প্রেমের প্রভাব খাবারেও, প্রেমিক আগা বাখর ও প্রেমিকা খনি বেগমের নামাঙ্কিত বাখরখানি
রুটি জাতীয় এই খাবার শুধু রাজপরিবারে আবদ্ধ ছিল না, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল
- Total Shares
খাদ্যপ্রেমীদের কাছে নিহারী কোন অপরিচিত নাম নয়। কনকনে শীতের সকালে কম্বলের মায়া ত্যাগ করে কলকাতার খাদ্যপ্রেমীদের ভোর পাঁচটায় জাকারিয়া স্ট্রিটে সুফিয়ার সামনে চাতক পাখির মতো জড়ো হতে দেখাটা প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। বাখরখানি তুলনায় কম জনপ্রিয় হলেও রমজানের মাসে যাঁরা ক্যামেরা ও হজমের ওষুধ নিয়ে জাকারিয়া অ্যাটাক করেন, তাঁদের দৃষ্টিগোচর ও উদরপূর্তি হয়ে থাকবে।
আমি অবশ্য এই দুটি জিনিষই কেবল ফেসবুকের নিউজ ফিডে এযাবত দেখে এসেছি। কৌতূহল যারপরনাই বৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু স্বাদ আহরণের সুযোগের ঘাটতি থেকে গেছে (অবশ্যই সেটা কুঁড়েমির জন্য)। তাই ‘নো ইওর নেবার’ নামক একটি সমাজসেবী সংগঠন যখন জানুয়ারি মাসে খিদিরপুরে ব্রেকফাস্ট উইথ বাখরখানি নামে একটি ফুড-টকের আয়োজন করে, আমি তৎক্ষণাৎ নাম রেজিস্টার করাই।
১৩ জানুয়ারি সকাল ন’টায় খিদিরপুরে মনসাতলা রো-তে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন বিভিন্ন বয়সের, ধর্মের ও পেশার মানুষ জড়ো হয়েছেন, সঙ্গে অবশ্যই আছেন বেশ কিছু আঞ্চলিক বাসিন্দা। খাবার যে জাতিধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মেলবন্ধন ঘটাতে পারে, এ তার এক জাজ্বল্য উদাহরণ।
বাখরখানির আবিষ্কার হয়েছিল বাংলাতেই [ছবি: লেখিকা]
বাখরখানির ইতিহাস জানার আগে আর একটি খাদ্যজগতের শব্দের সঙ্গে একটু বেশি পরিচিত হলাম। শব্দটি হল দাস্তারখান। তুর্কী এই শব্দটির অর্থ হল টেবলক্লথ বা চৌকো কাপড়ের টুকরো যেটি বিছিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ, পরিবারের সকল সদস্য ও অতিথিদের জন্য খাবার পরিবেশন করেন। একত্রে খাওয়া এবং খাবারে প্রাচুর্য থাক বা দীনতা, সকলকে সমান ভাগের মর্যাদা দেওয়াই হল এই সুন্দর প্রথার উদ্দেশ্য। বলাই বাহুল্য, দাস্তারখান মানুষকে মানুষের কাছে নিয়ে আসে।
বাখরখানির ইতিহাসে যে একটি অম্লান প্রেমের গল্প লুকিয়ে আছে তা আমার একেবারেই অজানা ছিল। তবে বাখরখানি সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য বোধহয় যে এটির জন্ম বাংলার বুকে। সদস্য সাবির আহমেদ বিস্তারিত ইতিহাস দিলেও আমি একটু ছোট করে এখানে লিখছি। ১৭০০ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ দেওয়ানি লাভ করে বাংলায় আসেন। সঙ্গে আনেন বালক আগা বাখর খানকে। অনেকে বলেন আগা তাঁর ছেলে ছিল, তবে এ বিষয়ে মতবিরোধ আছে। আগা কে তিনি ছেলের মতনই মানুষ করেন এবং শক্তিশালী ও সুপুরুষ আগা অচিরেই সৈন্যবাহিনীতে উচ্চ পদে আসীন হন। পরবর্তিকালে