বাংলা ছবি আধুনিক হয়েছে, কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ঢেলেছিল বাংলা সিনেমা শিল্পের উন্নতির জন্য
- Total Shares
দেশে-বিদেশে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন যেমন বহু আলোচিত নাম ততটাই চর্চিত তাঁদের সিনেমা। পাশাপাশি গত শতকের আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিক থেকেই সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী প্রমুখ চলচ্চিত্রকাররাও নান্দনিক দিক দিয়ে যেমন তেমনই সমাজ-সচেতন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও উল্লেখ্য হয়ে ওঠেন।
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল উত্তরকালে চলচ্চিত্রের ভাষা ও চলচ্চিত্র নির্মাণরীতির নান্দনিক সৌকর্যকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিশিষ্ট জায়গা দেওয়ার ক্ষেত্রে এঁদের অবদান অসামান্য বলেই মনে করা হয়।
বাঘ বাহাদুর ছবির দৃশ্য। (ছবি: ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব)
দৃশ্য, শব্দ ও...
বস্তুত দৃশ্য ও শব্দ – এই দুই ইমেজের সমন্বয়েই তৈরি হয় সিনেমার ভাষা ও নন্দনভাবনা। নন্দনতত্ত্ব দর্শন হলেও তা শিল্পসম্বন্ধনীয় চিন্তা-ভাবনা। শিল্পকর্মের রূপ-রস-সত্য-সৌন্দর্য-গূঢ়ার্থ, সমাজ-রাজনীতি প্রসঙ্গ, ভাবাদর্শ প্রভৃতি হল নন্দনতত্ত্বের উপজীব্য। এ সব ছাড়াও কী কী কারণে ছবিটি শিল্পপদবাচ্য ও মানসম্পন্ন, কী ভাবে তা প্রতিক্রিয়া করে, কী ধরনের ভূমিকা পালন করে, দর্শকমননে কোন ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করে প্রভৃতিও নন্দনতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়। যদিও এ সব কথাই তত্ত্বগত, ছবিটি ভাল লাগল কিনা বা দর্শক মন ছুঁতে পারল কিনা, এবং শেষ পর্যন্ত কালের নিরিখে ছবিটির ভূমিকা কী; বহু কিছুর পর বিচার্য সেটাই।
উল্লেখিত প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে আরেক ধরনের অনুসন্ধানও জরুরি হয়ে ওঠে যে; কোন সামাজিক পটভূমিতে একটি সিনেমার জন্ম, জীবনচক্রের কোন পর্যায় ও অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে ওই ছবিটিতে; ছবিটির দৃশ্য ও শব্দমাত্রাগত ইমেজগুলো কোন প্রক্রিয়ায় সঞ্চিত হয়েছে; সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রকারের নন্দনভাবনার পরিচায়ক প্রবণতাগুলো কী রকম প্রভৃতি।
শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি
সত্যজিৎ ঋত্বিক ও মৃণাল পরবর্তী আলোচনায় প্রথমেই আসতে পারেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁর ছবির প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি লক্ষ্য রেখে মোটামুটি এ ভাবে দেখা যেতে পারে - সমষ্টিপ্রধান বিষয়: দূরত্ব, নিম অন্নপূর্ণা, গৃহযুদ্ধ, তাহাদের কথা, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, ব্যষ্টিপ্রধান বিষয়: চরাচর, লাল দরজা, উত্তরা, স্বপ্নের দিন, কালপুরুষ, আমি ইয়াসিন এবং আমার মধুবালা। শিল্প ও শিল্পীপ্রধান বিষয়: শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি, ফেরা ও বাঘ বাহাদুর।
