সারঙ্গনাথে প্রথম গড়া হয়েছিল বৌদ্ধ সঙ্ঘ, সদস্য ছিলেন ৬০ জন
সব স্তূপের গঠন কেন ওল্টানো বাটির মতো হয়, তারও ব্যাখ্যা আছে
- Total Shares
জরা ব্যধি ও মৃত্যু থেকে মুক্তির কি সত্যিই কোনও উপায় নেই? উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন শাক্যসিংহ সিদ্ধার্থ বা গৌতম। গয়ার কাছে তিনি বোধি লাভ করলেন। তারপরে নতুন পথ চলা শুরু। অবশেষে পৌঁছালেন সেই মৃগদাবে, সেখানে গিয়ে প্রথম শিষ্যদের শোনালেন তাঁর উপদেশ-বাণী।
স্মৃতিচিহ্ন: সারনাথে সেই মৃগদাব
মৃগদাব মানে হরিণের বন। এখানে অবাধে চরে বেড়াত হরিণের দল। এখনও একঝাঁক হরিণ রয়েছে, তবে অবাধ বিচরণ করার উপায় আর নেই। হরিণ বা সারঙ্গের দেবতার নামে ছিল জায়গার নাম, সারঙ্গনাথ। ইতিহাসবিদদের ধারণা, সম্ভবত সারঙ্গনাথ নাম থেকেই উৎপত্তি সারনাথের। এখানেই ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। ধর্মচক্র প্রবর্তন মানে প্রথম উপদেশ দান, পাঁচজনকে প্রথম তিনি শিষ্যত্ব দান করেন। সারনাথে পাওয়া কুষাণযুগের একটি লিপি থেকে সে কথা আংশিক ভাবে জানা যায়।
সারনাথে বৌদ্ধ উপাসনাস্থলের একাংশ
চার সারস্বত সত্যের কথা এখানেই প্রথম প্রচার করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ—পৃথিবীতে দুঃখ আছে, সেই দুঃখের কারণ কী, দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় কী এবং শান্তির জন্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। নির্বাণের পথও দেখান তিনি।
গৌতম বুদ্ধেরও আগে থেকে শুরু করে ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়েছিল সারনাথ। কিন্তু পাল যুগের পরে ১০১৭ সালে মহম্মদ গজনির আক্রমণের পরেই গৌরব হারায় সারনাথ। ১০২৬ সালেও মহীপালের দুই ভাই স্থিরপাল ও বসন্তপাল এখানে দু’টি স্তূপ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পদক্ষেপ করেছিলেন।
ধমেক স্তূপ
ধীরে ধীরে অজ্ঞাতে-অগোচরে চলে যায় এই জায়গা। বারাণসীর রাজা চেত সিংহের দেওয়ান জগৎ সিং স্রেফ বাড়ি তৈরির উপকরণ জোগাড় করার জন্য ১৭৯৩-৯৪ সালে এখানে খনন শুরু করেন। কিন্তু ইট খুলতে গিয়ে পেয়ে যান একটি শ্বেতপাথরের কৌটোর মধ্যে রাখা হাড়, সোনা-রুপোর গয়না, মুক্তো ও অন্য দামি পাথর। সেটি তিনি পেয়েছিলেন ১০২৬ সালের একটি মূর্তির পাশ থেকে। অনেক পরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (এএসআই) জেনারেল আলেকজান্ডার কানিংহ্যামের কাছে সেটি যায় এবং তিনি বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটিতে সেটি প্রদান করেন।
ধমেক স্তূপের কাছে উপাসনাস্থল
১৮১৫ সালে এখানে প্রথম উৎখনন শুরু করেন কর্নেল কর্নেল সি ম্যাকেঞ্জি। ১৮৩৪ সালে আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম উৎখনন শুরু করেন ধমেক স্তূপ ও চৌখণ্ডী স্তূপে। জুয়াং জ্যাং (ইউয়েন সাং)-এর বিবরণের সঙ্গে মিলে যায় এই জায়গার বর্ণনা। চৌখণ্ডী স্তূপের কাছেই নাকি প্রথম উপদেশ দিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। যাঁরা বারাণসী থেকে সারনাথে বেড়াতে যান, তাঁদের অনেকেই খেয়াল করেন না এই জায়গাটা। তবে যে সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সারনাথে তীর্থ করতে যান, তাঁরা এই স্তূপ প্রদক্ষিণ করেন, স্তূপের সামনে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। ধূপ আর দীপ জ্বালান। কী করে জানা গেল এই স্তূপের কথা, আর কেন এই স্তূপের শীর্ষে ইসলামিক স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে সে কথায় আসা যাবে, কিন্তু সব স্তূপই কেন প্রায় একই রম দেখতে হয়?
গৌতম বুদ্ধ ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন এই শহরেই
এর একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে। যখন ভিক্ষু বা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা কোথাও যেতেন, তখন তাঁদের কাছে থাকত মোটে দু’টি জিনিস, ভিক্ষার পাত্র ও বস্ত্র। তাঁরা শিষ্যদের যখন স্তূপ তৈতির করতে শেখালেন, তখন বস্ত্র পাট করে তার উপরে বাটিটি উপুড় করে রাখতেন, যেমন আকার হত, তা দেখেই স্তূপ নির্মাণ করতেন। স্তূপের ভিতরটা হত ইট দিয়ে গাঁথা, কোনও ফাঁকা জায়গা থাকত না। একেবারে ভিতরে অনেক সময় প্রকোষ্ঠ থাকত।
চৌখন্ডী স্তূপ, উপরের অংশে মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনচৌখণ্ডী স্তূপের উপরে যে ছ’কোণা অংশ রয়েছে, সেটি অবশ্য মোগল আমলে তৈরি। রাজা তোডরমলের ছেলে গোবর্ধন ছিলেন এই অঞ্চলের রাজ্যপাল। ১৫৮৮ সালে মোগল সম্রাট আকবরের ছেলে জাহাঙ্গির (যিনি আকবরের পরে সম্রাট হন) এখানে এক দিনের জন্য এসেছিলেন, তাঁর আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতেই এই অংশ তৈরি হয়েছিল। একটা কথা বলে রাখা দরকার, যে অশোকস্তম্ভ আমাদের জাতীয় চিহ্ন বা ন্যাশনাল এমব্লেম, সেটি পাওয়া গিয়েছিল এই সারনাথেই।