বাংলা চলচ্চিত্রে সাহিত্য থেকে সমকালের প্রতিচ্ছবি
সত্যজিৎ ঋত্বিক ও মৃণাল পরবর্তী বাংলা সিনেমা, প্রথম পর্ব।
- Total Shares
সাহিত্যই সবচেয়ে মননশীল শিল্পরূপ।
এমনটাই বিশ্বাস ছিল জেমস জয়েসের। কিন্তু সাহিত্য যে কেবল কোনও মননশীল বক্তব্যের স্থায়ী বাহন হতে পারে না তা সিনেমা নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছে। কারণ চলচ্চিত্র সাহিত্যের থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী মাধ্যম বলে নয়। স্থান থেকে কাল, কাল থেকে কালান্তরে সিনেমার অনায়াস যাতায়াত। সিনেমার দৃশ্য ও শব্দের ধারাবাহিক মূর্ত থেকে আমরা ভেসে যাই বিমূর্ত নিরপেক্ষ চেতনায়।
পথের পাঁচালি ছবির একটি দৃশ্য। (ইন্ডিয়া টুডে আর্কাইভস)
সিনেমার নিজের চলার পথ যেমন অসংখ্য তেমনই জীবন মরণের সীমানা ‘ছাড়ায়ে’ও সে কত যে রঙ রূপ ফুটিয়ে তুলতে পারে তা আমরা ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘অযান্ত্রিক’-এ দেখেছি। সিনেমার অবজেক্টিভ রিয়্যালিটির সাবজেক্টিভ এক্সপ্রেশন ধরে আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনুভবের মেরু থেকে প্রযুক্তির তুষারে চলে যাই। স্থান ও কালের অবস্থানানুপাতের দ্রুত পরিবর্তন ও সম্পাদনার মধ্য দিয়েই সিনেমা ধারাবাহিক, গতিময়, বিচিত্র। শিল্পগত কলাকৈবল্য ছাড়াও এগুলি সিনেমার উৎকর্ষতা ও গুণগত মানের পরিচায়ক।
আঁধারে আলোর ফুলকি
বাংলা ছবির বয়স কত? দেশ স্বাধীন ও ভাগ হওয়ারও আগে চোখ মেলেছিল বাংলা সিনেমা। প্রায় পনেরো বছর আগে তো বটেই। নির্বাক ছবি অবশ্য তারও প্রায় তেরো বছর আগে থেকেই ডালপালা মেলেছিল। ঠিক কথা বলতে গেলে এই বাংলার হীরালাল সেনই ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ।
ঠিক চলচ্চিত্র যে শিল্প, তার সঙ্গে মানুষ-সমাজ-রাজনীতির দিনরাত্রির যোগসাজস রয়েছে, জীবনের মূল সত্যকে যে চলচ্চিত্র ছুঁতে পারে এই সত্যিটা তখনকার বাংলা ছবি এমনকি তখনকার ছবি নির্মাতারা বুঝে উঠতে পারেননি। লক্ষ্যনীয় স্বাধীনতার জন্য বাংলা ও বাঙালির সংগ্রাম, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, কলকাতার রাজপথে মৃত্যু-মিছিল, দেশভাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা, ভাতৃঘাতী দাঙ্গা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানবতা ধ্বংসকারী ফ্যাসিবাদের উত্থান – একের পর এক ঘটনার একটিও কি তখনকার বাংলা ছবির কোথাও এতটুকু ছায়া ফেলেছিল? একটি ছবির একটি দৃশ্যেও না।
দ্য স্টেটসম্যানের প্রতিবেদন – এই সব ঘটনা চলচ্চিত্রায়িত হয়নি।
১৯৩৬ সালে প্রগতি লেখক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হল। ওই সংগঠনের ইস্তাহারে আবেদন জানানো হল; ‘...আমাদের বিপর্যস্ত সমাজের দাবি মেনে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা চাই জনসাধারণের সঙ্গে সর্ববিধ কলার নিবিড় সংযোগ।’
বাংলা সাহিত্য স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই সময়ের দাবী মেনে সমাজ রাজনীতির চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে উঠছিল। বাংলা সিনেমার কিন্তু এসব নিয়ে কোনও হেলদোল ছিল না।
