ বাজারের নাম মায়া বাজার আর উর্দু বাজারের নাম হিন্দি বাজার করে দিয়ে তিনি যদি ইতিহাস বদলের বার্তা দিতে চান, তাতে তিনি ব্যর্থই হবেন।
তবে এমন নয় যে এ দেশে স্টেশনের নাম বদল করা হয়নি বা এই প্রথম স্টেশনের নাম বদল হচ্ছে। মোগলসরাইয়ের নাম নিয়ে বিতর্কের প্রধান কারণ হল, যাঁর নাম ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁর নামের সঙ্গে আরএসএস এবং সঙ্ঘপরিবার যুক্ত এবং স্টেশনটির নাম মোগলসরাই।
মধ্যপ্রদেশের মহাউ স্টেশনের নাম ভীমরাও আম্বেদকরের নামে করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে কোথাও কোনও বিতর্ক নেই। একই সঙ্গে বলে রাখা দরকার, মোগল-ই-আজম, মোগলাই পরোটার নাম বদল হবে কিনা এ নিয়ে যাঁরা চিন্তিত, তাঁদের উদ্বেগের কারণ নেই। মুম্বইয়ের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসের নাম বদলে ছত্রপতি শিবাজির নামে করার পরেও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, ভিক্টোরিয়ান এরা, ভিক্টোরিয়ান এটিকেট – কোনও নামেই বদল হয়নি।
মুম্বাইয়ের ভিটি স্টেশন- দু'বার নাম বদলেছে
মোগলসরাই স্টেশনের সঙ্গে জনসঙ্ঘ নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের সম্পর্ক হল, ১৯৬৮ সালে মোগলসরাইয়ের একটি প্ল্যাটফর্মের অদূরে পাওয়া যায় তাঁর দেহ। দু-জনকে আটকও করা হয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই মামলায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়নি। ১৯৭০ সালেই এই স্টেশনের নাম বদলের প্রস্তাব উঠেছিল। তবে তথন তা সম্ভব হয়নি। প্রথমত তখন ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তাই এই প্রস্তাবে তাঁর সায় দেওয়ার প্রশ্ন নেই। দ্বিতীয়ত তখন নাম বদল করা এত সহজ ছিল না। সমস্ত টিকিটে নাম বদল করা, সব যন্ত্রে নতুন নাম দেওয়া সহজ ছিল না। তখন তো আর কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ছিল না।
মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসের নামের সঙ্গে গত বছর জুড়ছে মহারাজ শব্দটি, এ জন্য স্টেশনের কোড পরিবর্তন করা হয়েছে, সিএসটি-র বদলে করা হয়েছে সিএসএমটি। মহারাজ শব্দটি যোগ করে স্টেশনটি মহিমান্বিত হল নাকি শিবাজি মহিমান্বিত হলেন, বোঝা দায়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত স্টেশনটির নাম ছিল ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস, কোড ছিল বিবি। এখনও অনেক ট্যাক্সিওয়ালা এই জায়গাটিকে ভিটি (ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস) বলে চেনেন। বর্তমানে এটি বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল।
রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এ রাজ্যে যেমন জুবিলি ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল, বম্বেতে এই স্টেশনটি তৈরি হয়েছিল এর নকশা করেছিলেন ফ্রেডারিক উইলিয়াম স্টিভেনস। খবরে প্রকাশ, নামবদলের প্রস্তাবটি করেছিল মধ্যরেল এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয় মহারাষ্ট্র বিধানসভায়।
পশ্চিমরেলও মুম্বই শহরেই এলফিনস্টোন রোড স্টেশনের নাম বদলে স্থানীয় আরাধ্যা প্রভাদেবী করতে চায় বলে খবর। আর এক ধাপ এগিয়ে মুম্বইয়ের একটি স্টেশনের নাম রামমন্দির করতে চায় মহারাষ্ট্র সরকার। এই রামমন্দিরের সঙ্গে অবশ্য অযোধ্যার কোনও সম্পর্ক নেই, স্টেশনের কাছে একটি রামমন্দির আছে, তাই এলাকাটিকে লোকে রামমন্দির নামেই চেনে বলে মহারাষ্ট্র সরকারের যুক্তি।
বদল হয়েছে ব্যাঙ্গালোর সিটি স্টেশনের নাম
কর্নাটকে বদলেছে ব্যাঙ্গালোর সিটি স্টেশনের নামও, ক্রান্তিবীর সঙ্গোলি রায়ান্নার নামে। মধ্যপ্রদেশে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে হচ্ছে বিআর আম্বেদকরের নামে। এ রাজ্যেও বদলেছে স্টেশেনের নাম। টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের নাম হয়েছে মহানায়ক উত্তমকুমার। হাসাহাসি হয়েছে, বিতর্ক হয়নি।
এই বদলের ফলে পরিষেবায় কোনও বদল হয়নি। মোগলসরাইয়ের নাম বদল হলেও কত জন বলবেন দীনদয়াল উপাধ্যায়ে যাব সে কথা বলা মুশকিল, যদিও তার কোড ডিডিইউ ব্যবহার করতেই হবে। প্রথমদিকে স্টেশনের কোড হিসাবে লোকে সেই এমডিএস খুঁজবেন অবশ্য, পরে অভ্যাস হয়ে যাবে।