নিম অন্নপূর্ণা উপনিবেশ-উত্তর বাংলার সমাজবাস্তবতার সমষ্টিগত সঙ্কটের ছবি। দারিদ্র্যে দুঃখে লীন মানুষের কাব্য। তাহাদের কথা শিবনাথকে কেন্দ্রে রেখে তৈরি হলেও শিবনাথের নিজের একার কথা নয়। ব্রিটিশবিরোধী সর্বভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিপ্লবীদের কারাবরণ, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের বিশ্বাসঘাতকতা, ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং তৎপরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতার পটভূমিতে পরিব্যাপ্ত।
শিল্প ও শিল্পীর সঙ্কট নিয়ে নির্মিত ছবি হল ফেরা। এক অর্থে ব্যষ্টি ও সমষ্টির মিলিত সঙ্কট। যখন শিল্প ও শিল্পী সঙ্কটে পড়ে তখন দুয়ের মধ্যে অস্থিরতার প্রকাশ ঘটে; একটি সমাজের সাংস্কৃতিক বাতাবরণ সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। ফেরা আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি ধারা যাত্রা ও তার শিল্পীদের বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে যে সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হয়েছে তার কথা।
কেবলমাত্র ফেরা নয়, শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি, বাঘ বাহাদুর – তিনটি ছবিই একজন পারফর্মারের সমস্যার কথা। একজন শিল্পীর সমস্যার কথা। মানুষের সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গচেতনা, নারী, যৌনতা সবকিছুই যেন প্রতারণা করে সংসার, পরিজন, সময়, সমাজ। এই বিপন্নতা বোধই বাস্তবতা ছেড়ে কল্পনায় সরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।
এই সরে যাওয়ার মুহূর্তগুলিই চরাচর ছবিতে লখিন্দরের দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রিত হয় কখনও স্বপ্নে, কখনও কল্পনায়। লাল দরজাও নবীনকে কেন্দ্র করে তৈরি ছবি। ব্যক্তিগত সঙ্কটে নিমজ্জিত নবীন সঙ্কট নিরসনের কোনও উপায় না পেয়ে কল্পনায় শৈশবে ফিরে যায়। বাসত্মবতা, স্বপ্ন, কল্পনার মিশ্রণ থাকায় ভাষাও মিশ্র হয়ে ওঠে। উত্তরায় একাধিক ব্যক্তির নানামুখী সঙ্কট। এ ছবির ভাষা কাব্যময়, যা নন্দনভাবনার নিরিখেই গঠিত। নন্দনভাবনা কাব্যিক অন্তর্দৃষ্টি থেকে গড়ে উঠেছে। কিছুটা অঁদ্রে তারকোভস্কি-প্রভাবিত।
পারমিতার একদিন
৩৬ চৌরঙ্গী লেন থেকে গয়নার বাক্স – যেন নিজেরই গহীন গোপন সব একাকিত্বের কথা। ৩৬ চৌরঙ্গী লেন এক সঙ্গীহীন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নারীর জীবনের শূন্যতার করুণ উপাখ্যান। অপর্ণা সেনের পরমা, পারমিতার একদিন, গয়নার বাক্স – নারীকেন্দ্রিক। নারীবাদকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেন তিনি।
পারমিতার একদিন ছবির দৃশ্য। (ছবি: ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব)
