ভারতীয় ছবির আকাশে অস্কারের প্রথম 'ভানু' উদয়
সিনেমার পোশাক সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে
- Total Shares
সালটা ছিল ১৯৮৩। ৫৫তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠানে হাজার হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন সেদিন। বিদেশের মাটিতে বিশ্ব সিনেমার তাবড় সব বড় নামের মধ্যে তিনিও মনে অনেক উৎকণ্ঠা নিয়ে একটি সংরক্ষিত আসনে চুপচাপ বসেছিলেন। নানা রকম আশঙ্কা ভিড় করছিল তার মনে। এ বার সেই সময়টা এল যখন মঞ্চে 'বেস্ট অ্যাওয়ার্ড ফর কস্টিউম' ঘোষণা করা হবে। চূড়ান্ত বাছাইয়ের পর পাঁচটি সিনেমাকে নির্বাচন করা হয় সেই বিভাগে।
সেদিন যাঁরা পুরস্কারটি দিয়েছিলেন তাঁরা বলেছিলেন, "সিনেমার পোশাক সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে।" এ কথা বলে তাঁরা সেই বছরের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করলেন। ...দা অস্কার ফর বেস্ট কস্টিউম গোজ টু... জন মাল্লো অ্যান্ড ভানু আথাইয়া। আকাশি-নীল শাড়ি পরে সলজ্জ ভাবে পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠে গেলেন ভারতীয় ভানু আথাইয়া। সে বছর রিচার্ড অ্যাটেনবোরোর সিনেমা 'গান্ধী'-র জন্য শ্রেষ্ঠ পোশাকের পুরস্কারটি পেয়েছিলেন ভারতের ভানু আথাইয়া। যদিও এই পুরস্কারটি তিনি ব্রিটেনের জন মালোর সঙ্গে যৌথ ভাবে পান।
সেই প্রথমবার ভারতের নাম বিশ্ব সিনেমার সবচেয়ে বড় পুরস্কারের মঞ্চে স্থান পেল।
ভানু আথাইয়া আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে প্রথম অস্কার বিজয়ী হওয়ার গৌরব এনে দিয়েছিলেন দেশকে
এই ঘটনাটা হয়ত আমাদের অনেকেরই জানা আবার অনেকে হয়ত ভুলে গেছি। ভারতীয় সিনেমার খ্যাতির সরণিতে উৎকীর্ণ বড় বড় নামের আড়ালে অনেক সময় এমন কিছু নাম চাপা পড়ে যায় যাঁদের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অবহেলা করার মানে হল ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের খণ্ডচিত্রের সঙ্গে পরিচয় করা। ভারতীয় সিনেমার সামগ্রিক ছবিটা দেখতে হলে এই নামগুলো ভুললে আখেরে ক্ষতি আমাদেরই। এমনই একটি নাম ভানু আথাইয়া, যিনি আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে প্রথম অস্কার বিজয়ী হওয়ার গৌরব এনে দিয়েছিলেন দেশকে।
পাঁচ দশকের ও বেশি সময় ধরে যেই ভানু আথাইয়া ভারতীয় সিনেমার অভিনেতাদের অসাধারণ সব পোশাকে সুন্দর করে তুলেছেন সেই ভানুমতীর জন্ম ১৯২৯ সালে আজকের দিনে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে। তাঁর বাবা আন্নাসাহেব রাজোপধ্যায় একজন চিত্র শিল্পী ছিলেন। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছোটবেলা থেকে ভানুমতীরও আঁকায় ঝোঁক ছিল। এই শখটিকে পাকাপাকি ভাবে পেশায় রূপান্তরিত করার জন্যই তিনি বোম্বাইয়ের নামজাদা আর্ট কলেজ স্যার জে জে স্কুল অফ আর্ট থেকে স্নাতক করেন।
পাশ করে ‘ইভস উইকলি’ বলে একটি পত্রিকায় প্রথম কাজের সুযোগ পান। ধীরে ধীরে তাঁর ইলাস্ট্রেশন ও অন্যান্য কাজ অনেকের নজরে আসে। এরপর এই পত্রিকার সম্পাদক নিজের পোশাকের একটি বুটিক খুললে ভানু সেই দোকানে পোশাকের ডিজাইনার হিসেবে নিযুক্ত হন। বোম্বাই শহরে তখন বুটিক ব্যাপারটা বেশ নতুন ছিল। তাই এই বুটিকটিতেই তখনকার সিনেমা জগতের অনেকেরই আনাগোনা ছিল। এ ভাবেই ভানুর কাজ সিনেমা জগতের লোকজনের নজর কাড়তে শুরু করল। অচিরেই তিনি সিনেমায় ছোটছোট কাজ পেতে শুরু করলেন।
