বাউল শিল্পী সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমির পুরস্কার পাওয়ায় উজ্জীবিত হবেন শিল্পীরা
বাউলকে বিশ্বের সংগীতের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাব
- Total Shares
পুরস্কারটি যখন ঘোষণা করা হয় তখন আমি দেশে ছিলাম না, তাই খবরটাও পাইনি। হাঙ্গেরি বিমানবন্দরে বসে খবরটি আমার এক বন্ধু আমাকে প্রথম দেয়। ভারতে ফিরে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যানের ই-মেল পড়ে পুরো বিষয়টা জানতে পারলাম।
সত্যি কথা বলতে কি, স্বীকৃতি পেতে সবার ভালো লাগে তাই নিঃসন্দেহে আমারও ভীষণ ভালো লেগেছিল খবরটা পেয়ে। কিন্তু সব থেকে আনন্দের ব্যাপার যেটা সেটা হল এই পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে বাউল সাধনভজন ও বাউল সাধক যাঁরা এতো বছর ধরে ভোজন করে চলেছেন তাঁদেরও সম্মানিত করা হল।
তারপর অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারি যে এই প্রথমবার রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত, নৃত্য ও নাটক অ্যাকাডেমি কোনও বাউল শিল্পীকে এই পুরস্কারটির জন্য নির্বাচন করেছে।
এই পুরস্কার পাওয়ার ফলে আমরা বাউলরা যে স্বীকৃতি পেলাম এটা একটা বিরাট অনুপ্রেরণা। তাই নিঃসন্দেহে বাউল পরম্পরাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। ভারতীয় সঙ্গীত পরম্পরার মধ্যে একটি অতি প্রাচীন পরম্পরা হল বাউল। অন্যান্য সঙ্গীতশিল্পের ক্ষেত্রে যেমন বিভিন্ন ধরণের পুরস্কার কিংবা বৃত্তি দেওয়া হয়ে থাকে বাউলের ক্ষেত্রে তেমন কিছু নেই সংগঠনটিকে চর্চা হয় সেটা বাউলের ক্ষেত্রে নেই। তাই যে সব বাউলরা সাধনভজন করেন তাঁরা মাধুকরী-বৃত্তি করেই জীবনযাপন করেন ও সাধনভজন চালিয়ে যান।
এই সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি একজন বাউল শিল্পীকে সম্মান দিল তেমন ভাবেই সরকার যদি বাউল সাধনাকে আর্থিক সহায়তার কথা মাথায় রেখে কোনও রকম পরিকল্পনা করেন তাহলে নিঃসন্দেহে এঁরা আরও ভালোভাবে নিজেদের সাধনভজন করতে পারবেন।
বাউল শুধুমাত্র একটা লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের একটি অংশ মাত্র নয়, এটা একটা চিন্তাময় জগৎ। বাউলের গুরুমুখী বিদ্যা অর্থাৎ গুরু-শিষ্য ঘরানা একটি অতি প্রাচীন ঘরানা। এটা সম্পূর্ণ শ্রুতি নির্ভর বিদ্যা।
তবে আমার দিক থেকে আমি মন-প্রাণ দিয়ে বাউলের উন্নতি ও বাউলকে বিশ্বের সঙ্গীতের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাব। বাউল যদি শুধুমাত্র বিনোদন সঙ্গীত হয়ে দাড়ায়ে তাহলে হয়তো তা জনপ্রিয়তা পাবে তবে যদি আমরা মূল সাধনভোজনকে ঠিক করে না চালিয়ে যাই তা হলে আসল বাউল পরম্পরাটাই হারিয়ে যেতে পারে। গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাঁরা দিনরাত বহু শতাব্দী ধরে সাধনা করে চলেছেন তাঁদের কারণেই আজও বাউল ঘরানাটা টিকে আছে। তাই এই সব বোষ্টম ও বোষ্টমীরা বাউলকে ধরে রেখেছে।
তবে যাঁরা প্রকৃত বাউল সাধক তাঁরা উন্নতির কথা ভেবে সাধনা করেন না। আমার গুরুদেব শশাঙ্ক গোঁসাই বা সনাতন বাবা-- তাঁরা যে ভাবে আত্মনিবেদন করে সাধনভজন করতেন সেটা এযুগে সম্ভব হয় না এবং তাঁরা তাঁদের এই আত্মনিবেদন জন্য বিভিন্ন সময় অত্যন্ত দারিদ্র্যের মুখোমুখি হয়েছেন তবুও তাঁরা যে ভাবে সাধনা করে গেছেন সেই পরিবেশ এখন আর নেই। তার প্রধান কারণ গ্রামের অবস্থা ও দৈনন্দিন জীবনযাপন পালটে গেছে। তাই সাধারণ মানুষও বাউলকে বোঝার গভীরতা হারিয়ে ফেলেছেন তবে সবকিছুই পুনরায় উদ্ধার করা সম্ভব।
এমন অনেক আখড়া এখনও আছে যেগুলো প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো সেই সব আখড়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে না হলে বাউলের মূল নির্যাসটাই হারিয়ে যাবে। বাউলকে শুধুমাত্র জনপ্রিয় করে তোলাই যথেষ্ট নয়, এই পরম্পরাটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
আমি আমার গুরুদেব সনাতনবাবার নামে বোলপুরের কাছে একটি গুরুকুল নির্মাণ করেছি যেখানে বাউল তত্ত্ব, বাউল গান, বাউল পুঁথি ও বাউল সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করা হবে। এই গুরুকুলটির নাম সোনাতনবাবা নিজেই রেখেছিলেন -'সনাতনসিদ্ধাশ্রম'। তাই আমি আমার গুরুর কৃপায় সাধ্যমতো যতটুকু পেরেছি ততটাই করার চেষ্টা করেছি।
এই সম্মানটা এবং জীবনে যা কিছু পেয়েছি সে সব শুধুমাত্র আমার নয়, তাই আমি এই সম্মানটি পুরো বাউল পরম্পরা এবং আমার গুরুদের প্রতি নিবেদন করলাম।