হয়তো প্রত্যেক নারীই তা-ই করেন! অপর্ণার মতে নারীবাদ আন্দোলনের সময় যে ক্ষিপ্রতা, যে গতির প্রয়োজন ছিল তা সাধারণ জীবনে এসে অন্য রূপ নেয়। ব্যাপারটা ঠিক ফেমিনিস্ট না হয়ে হিউম্যানিস্ট-এর গোত্রে পড়ে যায়। নারীবাদের সংজ্ঞা ক্রমশ পাল্টাচ্ছে বলেই মনে করেন অপর্ণা সেন। দর্শক যারা সিনেমা দেখেন তারাও কোথাও না কোথাও নিজেদের সঙ্গে সেই চরিত্রের মিল খোঁজেন। একাত্ম বোধ করেন। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার যুদ্ধ ও দাঙ্গার চরম মুহূর্তে মানুষের মানবিক আবেদনের জায়গা। বিভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষের বিপদের মাঝে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের বিচিত্র কর্মকাণ্ড। সম্পূর্ণ মিউজিক্যাল একটি সিনেমা আরশিনগর। চার নারীর ভিন্ন জীবন এক মোহনায় মিলে যাবার কথা, তাদের অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকা বন্ধুত্বের কথা।
ময়না তদন্ত
চিন্তাশীল, বুদ্ধিদীপ্ত, অন্য ধারার বাংলা ছবি যে নামেই অভিহিত হোক না কেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সত্যজিৎ ঋত্বিক ও মৃণাল পরবর্তী অধ্যায়ে অবশ্যই বিশিষ্ট নাম গৌতম ঘোষ এবং উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। যদিও আরও কয়েকটি নামও বলতে হয় যেমন বিপ্লব রায়চৌধুরী প্রমুখ।
গৌতম ঘোষ তথ্যচিত্র দিয়ে শুরু করে অন্য ভাষার ছবি করলেও দখল, দেখা, পদ্মা নদীর মাঝি, আবার অরণ্যে, কালবেলা, মনের মানুষ, শূন্য অঙ্ক, শঙ্খচিল প্রভৃতি বাংলা ছবি করেছেন। বিষয় বৈচিত্র্যের পাশাপাশি আখ্যান নির্মাণেও তাঁর মুন্সিয়ানা লক্ষ্য করা যায়। উৎপলেন্দু চক্রবর্তীও তথ্যচিত্র দিয়ে শুরু করেছিলেন। এরপর ময়নাতদন্ত, চোখ, দেবশিশু প্রভৃতি বাংলা ছবিতে তিনি স্বকীয়তা রাখার চেষ্টা করেন। সমাজ রাজনীতির কথা তিনিও সরাসরি তার ছবিতে আখ্যানের মাধ্যমেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
অপ্রাসঙ্গিক কথা
বাংলা সিনেমার কথায় চলে আসে পেরিয়া আসা শতকের সত্তর দশকের শেষ বেলার কথা। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ঢেলেছিল বাংলা সিনেমা শিল্পের উন্নতিকল্পে। ওই প্রকল্পে একদিকে যেমন বহু স্বল্প এবং পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি নির্মিত হয়েছিল, অন্যদিকে এ রাজ্যে চিত্রপরিচালকের সংখ্যা বেড়ে প্রায় সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছিল।
আসলে সিনেমা যে একাধারে একটি অতি সহজ, মোহময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ মাধ্যম সে কথা বুঝে ফেলেছিলেন কমবেশি বাম দিকে ঢলে থাকা গাইয়ে-নাচিয়ে-বাজিয়ে-বেশ কয়েক জন। তাঁরা দলের সদস্য হওয়ার জন্য হোক কিংবা কোনও কালে মিছিলে-মিটিং হাজিরার কারণে হোক বাম সরকারের প্রগতিবাদী সিনেমা প্রকল্প থেকে কয়েক লক্ষ টাকা বাগিয়ে ফেলতে সমর্থ হলেন ঠিকই কিন্তু সিনেমা তৈরির পরিবর্তে তাঁরা সেলুলয়েডকে যা করলেন তাকে ‘কলুষিত’ বললেও কিছই বলা হয় না। তাঁদের ‘সিনেমা প্রতিভা’র সৌজন্যে কেবল ওই প্রকল্প নয়, বাম সরকারের ভাঁড়ার একদিন ‘ফুটো বাটি’তে পরিণত হয়।
উৎপল দত্ত। (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে আর্কাইভস)