মুর্শিদকুলি খাঁ মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থাপন করেন। আগা তখন চট্টগ্রামে উচ্চপদে ছিলেন। এই সময়ে তিনি আরামবাগের (বর্তমান বাংলাদেশে) নর্তকী খনি বেগমের প্রেমে পড়েন। দুজনের এই প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন আরেক প্রভাবশালী রাজসদস্যের পুত্র জয়িনুল খাঁ। জয়িনুল নানা ভাবে খনিকে পাওয়ার চেষ্টায় বিফল হয়ে শেষে অপহরণ করলে আগা তাঁকে প্রবল বাধা দেন এবং জয়িনুল কিছুকাল গা ঢাকা দেন। গুজব রটে, জয়িনুলকে হত্যা করেছেন আগা। এই গুজবে জয়িনুলের বাবা শোকে উন্মত্ত হয়ে আগাকে গ্রেফতার করান। ন্যায়পরায়ণ মুর্শিদ আগাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাঘের সঙ্গে খাঁচায় বন্দী রাখেন।
আগা কিন্তু বাহুবলে বাঘকে হত্যা করে খাঁচা ভেঙ্গে পালিয়ে যান। জয়িনুল ইতিমধ্যে ফিরে এসে আবার খনি বেগমকে নিয়ে এক গভীর জঙ্গলে আটকে রাখেন। খনি পালাতে গিয়ে একটি সাপের ছোবলে আক্রান্ত হন। শোনা যায় যে আগা বাখর তখন খনিকে উদ্ধার করতেই আসছিলেন। দুজনের পথে দেখা হয় এবং খনী বাখরের কোলে মাথা রেখেই মারা যায়। পরবর্তী কালে আগা বাখর বিধায়কের পদ গ্রহণ করেন ও নানা সমাজসেবা মূলক কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। তিনি মুর্শিদের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। রন্ধনশালে নানা রান্না নিয়ে চর্চা করতে করতে তিনি একটি রুটি জাতীয় খাবার তৈরি করেন এবং সেটি বাখর ও খনির প্রেমের স্মৃতিস্বরূপ নাম দেন বাখরখানি। তিনি তাঁর এই আবিষ্কারকে রাজপরিবারের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই বাংলাদেশের নানা অঞ্চল যেমন ঢাকা, বাখরগঞ্জ, বরিশাল প্রভৃতি জায়গায় বাখরখানি খুবই জনপ্রিয় খাবার হয়ে ওঠে।
মটন নিহারির সঙ্গে বাখরখানি সত্যি উপাদেয় [ছবি: লেখিকা]
কিন্তু বাখরখানি যখন বাংলার বাইরে যাত্রা করল তখন এর রূপ কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেল। তাই কাশ্মীরে এখন একধরণের বাখরখানি পাওয়া যায়, কলকাতায়ে আরেক ধরনের এবং ঢাকায় ও বাংলাদেশের কিছু জায়গায়ে আদি বাখরখানির কিছুটা খোঁজ মেলে। বাখরখানি মুলত ময়দার তৈরি রুটি জাতীয় হলেও গঠন ও স্বাদ দুই-ই ভিন্ন, জায়গা অনুযায়ী। বাংলাদেশে যারা বাখরখানি খেয়েছেন তাঁরা জানবেন যে ওখানে খাবারটি অনেকটা নিমকি বা বিসকুটের মতো। কলকাতার বাখরখানির লুচির সাথে সাদৃশ্য বেশী। বাংলাদেশের ছোট ও বড় শহরে বাখরখানি এখনও খুবই জনপ্রিয় খাবার। কিন্তু কলকাতার বুকে এটি প্রায়ে হারিয়ে যেতে চলেছে বড় বড় খাদ্যবাণিজ্যের প্রকোপে। খিদিরপুরে এখন মাত্র দুটি জায়গায়ে বাখরখানি পাওয়া যায়। তাই কলকাতার মানুষকে এই ঐতিহ্যশালী খাবারের সঙ্গে পরিচিত ও জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা করছেন এই সংস্থা। শুধু গল্প নয়, বাখরখানির স্বাদ আহরণের ব্যাবস্থাও রেখেছিলেন ‘নো ইওর নেবার’। সঙ্গে ছিল নিহারি বা নাহারি।
