বিরিয়ানি: স্বাধীন ভারতের সত্যিকারের স্বাধীন খাবার
খাবারদাবার নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের মধ্যে বিরিয়ানির উৎস নিয়ে দ্বিমত আছে
- Total Shares
জীবনের প্রথম দিকে আমি যখন কলকাতায় থাকতাম তখনকার দুর্দান্ত স্মৃতিগুলোর মধ্যে একটা হল মধ্য কলকাতার দোকানের বিরিয়ানি।
আমরা যখন স্কুল পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন স্কুলের কনিষ্ঠরা আমাদের জন্য একটি বিদায় সংবর্ধনা আয়োজন করেছিল, সেখানেও বিরিয়ানি খাওয়ানো হয়েছিল। আমাদের বিল্ডিং সোসাইটিতে যখন দুর্গাপুজো হত, তখন দশমীর দিন যখন মাংস খাওয়া হত। তখনও পেশাদার রাঁধুনিরা বিরিয়ানি রাঁধতেন। দুর্গাপুজোর শেষ দিনটা হল দশমী। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে এলিট সিনেমাহলে হিন্দি ছবি "ম্যায়নে পেয়ার কিয়া" দেখতে যাওয়ার আগে বন্ধুরা মিলে 'আমিনিয়া'-তে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। আবার কলেজে পড়ার সময় বন্ধুরা মিলে নিউ এম্পায়ার হলে ইংরেজি ছবি 'টাইটানিক' দেখতে গিয়ে নিজামের বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। আমি জীবনে প্রথমবার যখন চাকরি পাই তখন আমার ছোটভাই যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তখন তাকে আমি জিসানের বিরিয়ানি খাওয়াই।
কলকাতায় শেষ চাকরিটি ছেড়েছিলাম মুম্বইয়ে চলে আসব বলে। তখন বন্ধুরা মিলে যে পার্টিটা করেছিলাম সেখানে ছিল সিরাজের বিরিয়ানি।
লখনৌর বিরিয়ানি
আমার জীবনে অনেক বদল এলেও একটা জিনিস কোনও দিন বদলায়নি, সেটা হল বিরিয়ানির প্রতি আমার ভালোবাসা।
মুম্বাইতে আমি একটি নিরামিষাশী পরিবারে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতাম। তখন আমি ভাবতাম যে প্রত্যেক রবিবার 'মাংস ভাত' কোথায় পাব। আমি যখন আমার বাড়িওয়ালিকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি 'লাকি বিরিয়ানি'র নাম করলেন। পরে অবশ্য মনে হয়েছিল দোকানের নাম লাকি রেস্তোরাঁ হলেও দোকানের বিরিয়ানি এতই সুস্বাদু যে এটা আমার জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।
যখন প্রথমবার লাকিতে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম তখন আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ কলকাতার বিরিয়ানির তুলনায় লাকির বিরিয়ানির দাম অনেক বেশি। তবে লাকির বিরিয়ানিতে কলকাতার তুলনায় অনেক বেশি মাংসের টুকরো থাকত। এখানকার বিরিয়ানিতে মাপে ছোট বেশ কয়েকটা আলু থাকত। কলকাতার বিরিয়ানিতে একটাই আলু দেওয়া হয়, সেটা মাপে বেশ বড়। কলকাতার বিরিয়ানিতে আলুকে মাঝখান থেকে কেটে টু-টুকরো করে পরিবেশন করা হয়। যাতে আলুতেও যাতে মসলা ও মাংসের স্বাদ পাওয়া যায়, সে জন্য বিরিয়ানি রান্না করার সময়ই তাতে আলু দেওয়া হত।
আরেকটা কথা, সেই বিরিয়ানিতে এত বেশি পরিমাণে মসলা থাকত, যা সাধারণ ভাবে বিরিয়ানিতে থাকে না।
"ম্যায়নে প্যার কিয়া" ছবিতে অভিনেতা সলমন খান
বিস্ময়ে আমি ওখানকার বিরিয়ানি সম্বন্ধে আরও কিছু জানার চেষ্টা করলাম, তাই মুম্বাইয়ের বেশ কয়েকটি নামী বিরিয়ানির দোকানে ঢুঁ মারলাম, যেমন নূরানী, জফর ভাই, পারসিয়ান দরবার প্রভৃতি। এ সব জায়গায় ঘুরে আমি দুটো কথা বুঝলাম।