ওই প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ এক সময় উঠেছিল উৎপল দত্তের বিরুদ্ধেও। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক গল্পটিকে নিয়ে চলচ্চিত্র রূপায়ণের পরে অনেকেই শুধু চলচ্চিত্র নিয়ে নয়, থিয়েটার নিয়ে জোছন দস্তিদারের কতটা ব্যুৎপত্তি রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন। শুধু এই দু’জন নন, সমকালীন সময়ে নানা কারণে অনেকে সমালোচিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রগতিশীল যাত্রাপথে এঁদের অবদান অস্বীকার করার চেষ্টা করার অর্থ হল তাঁদের অবদানকে খাটো করে ইতিহাস বিকৃত করা।
পূর্ণেন্দু পত্রীর কথাও বলা দরকার। তিনি সাহিত্য ও শিল্পকলার একটি বিশেষ ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করার পরে বেশ কয়েকটি বাংলা ছবি বানিয়েছিলেন। তাঁর নির্মিত ছবিগুলির মধ্যে স্ত্রীর পত্র বিশেষ উল্লেখযোগ্য। থিয়েটারজগৎ থেকে সিনেমার দুনিয়ায় এসে অনেকেই খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক হয়েছেন।
পার্থপ্রতিম চৌধুরীও থিয়েটার চর্চার পাশাপাশি সিনেমা তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন একেবারে তরুণ বয়সে। তাঁর প্রথম দিককার ছবিগুলি ছিল একটু অন্য ভাবনার, পরবর্তী সময়ে তাঁর কাজের মধ্যে যদুবংশ ছবিটি আলোচনার দাবি রাখে।
প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন
বাংলা সিনেমার ভূবনে উল্লেখিত পরিচালকদের সিনেমা ভাষা, বোধ, শিল্প রূপ ও অন্যান্য যা কিছু শিল্প সম্মত ও সচেতন সিনেমা সম্পর্কিত তা কতটা গভীর কিংবা বিস্তৃত সে প্রশ্নও আলোচনাসূত্রেই এসে যায়।
গত তিনটি দশক ধরে সত্যজিৎ ঋত্বিক ও মৃণাল এমনকি রাজেন তরফদার, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, প্রমুখের যে কাজ সেই তুলনায় বাণিজ্যিক ধারার বিনোদন-নির্ভরতার বাইরে বেরিয়ে তারা যে ছবি নির্মাণ করলেন তা বক্তব্যের গভীরতা ও নির্মাণশৈলীর উৎকর্ষের দিক থেকে বাংলা ছবিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত করে তুলতে কতটা সফল হয়েছে?
সাম্প্রতিককালে যেমন ইরান, সেনেগাল, ব্রাজিল, কিউবা এমনকি হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া-সহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছবি নিয়ে পাশ্চাত্যে আলোচনা হলেও আমাদের চলচ্চিত্র কতটা পরিচিত চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে? যদি হয়েও থাকে তার মধ্যে কি সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণাল বাদ দিয়ে অন্যান্য নাম খুব উৎসাহ বা আগ্রহের সঙ্গে আলোচিত হয়? অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও একথা ঠিক যে, এখনও পর্যন্ত বাংলা ছবির প্রগতিবাদী হন কিংবা অন্য কোনও ধারার, কোনও চিত্রপরিচালকই দেশ কিংবা বিদেশের কোনও স্তরে আলোচনায় জায়গা পাননি।
শিল্প না বাণিজ্য
কাহিনি-নির্মাণ ও নির্মাণপদ্ধতি – এই দু’টি দিক থেকেই যদি একটি ছবি মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি থেকে ভিন্ন হয়ে ওঠে, কেবল সে ক্ষেত্রেই কি ওই ছবিটিকে শৈল্পিক, চিন্তাশীল বা বক্তব্যধর্মী ছবি হিসেবে গণ্য করব। বলা হয়ে থাকে ফর্মুলাভিত্তিক বাণিজ্যিক ছবি করিয়েরা চলচ্চিত্রভাষাকে অকারণ জটিল কিংবা চিন্তার ক্ষেত্রে ভারারাক্রান্ত করা – এই ভেবে দর্শককে চিন্তা করার সুযোগ দিতে আগ্রহী নন। কারণ তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য খুব সহজ ভাবে এবং তাড়াতাড়ি দর্শক মনে বিনোদনের সুযোগ তৈরি করে চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক সাফল্য নিশ্চিত করা।