চেতনায় অন্য পরশ
বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে এই ভাবনা ক্রমেই মাথাচাড়া দিতে থাকে যে সিনেমা একটি শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম বা আরও কিছু। সিনেমা সম্পর্কে নতুন ভাবনার সূত্রপাত হয় একঝাঁক তরুণের উদ্যোগে। কলকাতায় ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সূচনা হয়। সেই আন্দোলন থেকে একে একে উঠে এলেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই গঠিত হয় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। বলা যায় তখন থেকেই বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের ধ্রুপদী ছবিগুলির প্রতি মনযোগ পড়ে অর্থাৎ দেখা শুরু হয়, সেগুলি নিয়ে চর্চায় নিজেদের সমৃদ্ধ করা আর একই সঙ্গে শুরু হয়ে যায় ভালো সিনেমা নির্মাণের প্রস্তুতি।
ঋত্বিক ঘটক, তখন তরুণ। (সৌজন্য: উইকিপিডিয়া)
ঊনিশ শতকের চল্লিশের দশকে আমাদের দেশের প্রায় সর্বত্র যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার সমস্ত রকম চেষ্টা চলছে, সেই সময়ে বাংলা শিল্প সাহিত্যে নবচেতনার ভাবনা শুরু হয়। বলা যেতে পারে এই সময়টাই ছিল বাংলার সারস্বতভূমির মহা সৃজনকাল। বহু নবীন প্রতিভার আবির্ভাব এবং তাদের সৃষ্টিতে বাংলার সারস্বতভূমিতে, শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের সৃজনভূমিতে নতুন চেতনা ও বোধের ছোঁয়া লাগে। তবে বাংলা চলচ্চিত্রে এই নবচেতনা ও বোধের ছোঁয়া লাগে তারও পরে।
দূরের মাঠে রেলগাড়ি
পঞ্চাশের দশকের গোড়াতেই বাংলা সিনেমা-ভাবনা থেকে শুরু করে সিনেমা নির্মাণ সম্পর্কিত যাবতীয় ধ্যানধারনা সবটাই ওলটপালট হয়ে যায়। বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি পথের পাঁচালীর নির্মাণভাবনা থেকে শুরু করে শিল্পরূপ, পাশাপাশি ছবিটির অভাবনিয় সাফল্য বোধসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ছবির পরিচিতি ঘটায়।
সত্যজিৎ রায়। (সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)
কেবলমাত্র সত্যজিৎ নন, তাঁর সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্রের অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনও স্বাধীনতার পরে প্রায় একই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পে পা রেখেছিলেন। একই সময়ে এই তিনজনের সৃষ্টির উড়ানে চেপেই বাংলার এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসরে গৌরবময় অবস্থান।
গঙ্গার তরঙ্গে প্রাণ
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল-এর পরই বলা উচিত প্রায় বিস্মৃত রাজেন তরফদারের নাম। ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৭ তিন দশকে মাত্র ৭টি ছবি- অন্তরীক্ষ, গঙ্গা, অগ্নিশিখা, জীবনকাহিনী, আকাশছোঁয়া, পালঙ্ক আর নাগপাশ। কিন্তু গঙ্গা আর পালঙ্ক ছাড়া তাঁর বেশির ভাগ ছবির নামই আজ বিস্মৃতির অতলে।