আগেই বলেছি, খাদ্যরসিক বাঙ্গালির অভিধানে নিহারি কথাটি বেশ স্বর্ণাক্ষরেই লেখা আছে। প্রধানত শীতকালীন এই স্ট্যু জাতীয় খাবারটি তৈরি হয় পশুর মাংস দিয়ে। শুধু পায়ের হাড় ও মাংস ব্যবহার করা হয়, কোনও কোনও জায়গায় তার সঙ্গে মগজ এবং জিহ্বাও ব্যবহারও হয়। শহরের দুই রন্ধনশিল্পী তালাত কাদরি ও মঞ্জিলাত ফাতেমা এসেছিলেন নাহারি সম্বন্ধে বিশদ জানাতে। তালাত রান্না শেখানও। মঞ্জিলাতকে মোটামুটি সারা কলকাতা বেশ এক ডাকেই চেনে। তিনি শুধুমাত্র নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর বংশধর নন, তাঁর রেস্তরাঁ মঞ্জিলাতে খাওয়ার জন্য রীতিমতো বুকিং করতে হয়।
নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর (ছবি) সঙ্গে আসা বালক আগা বাখর খান পরবর্তীকালে বাখরখানি আবিষ্কার করেন [সৌজন্য: উইকিমিডিয়া]
নিহারি শব্দের উৎস হল আরবীয় শব্দ নাহার যার মানে সকাল। তাই নিহারি খেতে হয় প্রাতঃরাশে। এটির বিশেষত্ব হল এর মশলা -- যাকে গুঁড়ো বা কোটি মসালা বলে- এই মশলা সাধারণত গোপন রাখা হয় কারণ মশলার দ্বারাই নিহারির গুণবিচার হয়। সারা রাত মাংস, হাড়, মশলা ও ঝোল বিশাল ডেকচির মুখ বন্ধ করে ঢিমে আঁচে রান্না করা হয়। হাড়ের রস ঝোলে মেশে বলে এটি খেলে শরীর গরম থাকে। কেউ বলে এর উৎপত্তি অওয়ধে (অযোধ্যা) হয়েছিল, সেখান থেকে কলকাতায় আসে, আবার কেউ বলেন দিল্লিতে। তবে এটি লখনউ, হায়দরাবাদ, দিল্লী এবং অবশ্যই কলকাতায়ে জনপ্রিয়। প্রত্যেক জায়গার মশলা আলাদা। কলকাতায়ে ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা এটি ডালপুরি দিয়ে খাওয়ার চল করেছিলেন। তবে কলকাতার মুসলিম সম্প্রদায় এটি একটি স্পেশাল তন্দুরি রুটি বা কুলচা দিয়ে খেতে পছন্দ করেন।
গল্পের পরে খাওয়ার পালা। বাখারখানি সঙ্গে বিফ ও গোট দুই রকম নিহারির ব্যবস্থাই ছিল। খেতে যে দুটিই অত্যন্ত সুস্বাদু সে আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গে নানখাটাই নামে একটি বিস্কুটও ছিল। খাবার সম্বন্ধে জানাশোনার সঙ্গে একটা ব্যাপার আবার নতুন করে শেখা হল এই দিনটি, যে কলকাতা্র মানুষ এমন একটি কম্যুনিটি যারা খাবারের বিচার কেবল গুণ দিয়ে করেন, কে বা কোন সম্প্রদায় তৈরি করেছে তা দিয়ে নয়। শুধুমাত্র খিদিরপুর অঞ্চলেই হিন্দু, খ্রিস্টান ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি বাস করছেন বহু দিন যাবত। যে জায়গাটিতে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল সে রাস্তার নাম মনসাতলা রো এবং ফেরার পথে মা মনসার মন্দিরটিও চোখে পড়েছিল। বেঁচে থাকুক আমার শহর এই নির্মল মন নিয়ে। অন্য কোন রঙের কদর্য কালি কখনোই যেন না পড়ে এই শহরের বুকে।