কেন বলিউড 'কাল্পনিক ইতিহাস' ধর্মী ছবি বানানো এড়িয়ে চলে?
মির্জা গালিবের কথায় বলা যেতে পারে, "ইউ হোতা তো ক্যা হোতা"
- Total Shares
ভালো করে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে ভারতীয় সিনেমায় বা টেলিভশনে খুব সুচিন্তিত ভাবেই 'কাল্পনিক ইতিহাস' (অল্টারনেট হিস্টোরি) ধর্মী কোনও রকম অনুষ্ঠান দেখানো হয় না। এটা একটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার।
ফিলিপ কে ডিকের লেখা অসাধারণ বইটি 'দা ম্যান ইন দা হাই ক্যাস্টল' প্রথম ১৯৬০ সালে জনপ্রিয়তা পায়, তারপর ২০১৫ সালে বইটিকে একটি টিভি অনুষ্ঠানের রূপ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ২০০০ সালে প্রয়াত ফিলিপ রথের লেখা 'দা প্লট এগেইনস্ট আমেরিকা'-কে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের রূপ দেওয়া হয় এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানের রূপ পায় স্টিফেন কিংয়ের বই '১১/২৩/৬৩'। বইটি ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। টেলিভশন অনুষ্ঠান হিসেবে এইধরণের বইগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
অল্টারনেট হিস্টোরি বা কল্পনিক ইতিহাস
ভারতীয় সিনেমা বা টেলিভিশনে এই ধারার অনুষ্ঠানের অভাব আরও সুস্পষ্ট হয় যখন জনসাধারণ ও সমাজের কিছু বক্তা বলেন যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব না থেকে যদি ভারতীয় ক্রিকেট টিম এক হয়ে খেলতে পারতো তাহলে নিঃসন্দেহে ভালো হতো কিংবা দেশভাগ না হলে হয়তো আমাদের সাহিত্য আরও অনেক বেশি উর্বর হতে পারতো।
মির্জা গালিবের একটি জনপ্রিয় লেখার থেকে উদৃত করে বলা যেতে পারে, "ইউ হোতা তো ক্যা হোতা" (এমনটা হলে কেমন হতো)। কথাটির পুনরাবৃত্ত হলেও ভারতের জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম কিন্তু এখনও কাল্পনিক ইতিহাস ভিত্তিক অনুষ্ঠান বানানো নিয়ে একটু সন্দিহান।
ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাল্পনিক ইতিহাস নিয়ে ছবি না করার অন্যতম প্রধান কারণ হল এর ফলে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠতে পারে। এই ধারার যেকোনও ভালো কাহিনীর ক্ষেত্রে যেটা হয় সেটা হল প্রথমে 'এমনটা হলে কেমন হতো'-র মতো একটা সরল প্রশ্ন দিয়ে আরম্ভ হলেও খুব দ্রুত বিষয়বস্তু বেশ জটিল হয়ে ওঠে।
(ছবি: স্ক্রিনগ্র্যাব)
দুর্ভাগ্যবশত, মূলধারার ভারতীয় বিনোদন চলচিত্র নির্মাতারা যদি কখনও এই জাতীয় প্যারালাল ছবি বা কাল্পনিক ইতিহাস নিয়ে ছবি তৈরি করেন তাহলে তাতে গভীরতার অভাব থাকে।
গত কয়েক বছরে এই ধারার বইগুলি এতটাই জনপ্রিয়তা ও সম্মান অর্জন করেছে যে কিংয়ের '১১/২৩/৬৩' নামক উপন্যাসে যে জন এফ কেনেডির হত্যাকে প্রতিহত করার ঘটনাটি লেখা হয়েছে সেটি এখন একটি জনপ্রিয় কাল্পনিক ইতিহাস বলে মনে করা হয়। জেএফকে সবাইকে যে দারুন স্বপ্নগুলো দেখিয়ে ছিল বাস্তবে তার ফল একটা সুখকর হয় না। এটা দেখে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র খুব বিস্মিত হন।