প্রথমত, আমি আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকি তাই আর আগের দিনগুলো কোনও দিনই ফিরে পাব না।
দ্বিতীয়ত, অনেক ধরণের বিরিয়ানি হয় তাই আপনার পাতে পড়ার আগে আপনি জানতে পারছেন না কোন বিরিয়ানিটি আপনি খেতে চলেছেন।
ধীরে ধীরে বিভিন্ন খাবারদাবার এবং খাবারদাবারের ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মাতে শুরু করল। তারপর বীর সাংভির 'রুড ফুড' ও লিজি কলিংহ্যামের লেখা বই 'কারি:এ টেল অফ কুকস অ্যান্ড কঙ্করাস' পড়ে বিরিয়ানির সম্বন্ধে বহু কিছু তথ্য জানতে পারি।
এরপর আমি 'বিরিয়ানি তীর্থে' বেরিয়ে পড়ি, অর্থাৎ বিরিয়ানি সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য জানার আগ্রহে আমি দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাই। লখনৌতে গিয়ে আমি রাস্তার ধরে যে সব খাবার দোকানগুলো যেমন ওয়াহিদ বিরিয়ানি এবং ইদ্রিস বিরিয়ানিতে বিরিয়ানি খাই। গোঁড়া মুসলমানরা আবার বলে পুলাও। এরাই নাকি কলকাতায় প্রথম বিরিয়ানির দোকান খুলেছিল। খুব অবাক হয়েছিলাম দেখে যে যেই খাবারটা একসময় নবাবরা খেতেন সেটাই এখন রাস্তার ধারের দোকানে সেই খাবার খান আমজনতা।
এরপর আমি হায়দরাবাদে যাই, বহু বিরিয়ানি প্রেমী ওখানেই থাকেন, যদিও আমর মতো বিরিয়ানি প্রিয় নন। বিরিয়ানি খেতে কাফে বাহারে যাই কারণ স্থানীয়রা বলেন পর্যটকরা নাকি বিরিয়ানি খেতে এই দোকানেই আসেন। পুরোনো হায়দারাবাদে বিরিয়ানি খেতে আমি ঢুকে পড়লাম সাদাবস ও শাহ গৌসেস, এখানের বিরিয়ানির বেশ ঝাল ঝাল স্বাদ।
তখনই বুঝেছিলাম যে মুম্বাইয়ের কয়েকটি দোকান হায়দরাবাদি বিরিয়ানির নামে যে বিরিয়ানি বিক্রি করে তার আসলে হায়দরাবাদি বিরিয়ানি নয়, বরং যেটা তাঁরা হায়দরাবাদি বিরিয়ানি বলে বিক্রি করছে তাতে হায়দরাবাদের নাম খারাপ হচ্ছে।
দু'টো বিরিয়ানি একদম দু-রকমের। হায়দরাবাদের বিরিয়ানি খাবার সময় মাঝে মধ্যে চাপ মসলা ভাতের মধ্য থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু মুম্বাইয়ের বিরিয়ানির মশলাতে একটু জবজবে ভাব থাকে বলে ভাতের গায়ে সেই মসলার রংটা ধরে যায়। মুম্বাইয়ের ঠিক পাশেই পুনে শহরের 'এসপি বিরিয়ানি'-তে মসলাদার বিরিয়ানি যেমন পাওয়া যায় তেমনই ব্লু নাইলের ইরানি বিরিয়ানিতে সুগন্ধি ভাতের সঙ্গে ভাজা মাংসের টুকরো এবং একটি ভাজা টম্যাটো থাকে। পাশাপাশি তাতে জেরেস্ক (zereshk) নামে একধরণের পারসি মসলাও যোগ করা হয়।
আবার অন্যদিকে লখনৌ ও কলকাতায় মনে করা হয় যে বিয়িরানির মশলা যেন কখনও খাবার সময় দেখা না যায়। একবার একটি শীতের রাতে দিল্লির একটি ছোট গলির মধ্যে একটি বিরিয়ানির দোকানের নাম পহেলওয়ান বিরিয়ানি, তার মালিকও ঠিক এই কথাটাই আমাকে বলেছিলেন।
আমি অনেক রকমের মজাদার এবং দারুণ সব বিরিয়ানি খেয়েছি। আমরা কয়েকজন মিলে অমৃতসরের বিভিন্ন দোকানে বিরিয়ানি খাই। ওখানে একটি জনপ্রিয় ধাবাতে দেখেছিলাম যে ওখানের রাঁধুনি কিছুটা পুলাওয়ের মধ্যে কিছুটা চিকেন কারির ঢেলে দিলেন এবং তারপর একটি চাটুর মতো একটি সসপ্যানে সেটাকে ছড়িয়ে দিলেন। কিছুটা মদ ঢেলে যে ফ্লমবে করা হয় সেখানে মদ ব্যবহার না করে বেশ অনেকখানি বনস্পতি যোগ করা হল। এবার তার উপর দিয়ে বেশ অনেকটা ধনেপাতা কুচি যোগ ছড়িয়ে দেওয়া হল।
হায়দরাবাদি বিরিয়ানি