ভারতীয় সিনেমা জগতের বিখ্যাত সব নাম যেমন কামিনী কৌশল, রাজ কাপুর, গুরু দত্তদের সিনেমায় কাজ করতে থাকেন তিনি।
১৯৫৭ সালে মেহবুব খানের ছবি 'মাদার ইন্ডিয়া' প্রথমবার অস্কারে যায়
গুরু দত্তের অনেকগুলি ছবিতে তিনি কস্টিউম ডিজাইনের দায়িত্বে ছিলেন, যেমন 'চৌধভি কা চাঁদ', 'কাগজ কে ফুল', 'পেয়াশা', 'সাহেব বিবি আউর গোলাম' ও 'সিআইডি'।
'সাহেব বিবি আউর গোলাম' ছবিতে পোশাক ডিজাইন করার সময় গুরু দত্তের অনুরোধে তিনি কলকাতায় আসেন এবং এখানকার রাজবাড়ি ও জমিদারবাড়িগুলো ঘুরে দেখেন। জমিদারবাড়িতে পুরোনো দিনে মহিলারা ঠিক কী রকম পোশাকআশাক পরতেন বা সাজগোজ করতেন, তার একটা সম্মক ধারণা পাওয়ার জন্য ওখানকার লোকজনদের সঙ্গেও দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছিলেন।
তিনি তখনকার জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা 'তিসরি মঞ্জিল', 'গাইড', 'ওয়াক্ত' ও 'মেরে সনম' প্রভৃতিতে কাজ করেন।
'ওয়াক্ত' ছবিটিতে অভিনেত্রী সাধনার চাপা সালোয়ার-কামিজের ডিজাইন দেশের সাধারণ মহিলাদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়
'ওয়াক্ত' ছবিটিতে অভিনেত্রী সাধনার চাপা সালোয়ার-কামিজের ডিজাইন দেশের সাধারণ মহিলাদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ঠিক একই ভাবে 'ব্রহ্মচারী' ছবিটিতে মমতাজের শাড়িটিও বেশ জনপ্রিয় হয়।
আবার রাজ কাপুরের তৈরি 'সত্যম শিবম সুন্দরম্' বা 'প্রেম রোগ'-এর জন্য পোশাক তৈরি করার সময় ভানু আথাইয়া রাজ কাপুরের থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন।
১৯৮২ সালে স্যার রিচার্ড অ্যাটেনবোরোর ছবি 'গান্ধী' -র জন্য ভানু আথাইয়া ও ব্রিটিশ কস্টিউম ডিজাইনার জন মাল্লো পোশাক বানিয়েছিলেন। আর ১৯৮৩তে সিনেমাটির জন্য তিনি ও সহকর্মী জন মাল্লো অস্কার জেতেন। সেই প্রথমবার ভানু আথাইয়ার হাত ধরে অস্কার আসে ভারতের মাটিতে।
'লগান - ওয়ানস আপন এ টাইম ইন ইন্ডিয়া' জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার জেতেন
১৯৯২ সালে সত্যজিৎ রায়কে অনারারি অ্যাকাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে 'স্লাম ডগ মিলিয়নেয়ার' ছবিটির জন্য রেসুল পুকুট্টি, এআর রহমান এবং গুলজার অস্কার জেতেন। এখনও অবধি আথাইয়াই একমাত্র ভারতীয় নারী যিনি অস্কার পুরস্কারটি পেয়েছেন।
এরপর ১৯৯১ সালে 'লেকিন' ও ২০০১ সালে 'লগান - ওয়ানস আপন এ টাইম ইন ইন্ডিয়া' ছবি দু'টির জন্য আথিয়া জাতীয় পুরস্কার জেতেন।
ঠিক একই ভাবে আমরা হয়ত ভুলে গেছি যে ১৯৫৭ সালে মেহেবুব খানের ছবি 'মাদার ইন্ডিয়া' প্রথমবার অস্কারে যায়। গুগল তাদের ডুডলের মাধ্যমে এই শিল্পীকে সম্মান না জানালেও যেই শিল্পী খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও ভারতীয় সিনেমাকে কোনও দিন ভোলেননি সেই ভানু আথিয়াকে যদি ভুলে যাই তা হলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হবে।