হুগলি ইমামবাড়ার স্থাপত্য-ভাস্কর্যের পাশাপাশি সুবিশাল ঘড়ি আজও টানে ইতিহাস-পিপাসুদের
বিগ বেনের পরে সম্ভবত সবচেয়ে বড় ঘড়ি, দম দেওয়ার চাবি ২০ কেজি
- Total Shares
প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর এক বার করে বাজে সেই ঘণ্টা। আর প্রতি ঘণ্টায় বাজে একটু জোরে শব্দ করেই। বনেদি ঘরের ঠাকুর বাড়িতে যেমন জয়ঘণ্টা থাকে, হুগলি ইমামবাড়ার ঘণ্টাও সেই রকম, ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো মোটেই নয়। সেই ১৮৪১ সাল থেকে ঘণ্টা বেজে চলেছে এক ভাবে। সারানোর দরকার কোনওদিন হয়নি এমন অবশ্য নয়।
লন্ডন শহরে গিয়ে বিগ বেন দেখার সৌভাগ্য ক’জনের আর হয়! যাঁদের হয় না, তাঁরা আসতে পারেন এই ইমামবাড়ায়। ব্রিটিশ স্থাপত্যের বদলে পাবেন ইসলামি শিল্পকলার স্বাদ, আর ওই মিনারের সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় যখন ঘণ্টাটা বেজে উঠবে, তখন যেন মনে হবে সেই ঘড়িতে নয়, ঘণ্টাটা বাজছে একেবারে হৃদয়ের মধ্যে।
ইমামবাড়ার সেই ঘণ্টা, আজও বাজে সেই একই ভাবে
পুরোনো স্থাপত্যটা আগেই ছিল। অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওয়েস্ট বেঙ্গল গেজেটারস, হুগলি অনুযায়ী হুগলি ইমাবাড়া তৈরি হয়েছিল ১৬৯৪, মতান্তরে ১৭১৭ সালে (Imambarah repacing and old building eracted about 1694 or according to another account 1717)। নতুন এই স্থাপত্যটির প্রধান স্থপতি ছিলেন সৈয়দ কেরামত আলি। তিনি ছিলেন গণিতজ্ঞ। এই ইমামবাড়ার নকশা তিনিই করেছিলেন।
হাজি মহম্মদ মহসিন, যাঁকে হুগলি কেন, অনেক দূর-দূরান্তের মানুষও দানবীর বলে জানেন, উপাসনার জন্য তাঁর প্রিয় জায়গা ছিল তাজিয়াখানা। সেই সময়ের নজরগাহ হুসেন ও তাজিয়াখানা একত্রে ইমামবাড়া নামেই পরিচিত ছিল। মহসিনের মৃত্যুর সময়েই জীর্ণ হয়ে পড়েছিল এই ইমামবাড়া। মহসিন এস্টেটের দায়িত্ব সৈয়দ কেরামত আলি পাওয়ার পরে তিনি নতুন করে ওই ভগ্নপ্রায় ইমামবাড়া তৈরির পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী নজরগাহ হুসেন ও তাজিয়াঘর মিলিয়ে এই বিশাল সৌধ তৈরি করেন। তাতেই রয়েছে লন্ডনের বিগ বেনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘড়িটি। ঘড়িটির নির্মাতা মেসার্স ব্ল্যাক অ্যান্ড হারি কোম্পানি, বিগ বেন, লন্ডন। সেই সময়ে ঘড়িটির দাম পড়েছিল ১১,৭২১ টাকা।
এই ঘড়িটিতে দম দেওয়ার জন্য যে চাবি আছে, তার ওজন ২০ কিলোগ্রাম, দু’জন মিলে ঘড়িটি দম দিতে হয়। তিনটি ঘণ্টা রয়েছে, মাঝারি ও ছোট ঘণ্টা দুটি ১৫ মিনিট অন্তর বাজে আর বড় ঘণ্টাটি বাজে ১ ঘণ্টা অন্তর। ঘণ্টাটিতে রানি ভিক্টোরিয়ার মুখ খোদাই করা আছে। ঘড়ির দু-দিকের দুই মিনারে ওঠা যায় ১৫২টি করে সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে। ঘড়ির ডায়ালে লেখা রয়েছে আরবি হরফ।
ইমামবাড়ার দুই মিনারের মাঝে সেই ঘড়ির ডায়াল
আরও একটি ঘড়ি রয়েছে ইমামবাড়ার খিড়কির অংশে, গঙ্গার তীরে। এটি সূর্যঘড়ি। সূর্যের ছায়া দেখেই সময় হিসাব করা যায়। ফুট তিনেক উঁচু এই ঘড়িটি। ভারতে প্রাচীন কাল থেকেই সূর্যঘড়ির চল রয়েছে। বিভিন্ন মানমন্দিরে তো বটেই, মন্দিরেও সূর্যঘড়ি থাকত। ইমামবাড়ায় বড় একটা এই ঘরনের ঘড়ি দেখা যায় না। মূল ঘড়িতে পিতলের ফলক ছিল, তবে সেটি চুরি গিয়েছে। পরে পাথরের ফলক লাগান হলেও তাতে মিনিট পনেরো সময়ের পার্থক্য হয়।
সেই সূর্যঘড়ি, এখন পিতলের ফলকের বদলে পাথরের ফলক বসেছে
যেখানে পিতলের ফলক চুরি যায়, সেখানে সোনা-রুপোর কাজ থাকবে, এমন প্রত্যাশাই করা বৃথা। তবে কিছু এখনও রয়েছে সরকারি তত্ত্বাবধানে। ইমামবাড়ার ভিতরে উপাসনাগৃহ, যা জরিদালান নামে পরিচিত, সেখানেও আর সোনারুপোর কাজ চোখে পড়ে না। সেই সময় বেলজিয়াম থেকে আনানো কাচের ঝাড়বাতির অধিকাংশই এখনও এখানে রয়েছে। আর জরিদালানে রাখা থাকে তাজিয়াও।
জরিদালানের সামনের অংশ, রাখা তাজিয়া
আগে মহরমের তাজিয়ার সঙ্গে হাতি ও ঘোড়াও বার হত। এখন আর তা হয় না। তবে মহরম মাসের ৭ ও ১০ তারিখে তাজিয়া বার হয়, শোভাযাত্রা করে সেই তাজিয়া নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় কারবালা মাঠ পর্যন্ত। ইদের দিন এই এলাকার অন্যতম আকর্ষণের জায়গা হয়ে ওঠে ইমামবাড়া। ইসলামি স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সুন্দর এ ই নিদর্শন এবং ঘড়ি দেখতে বহু ভ্রমণপিপাসু এখানে আসেন।