বাংলা ছবির সেই নতুন অধ্যায়ের সুচনায় তাঁর কথা যে উচ্চারণ করতে হবে, সে কেবল তাঁর ছবি তৈরির জন্যই নয় বোধহয়, তার চেয়ে বেশি তাঁর বিচিত্র বিষয় নিয়ে ছবি তৈরির জন্য। গঙ্গাকে তিনি দেখেছিলেন এক দার্শনিক কোণ থেকে। সেই কারণে রাজেন তরফদারের গঙ্গায় খুঁজে পাওয়া যায়নি সমরেশ বসুর উপন্যাস। ‘আকাশছোঁয়া’র কেন্দ্রে ছিল সার্কাস। নায়ক মোটরবাইক স্টান্ট খেলোয়াড়। খরচ কমাতে রাত জেগে শুটিং করতেন। কেননা সন্ধেবেলার শো শেষ করে পানামা সার্কাস দল চলে আসত স্টুডিয়োপাড়ায়।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাহিনি অবলম্বনে করলেন পালঙ্ক। দেশভাগ, পূর্ববাংলা, অধুনা বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে উদ্বাস্তুদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং একটি পালঙ্ক ঘিরে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ এবং সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে আসে বাঙালি মূল্যবোধ। সমরেশ বসুর কলম থেকে মাছমারাদের জীবন, আত্মহত্যা-প্রবণ এক বৃদ্ধকে জীবনে টেনে আনার গল্প কিংবা একটি পালঙ্ককে ঘিরে টানাপড়েন। অথচ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রাজেন তরফদার সে ভাবে আলোচিত হননি।
গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্র রাজেন তরফদার কর্মজীবন শুরু করেন ডে ওয়াল্টার টমসন-এ। বিজ্ঞাপন-জগৎ থেকেই সিনেমার জগতে আসা, ১৯৫৭-য়। তখন থেকেই সর্বক্ষণের চলচ্চিত্রকার-জীবন শুরু। শুধু পরিচালনাই নয়, অভিনয়ও করেছেন মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’ ও ‘খণ্ডহর’, শ্যাম বেনেগালের ‘আরোহণ’ আর শেখর চট্টোপাধ্যায়ের ‘বসুন্ধরা’য়।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রাজেন তরফদার সে ভাবে আলোচিত হননি।
উল্লেখ করতে হবে বারীন সাহার কথাও। মাত্র একটি ছবিই তিনি করতে পেরেছিলেন। ইতালির ফিল্ম স্কুল ফেরতা পরিচালকের ‘তের নদীর পারে’ ছবিটি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা হলেও কোনও সাড়া ফেলতে পারেনি।
গল্প হলেও সত্যি
বহুচর্চিত সমান্তরাল সিনেমা-র বাইরে বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পে স্মরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেনও তপন সিংহ। যিনি খুব ভাল করেই জানতেন সংস্কৃতিমনা বাঙালির রুচি কোন ধরনের সিনেমায়, অথচ জনরুচির সিনেমা নির্মাণে তিনি যে চলচ্চিত্র জীবনে কোন সমঝোতা করেছেন এমনটাও নয়। তিনি সেলুলয়েডে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে তারাশঙ্কর, বনফুল, সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প। অঙ্কুশ, উপহার, কাবুলিওয়ালা, ক্ষুধিত পাষাণ, ঝিন্দের বন্দী, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, নির্জন সৈকতে, জতুগৃহ, হাটে বাজারে- পর্যন্ত ছবিগুলি মোটের উপর সাহিত্য নির্ভর। এরপর আপনজন, সাগিনা মাহাতো ইত্যাদি ছবিতে আমরা তপন সিংহকে পাই একেবারে অন্যভাবে। যিনি সময়ের দাবি মেনে রাজনীতি এবং সমাজকে কেবল যে বোঝবার চেষ্টা করছেন তাই নয় সময়ের নিরিখে তাঁর নিজের কথাও বলেছেন।
কাবুলিওয়ালা: প্রথম দিকে সাহিত্যনির্ভর ছবি করেছেন তপন সিনহা। (সৌজন্য: ইউটিউব)
সময়কে আরও বেশি স্পষ্ট ও সোচ্চার হতে দেখি তার আতঙ্ক ছবিটিতে। দীর্ঘ ষাট বছরের চলচ্চিত্র জীবনে ‘অঙ্কুশ’ ১৯৫৪ থেকে শেষ ছবি ‘আনোখা মতি’ (হিন্দি) ২০০০ সাল পর্যন্ত ৬টি হিন্দি সহ মোট বিয়াল্লিশটি ছবির মধ্যে একটাও এমন ছবি নেই যা প্রযোজককে মুনাফা দেয়নি। তবে ছবিগুলির বাণিজ্যিক সফলতা দেখেও চলচ্চিত্র বোদ্ধারা নিশ্চিতভাবেই তার সিনেমা নির্মাণের মুন্সিয়ানা কিংবা শিল্পবোধকে খাটো করতে পারবেন না। ছবির জন্য কাহিনি, গান রচনা এবং সুরারোপ এমনকি কারিগরি প্রকৌশলে তপন সিংহ ছিলেন দক্ষ। স্বীকার করতেই হয় যে তপন সিংহ স্বাধীনতা-উত্তর মূলধারার সিনেমায় এযাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতা।
শ্রীমান পৃথ্বীরাজ
তরুণ মজুমদারের সিনেমার সহজ রসায়ণ ভালো গল্প ও মন ছোঁয়া গান । এই রসায়ণে পলাতক, আলোর পিপাশা, বালিকা বধু, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ফুলেশ্বরী, সংসার সীমান্তে, গণদেবতা তার উল্লেখযোগ্য কাজ। অন্যদিকে ভালোবাসা ভালোবাসা, দাদার কীর্তি, আলো দেখতে দর্শক টিকিট কাউন্টারে ভিড় করেছে।
সিনেমা সমালোচকদের আলোচনায় অনালোকিত থাকে মেইনস্ট্রিম বা মূল স্রোতের ছবি। তাই বাংলা বাংলা ছবির বিশ্লেষণাত্মক আলোচনায় জায়গা মেলে না নীরেন লাহিড়ী, অগ্রদূত, অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায, পিনাকী মুখোপাধ্যায়, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায, অসিত সেন, অজয় কর, সুশীল মজুমদার, কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, হরিদাস ভট্টাচার্য, পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়, বিকাশ রায় প্রমুখ পরিচালকদের।
কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে, বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমা শিল্প গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এদের অসামান্য অবদান রয়েছে। এদের ছবি দেখতে বাঙালি দর্শক প্রেক্ষাগৃহের টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন দিয়েছে, বিনোদিত হয়েছে বলেই প্রযোজকরা বাংলা ছবিতে লগ্নি করতে সাহস পেয়েছেন। একটি শুটিং-স্টুডিয়োর পাশে যেমন ক্যান্টিন তৈরি হয়েছে তেমনি প্রেক্ষাগৃহের বাইরে ঝালমুড়িওলা, চা-বিক্রেতা প্রমুখ ছোট ব্যবসায়ীরা অস্থায়ী আস্তানা পেতেছেন। আজ ওই অবস্থা ব্যাবস্থাটা পুরোপুরি বদলে মাল্টিপ্লেক্স চর্চায় পরিণত হয়েছে। একে একে কলকাতার ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রেক্ষাগৃহগুলি যেমন মল বা মাল্টিপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে তেমনি বাংলা ছবির ভূত ভবিষ্যৎ কুক্ষিগত হয়েছে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর একচেটিয়া বাণিজ্যে। ইতিহাস হলেও ওইসব ছবিগুলি আমাদের মূল স্রোতের সিনেমায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
দীপ জ্বেলে যাই
গত শতকের পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মূলস্রোতের বাংলা সিনেমার সুবর্ণযুগের সুচনা হয়েছিল পিনাকী মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ঢুলি, চৌরঙ্গি, অগ্রদূতের অগ্নিপরীক্ষা, সবার উপরে, সাগরিকা, পথে হল দেরি, কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত চন্দ্রনাথ, অজয় কর পরিচালিত হারানো সুর, সপ্তপদী, সাত পাকে বাঁধা, চিত্ত বসুর মায়ামৃগ, ছেলে কার, বন্ধু, সুশীল মজুমদারের পুষ্পধনু, হসপিটাল, লালপাথর, অসিত সেন পরিচালিত চলাচল, পঞ্চতপা, দীপ জ্বেলে যাই, উত্তর ফাল্গুনী, মমতা, সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত শাপমোচন, শেষ পর্যন্ত, দুই ভাই, যাত্রিকের কাঁচের স্বর্গ, স্মৃতিটুকু থাক, নীরেন লাহিড়ীর ইন্দ্রাণী, রাইকমল, হরিদাস ভট্টাচার্যর সন্ধ্যা দীপের শিখা , কমললতা, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের অদ্বিতীয়া, সলিল দত্ত পরিচালিত স্ত্রী, সরোজ দে পরিচালিত ডাকহরকরা, বিজয় বসু পরিচালিত আরোগ্য নিকেতন, বিকাশ রায় পরিচালিত মরুতীর্থ হিংলাজ, কেরী সাহেবের মুন্সী, অরবিন্দ মুখার্জীর ধন্যি মেয়ে, অগ্নিশ্বর, সুনীল ব্যানার্জীর দেয়া-নেয়া এমন আরও বহু বাংলা ছবি বাঙালি দর্শকদের স্মৃতিতে উজ্বল হয়ে আছে ।
উজ্জ্বল এক ঝাঁক
পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময় থেকে সত্তর আশির দশকের মাঝ বরাবর - এই ত্রিশ বছরে বাংলা ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যের রসায়ণ ছিল সাহিত্যনির্ভর, একথা বলাই যায়। সেই সঙ্গে উল্লেখ করতেই হয় ছবির গানের কথা। হেমন্ত, মান্না, সন্ধ্যা, আরতি, শ্যামল, মানবেন্দ্র প্রমুখ শিল্পীদের গাওয়া গান আর রোম্যান্টিক অভিনয়। উত্তমকুমার, ছবি বিশ্বাস, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, পাহাড়ী সান্যাল, বসন্ত চৌধুরী, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, সুচিত্রা সেন, অনুভা গুপ্তা, ছায়া দেবী, অরুন্ধতী দেবী, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়, পরিচালকের শিল্পরুচি মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শকদের মন ছুঁতে পারতো।
সোনা ঝরা সন্ধ্যা
মূলস্রোতের বাংলা ছবিতে সিনেমা ভাষা কিংবা শিল্প রূপের সন্ধান করতে যাওয়াটা নেহাতই বোকামি তবে তখনকার অধিকাংশ পরিচালকই সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে ছিলেন সৎ এবং নিষ্ঠাবান।
সিনেমার নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে তাদের অক্ষমতা বা উদাসীনতাই বাংলা সিনেমাকে সাহিত্য নির্ভর করেছিল একথা যেমন ঠিক পাশাপাশি এটাও ঘটনা সেই সময়ের বহু পরিচালক, চিত্রগ্রাহক এবং অন্যান্য কলাকুশলীদের সিনেমা বোধ এবং প্রযুক্তিগত ধারণা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। বাঙালির রুচি, মুল্যবোধ এবং মানসিকতাই ছিল তাদের ছবির রসায়ন। তা ছাড়া সিনেমাই তখন বিনোদনের সর্বোত্তম মাধ্যম।
তখন সিনেমার গান, সিনেমার বই, আরও অনেক কিছুই ছিল সিনেমা সম্পর্কিত। মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বাঙালি তাই সিনেমা হলে ভিড় জমাত।
ঋণ: ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, আহসান আহমেদ, ইরাবান বসুরায়, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়