তাঁদের ধারনা হল – ক্যামেরার সৃষ্টিশীল ভাষা কিংবা দৃশ্যকল্প রচনা করে দর্শককে গুরুগম্ভীর ভাবনায় ফেলার কোনও মানে হয় না। সেই কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ অর্থ নিমার্ণের চেষ্টা বিনোদনমূলক ছবিতে মোটেই গুরুত্ব পায় না।
এ সব কারণেই কি সমাজ-সচেতন এবং শিল্পসম্মত বাংলা ছবির সংখ্যা খুব কম? বাংলা ছবি করিয়েরা সিনেমার ফর্ম বা নির্মাণশৈলীকে গতানুগতিক রেখেই ছবিকে নান্দনিক ভাবে আকর্ষণীয় করে তোলার বিষয়টিতে গভীর গুরুত্ব দিয়েছেন। আসলে তাঁরা বিনোদন-প্রত্যাশী নিষ্ক্রিয় দর্শকই মনে প্রাণে চেয়েছেন, নিজেদের ছবির জন্যই তাঁরা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন দর্শকের সক্রিয়তা এবং সচেতনতা বিনোদনেই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। দর্শক যেন ছবির দৃশ্য কেবলমাত্র উপভোগই করেন; চিন্তা করতে বাধ্য না হন, এ জন্যই ছবির ফর্মকে তাঁরা উদ্ভাবনী পর্যায়ে নিয়ে যেতে নারাজ।
পরিচালক গৌতম ঘোষ। (ছবি সৌজন্য: উইকিপিডিয়া)
অপ্রিয় সত্য হলেও একথাও ঠিক যে তাঁদের কল্পনাশক্তি এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতারও অভাব আছে। আমরা জানি কেবল অভিনব নির্মাণশৈলীর জন্যই বহু ছবি চলচ্চিত্রের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে, শিল্প বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সে সব ছবির অবদান বিশেষ ভাবেই স্বীকার্য।
ঘাস বিচালি মধু
সাধারণ কথামালা, অথচ তুলে ধরা হয়েছে এমন এক ভিন্ন উপস্থাপন পদ্ধতির মাধ্যমে, যেখানে ছবির গতানুগতিক ধারাবাহিকতা বার বার ব্যাহত হয়েছে সচেতন ভাবেই তা করেছেন নির্মাতা। আমরা এমনও দেখেছি সিনেমার কাল্পনিক জগৎ গতানুগতিক ভাবে যে বিভ্রম তৈরি করে, তা ভেঙে দিয়ে দর্শকের মনে তীব্র অভিঘাত তৈরি করে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করার প্রচেষ্টা সুকৌশলে।
ইউরোপের এককালের সিনেমায় সচরাচর ব্যবহৃত বিভিন্ন জটিল চলচ্চিত্র কৌশল– জাম্প কাট, ভয়েস-ওভার ন্যারেশন, সময় আর স্থানের ধারাবাহিকতা নিয়ে বিভ্রান্তি, ফ্ল্যাশ ব্যাক আর ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড, নেগেটিভ ফিল্মের মাধ্যমে দেখানো দৃশ্য, ফ্রিজ ফ্রেম, ছবির ভেতর অন্য চলচ্চিত্রের দৃশ্য- এমনটাও দেখা গিয়েছে বিগত শতকের সত্তরের দশকে। কিন্তু সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল পরবর্তী অন্য ধরণের ছবি নির্মাতারা – যাঁরা আরও অনেক বেশি সিনেমা-প্রযুক্তি সচেতন, উত্তর আধুনিকতাবাদী অথচ তাঁদের তৈরি বাংলা সিনেমা ভাষা-নির্মাণ-শৈলী-সমস্ত দিক থেকেই হাহাকারময়, অন্তঃসারশূন্য – অন্তত আমার তাই মনে হয়।
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: বাংলা চলচ্চিত্রে সাহিত্য থেকে সমকালের প্রতিচ্ছবি