আমি ওনাকে পদটির নাম জিজ্ঞেস করতে উনি আমাকে বললেন “আপনার যা ইচ্ছে আপনি নাম দিতে পারেন। আপনাদের দলেরই একজন সদস্য যিনি আমার কাছে বিরিয়ানি খেতে চেয়েছেন তাঁর জন্য আমি এই পদটা বানাচ্ছি।" এই খাবারটার নাম ফ্রাইং প্যান বিরিয়ানির থেকে ভালো কিছু হতে পারে না।
বিরিয়ানির সন্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ আমার তখনও অনেকটাই বাকি ছিল। তারপর দক্ষিণ ভারতের বিরিয়ানি খাই, আর তখনও পর্যন্ত হায়দরাবাদি বিরিয়ানি ছাড়া আর অন্য কোনও জায়গার বিরিয়ানির সম্বন্ধে আমার তেমন ধারণা ছিল না। তবে যখন ডিন্ডিগুলে থ্যালাপ্পকাট্টি রেস্তোরাঁয় কাঁচা লঙ্কা বাটা এবং ছোট ছোটো তবে ডুমো করে কাটা পাঁঠার মাংসের টুকরো দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানি খেলাম বা যখন চেন্নাইতে আম্বুর রেস্তোরাঁয় রসুন দিয়ে রান্না করা আম্বুর বিরিয়ানি খেলাম তখন সত্যি মনে হয়েছিল এই শহরটায় ইডলি-দোসা যতটা না প্রিয় তার চেয়ে অনেক বেশি বিয়িরানি-প্রেমী। ভারতের আর অন্য কোনও অঞ্চল থেকে চেন্নাইয়ের মানুষ বিরিয়ানি সম্বন্ধে অনেক বেশি জানেন।
যদিও রাজু গারু ধাবার ঝালের সঙ্গে ডিন্ডিগুলের পাঠার মাংসের বিরিয়ানিটা ঝালের কোনও তুলনায় চলে না। অন্ধ্রপ্রদেশের এই অঞ্চলে সাধারণ মানুষ রান্নায় অনেক বেশি কাঁচা লঙ্কা খান।
আবার মুম্বাইয়ের ডিলাক্স রেস্তোরাঁয় কেরলের একধরণের বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। যে পাত্রে বিরিয়ানিটি পরিবেশন করা হল সেটা দেখলে বিরিয়ানি মনে হলেও আসলে সেটা অনেকটা বাঙালির গোবিন্দভোগের চালের তৈরি ঘি-ভাতের মতো দেখতে। সেই সাদা ভাতকে কিছুটা সরালেই ভেতরে মসলা ও মাংসের খোঁজ পাওয়া যাবে।
হায়দরাবাদের চারমিনার
মাংস ছাড়া কী বিরিয়ানি হয় না?
যাঁদের খাওয়ারদাওয়ার সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞান আছে তাঁরা মাঝে মধ্যেই এই প্রশ্নটা করেন। তবে মুম্বাইয়ের ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থলে যে সব রেস্তোরাঁয়ে ম্যাঙ্গালোরের খাওয়ার পাওয়া যায় সেসব রেস্তোরাঁয়ে ভেজ বিরিয়ানির চাহিদা প্রচুর। কিছুটা হলদু রঙের ভাতের উপরে বিভিন্ন সবজি এবং অনেকখানি ধনেপাতা কুচি ছড়ানো থাকে এই ভেজ বিরিয়ানিতে।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন কলকাতার বহু মোগলাই রেস্তোরাঁ, যেখানে ভেজ বিরিয়ানি পাওয়া যেত সেখানে ভাতের উপর মাংসের টুকরো না দিয়ে সম পরিমাণের পনির দিয়ে রান্না করা হত। ভেজ বিরিয়ানিতে আলু থাকত।
ভারতীয় হেঁশেলের আসল কথাটা হল যে কোনও পদকেই আমাদের নিজেদের সুবিধা এবং রসনা অনুসারে নিজেদের মতো করেই কিছুটা উনিশ-বিশ করে তৈরি করে নিই।
যদিও যাঁরা খাবারদাবার নিয়ে গবেষণা করেন তাঁদের মধ্যে বিরিয়ানির উৎস নিয়ে নানা রকম মতামত আছে যে বিরিয়ানি আসলে মোগল সম্রাটদের হাত ধরে ভারতে আসে নাকি তাঁদের সৈন্যরা দেশে বিরিয়ানি চালু করেছিল নাকি তখনকার ইরানি বণিক সম্প্রদায় এখানে বিরিয়ানির প্রচলন শুরু করেন নাকি প্রাচীন সময় দক্ষিণ ভারতের মানুষ এখানে বিরিয়ানি রান্না শুরু করেন -তবে যাই হোক না কেন বিরিয়ানি এমন একটি পদ যেটা আমাদের দেশের প্রায় সব কটি রাজ্যেই পাওয়া যায়।
তাই বিরিয়ানিকে আমাদের দেশের জাতীয় খাবার বলা যেতেই পারে।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন