পুরুষদের টেক্কা দিয়ে ভোপালে রাজত্ব করেছেন বেগমরাও
আগের দুই শতকে ভোপালের বেগমরা ছিলেন একাধারে নির্ভীক ও প্রগতিশীল
- Total Shares
মাত্র ১৮ বছর বয়সী এক বিধবা যে তাঁর ছোট্ট মেয়েকে রানি হিসেবে ঘোষণা করেন;একজন নারী যাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন খোদ তাঁর স্বামী, সেই রানি বেঁচে তো যানই, এমনকি পরে তিনিই তাঁর স্বামীকে বন্দী করেন।তিনি নিজে একজন রাজমহিষী হয়েও তাঁর মেয়েকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন।একনও পর্যন্ত তিনিই একমাত্র রানি যিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা আচার্য।
উনিশ ও বিশ শতকে ভোপালে বেশ কয়েকজন নির্ভীক ও প্রগতিশীল শাসকের জন্ম হয়, এঁরা খুবই সংস্কারমুখী, জনপ্রিয় ও সাহসীশাসক ছিলেন এবং এঁরা সকলেই ছিলেন মহিলা-নবাব।
ইতিহাসে বহু রাজমাতা ও প্রভাবশালী রাজমহিষীদের সম্বন্ধে আমরা পড়েছি যাঁরা নেপথ্যে থেকে দেশশাসন করেছেন।কিন্তু ভোপালের মহিলা শাসকরা ছিলেন একেবারে আলাদা।১৮১৯ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে ভোপালে চারজন মহিলা শাসক রাজত্ব করেন।এঁদের নবাব বেগম বলা হত।এঁরা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজপাট সামলেছেন।
বেগমও কা ভোপাল ছবির একটি দৃশ্য
বেগমও কে ভোপাল
নবাব-বেগমদের ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক জীবন ও রাজত্বকাল নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে।
ভোপালবাসীদের প্রতিদিনের জীবনে তারা যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন। ভোপালের মানুষের চেতনার জাগরণ ও চরিত্র গঠনে এঁদের মস্ত বড় ভূমিকা রয়েছে।এই নবাব-বেগমদের জীবনের নানা জানা-অজানা ঘটনা নিয়েই তৈরি হয়েছে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি 'বেগমও কে ভোপাল'।এই ইতিহাস-নির্ভর ছবিতে দেখান হয়েছে যে কী ভাবে এঁদের ছায়া ভোপালের মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে এখনও প্রভাবিত করে চলেছে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন মুম্বাইয়ের জেভিয়ার ইনস্টিটিউট অফ কমিউনিকেশনস এবং পুনের এফটিআই প্রাক্তনী বছর তিরিশের রচিতা গোরোওয়ালা।ছবিটা filmsdivision.org ওয়েবসাইটটে জানুয়ারি মাস থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
বেগমদের জীবনের কয়েকটি সত্যের সন্ধান করার জন্যই গোরোওয়ালা এই ছবিটা বানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, "সেই সব পাঠান মহিলা-শাসক যাঁরা ভোপালে প্রায় ১০০ বছর ধরে শাসনকাজ পরিচালনা করে গেছেন, তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আমি 'বেগমও কে ভোপাল' বানিয়েছি। গোড়ায় ইতিহাসকে ভালোবেসে সিনেমাটা বানাতে শুরু করি, কিন্তু এই বিষয়টার প্রতি আমার আকর্ষণ যেন বাড়তেই থাকে।"
সিনেমাটিতে 'হুজোন' বলে একটি পারসি শব্দ বার বার শোনা গিয়েছে। কথাটির মানে হল যে সব দিন হারিয়ে গেছে সেই দিনগুলোতে স্মৃতির মধ্যে দিয়ে ফিরে পাওয়ার আকক্ঙ্ক্ষা। সিনেমাটিতে সবকটি চরিত্র তাদের নিজেদের অতীতের কথা বার বার মনে করে, এর ফলে পুরোনো ভোপালের চেহারাটা সিনেমায় ফিরে ফিরে আসে।
বিভিন্ন চরিত্রের স্মৃতিরোমন্থনের দৃশ্যগুলিতে স্পেশাল এফেক্ট দেওয়ায় তা আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মোতি মহল, শওকত মহল ও তাজ-উল-মসজিদের মতো ইতিহাসের অনন্য নিদর্শনগুলো আজও পুরোনো ভোপালের কথা মনে করায়। ফিরোজা খানের সুর ও তাঁর গলায় গানটি সিনেমাটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।তিনি এই রাজবংশেরই একজন সদস্য। এই সিনেমাটিতে তিনি একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন।
গোরোওয়ালা বলেন, "সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আমি শিখেছি যে একটা সিনেমা শুধু একটা গল্পই বলে না, একটা নির্দিষ্ট সময়কালকেও তুলে ধরে। আমরা একটা গল্প শুনি বা সেটা পড়ি। সিনেমায় বিভিন্ন দৃশ্যের আবহে গান বা সুর ব্যবহার করে সেই দৃশ্যকে আবেগপূর্ণ করে তোলা হয়।"
'বেগমও কা ভোপাল' পরিচালকের একটি সঙ্গীতময় তথ্যনির্ভর স্বল্পদৈর্ঘের ছবি। গোরোওয়ালা বলেন, "সিনেমাটির একজন লেখক, একজন পুরোনো ছবির সংগ্রাহক এবং রাজপরিবারের কয়েকজন উত্তরাধিকারী, কয়েকজন সেবক আর তাঁদের সঙ্গে রয়েছে পুরোনো ভোপালের স্মৃতিচরণের গাথা। তাঁরা নিজেদের মতো করে পুরোনো সময়টাকে ধরে রাখতে চান।"
কতকগুলো বিচ্ছিন্ন দৃশ্যের কোলাজে পুরোনো ভোপালের ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা ছবিটিতে অন্য এক মাত্রা যোগ করেছে— পথ চলা একজোড়া পায়ের ক্লোজআপ, নিপুণ হাতে সূচের কাজের শট বা পাতাঝরার দৃশ্য।
সালাউদ্দিন, লেখক মনজুর ইতিসাম, নবাবিয়ৎ ফিরোজা খান ও মিনো আলি, রাজবংশের সেবক জোহরা ফুপ-এই সবকটা চরিত্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সিনেমায়। ছবিতে তিনজন মহিলা চরিত্র অতীতের প্রতীক। এঁরা এখনও জীবিত আছেন। সিনেমায় দুজন পুরুষকে দেখান হয়েছে যাঁরা বারবার ফিরে যান নিজেদের অতীতে।
একটি দৃশ্যে দেখান হয়েছে যে ১৯৬১ সালে রাজবাড়িতে বিয়ে করে আসার গল্প বলছেন ফিরোজা। এই দৃশ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে ফিরোজার গল্পের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যগুলো এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যাতে দেখানো হচ্ছে ফিরোজা বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে উঠছেন। দেখানো হচ্ছে ফিরোজ কানে দুল পরছেন, হাতে পরছেন বালা আর চোখে লাগাচ্ছেন সুরমা।
ভোপালের বেগমরা
সিনেমাটা তৈরি করার গোরোওয়ালার কাছে অনেক উপাদান ছিল। বড় বৈচিত্র্যময় জীবন ছিল ভোপালের বেগমদের। কুদশিয়া বেগম তাঁর রাজসভার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পরামর্শ খারিজ করে তাঁর ছোট্ট মেয়েকে ১৮১৯ সালে রাজ্যের পরবর্তী শাসক হিসাবে ঘোষণা করে দেন।
সইফ আলি খান। ছবি:ইন্ডিয়া টুডে
দীর্ঘ ১৮ বছর কুদশিয়া সিংহাসনে তার কন্যার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। নিজের রাজ্যকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, মারাঠা-সিন্ধিয়া-হোলকার ও গায়কোয়াড়দের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। যদিও, রাজ্যের বেশ কয়েকজন পারিষদ ব্রিটিশদের কাছে বেগমের বদনাম করেন। এভাবেই ভোপালের রাজবংশ রাজ্যের কন্যা সন্তানদের ও তাঁদের স্বামীদের অধীনে চলে আসে।কুদশিয়ার মেয়ে সিকান্দারের বিয়ে হয় তাঁরই এক জ্ঞাতি-ভাই জাহাঙ্গিরের সঙ্গে। জাহাঙ্গির তেমন একটা জনপ্রিয় ছিল না, এমনকি জাহাঙ্গির তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে খুন করারও চেষ্টা করে। সিকান্দার নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে একটি দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরে অবশ্য সিকান্দার তাঁর স্বামীকে বন্দিও করেন।
২৬ বছর বয়সে জাহাঙ্গিরের মৃত্যু হয়। তার ছয় বছরের কন্যা সন্তান শাহজাহানকে রাজ্যের পরবর্তী শাসক ঘোষণা করা হয়। শাহজাহান বেগমের বিয়ের পর তাঁর স্বামী রাজ্য শাসন করেন। উত্তরাধিকারের ধারা নিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে কুদশিয়ার অনেক মনোমালিন্যের পর ব্রিটিশরা সেই ধারাটা জোর করে বাতিল করে দেয়। তাই প্রথমে সিকান্দার তারপর শাহজাহান বেগম ভোপালের শাসক হন। ১৯০১ সালে শাহজাহান বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা সুলতানজাহান রাজত্ব ভার সামলান।
কুদশিয়া লেখাপড়া জানতেন না এবং সারাজীবন পর্দার আড়ালেই থেকেছেন। তবে সমস্ত রকম সংকটের মোকাবিলা করেছিলেন সাহসের সঙ্গে। একজন রাজা যা যা প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন, সেই সব রকম প্রশিক্ষণই সিকান্দার পেয়েছিলেন। শাহজাহান ছিলেন অত্যন্ত নারীসুলভ। সিকান্দার এই চারজন মহিলা শাসকদের মতো তেজি ছিলেন না। তিনি অনেক বইও লিখেছিলেন। আবার সুলতানজাহানও পর্দার পেছনেই ছিলেন সারা জীবন, তা সত্ত্বেও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা আচার্য হন।
সুলতানজাহানের পর রাজ্যের শাসক হন ওংরই ছেলে মোহম্মদ হামিদুল্লা খান।১৯৬০ সালে হামিদুল্লার মৃত্যুর পর তাঁর সব চেয়ে ছোট মেয়ে সাজিদা সুলতান শাসক হন। হামিদুল্লার সব চেয়ে বড় মেয়ে আবিদা সুলতানের বিয়ে হয়ে পাকিস্তানে চলে যান তাই সাজিদা সুলতান রাজ্যভার পান। সাজিদার স্বামী ইফতিকার আলি খান পটৌডি হলেন অভিনেতা সইফ আলি খানের পিতামহ।
এখানে বলে রাখা ভালো, আবিদা সুলতানের ছেলে শাহরিয়র এম খান ছিলেন পাকিস্তানের বিদেশ সচিব। তিনি তাঁর পূর্বজদের নিয়ে 'দা বেগমস অফ ভোপাল' বইটি লেখেন।