পাশ্চাত্যে, লক্ষণীয়ভাবে অতীত চর্চা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এবং এই পরিস্থিতিকে দক্ষ হাতে ব্যবহার ও ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে। ফিলিপ কে ডিকের 'ম্যান ইন দা হাই ক্যাসেল' বইটি, পাঠক বা দর্শক থেকেই তুষ্ট করতে চান না কেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানি ও জাপানকে জয়ী হিসেবে দেখিয়ে বইটি ট্রাম্প শাসিত আমেরিকার কাছে উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। ভারতের জনপ্রিয় সংস্কৃতি (পপুলার কালচার) এই ধরণের অবাস্তব বা অতি অবাস্তব ঘটনার ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।
গতানুগতিক পুরোনো গল্প
'স্যাকরেড গেমস' বইটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়। এবার এই বইটিকে ভারতীয় টেলিভিশন সিরিজের রূপ দেওয়া হয়েছে যেখানে খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বইতে যে আসল ঘটনাগুলি লেখা রয়েছে সেগুলো খোলাখুলিভাবে দেখানো হলেও কিছুটা কল্পনার সাহায্য নিয়ে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যাতে সিরিজটি এখনকার সময়ের সঙ্গে খাপ খায়।
সম্প্রতি সাদত হাসান মান্টোর জীবনীর উপর ভিত্তি করে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। যাঁরা কোনও মতেই বুঝতে চান না যে ভবিষতে আমরা ঠিক কোন সামাজিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারি, তাঁরাই এই ছবিটি দেখে বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন। পাল্টা যুক্তিটা হল- ভারত যে আদর্শ আর বিশ্বাসের কথা বলে মান্টো যদি তার প্রতীক হন তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে জিন্নাহর স্বপ্নের স্বাধীনতা ভারত ছেড়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতেন না। এই প্রশ্নটি খুব একটা আলোচিত নয়।
যেসব হিন্দি চিলচিত্র নির্মাতারা সত্যি ভালো ছবি বানাতে চান তাঁরা গৎ ভেঙে বেরোতে জানেন। গতানুগতিক ও পুরোনো বিষয়বস্তুকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন করার পথে না হেঁটে এঁরা সেই পুরোনো ফর্মুলাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে চান।
একবার ভাবুন তো ভারতীয় টেলিভিশনে কী ভাবে ইচ্ছাধারী নাগিন বা সাপের আবির্ভাব হয়েছে? ব্যাপারটা বেশ কষ্টকর হলেও, এইধরণের অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তার জন্য নির্মাতারা বস্তাপচা বিষয়বস্তু নিয়ে বারে বারে সিরিয়াল বানাচ্ছেন। তাই কাল্পনিক ইতিহাস বা অল্টারনেট হিস্টোরি বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করতেই ভারতীয় চিত্রনির্মাতারা অনেক বেশ পছন্দ করেন।
কাল্পনিক ঘটনা
লেখক নীল রসে তাঁর বই "ইফ ওনলি: হাউ টু টার্ন রিগ্রেট ইনটু অপরচুনিটি"-তে বলেছেন যে অবাস্তব বাস্তবতা শুধু মানব মনের অন্যতম অংশই নয় এটা আমাদের চারপাশের পৃথিবীর প্রতি ধারণা তৈরি করার ক্ষেত্রেও অপরিহার্য্য। এই অবাস্তব বা অতি বাস্তবতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল রাজকুমার হিরানির 'লাগে রাহো মুন্না ভাই' নামক গুন্ডাগোত্রীয়ও এক ব্যক্তি মহাত্মা গান্ধীর দেখা পান।
ছবিটির সাফল্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমরা ভারতীয়রা আসলে কোনটা বাস্তবে ঘটেছে আর পরিস্থিতি অন্যরকম হলে কী ঘটতে পারবো এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না কেন, কাল্পনিক ইতিহাসের প্রতি আমাদের আকর্ষণ অপরিমেয়। হয়তো চলচিত্র নির্মাতা এবং দর্শকদের উভয়েরই এখন একটু থোড় বড়ি খাড়া বাস্তবতার থেকে সরে এসে একটু ছক ভাঙা চিন্তা করা উচিত।
(সৌজন্যে মেল টুডে)
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন