হায়দরাবাদে হালিম খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেলাম একখণ্ড ইয়েমেন

বারকাসে মধ্যএশিয়ার উপজাতিরা এখনও নিজের সংস্কৃতি ও ভাষা রক্ষা করে চলেছে

 |  5-minute read |   16-05-2018
  • Total Shares

আমি ও আমার বন্ধু তথা ভ্রমণসঙ্গী অলকা কৌশিক ঠিক করলাম হায়দরাবাদ যাব। জায়গাটা সম্পর্কে একটু পড়াশোনাও করে ফেললাম। অলকা একজন ভ্রমণ লেখক, সেও ওখানকার বারকাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করল। ও যখন আমাকে বারকাসের ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক নানা কথা শোনাল, আমিও খুব মুগ্ধ হয়ে বারকাসের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে দারুণ সব ইতিহাস জানতে পারি।

প্রায় ২০০ বছর আগে, হায়দরাবাদের নিজাম যখন প্রতিবেশী প্রদেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত, তখন তিনি একদল শক্তিশালী ও বিশ্বাসী সোনার প্রয়োজন অনুভব করেন। তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন বটে, তবুও তিনি ইয়েমেন থেকে হাদরামি আরবিদের নিজের ব্যক্তিগত রক্ষী হিসেবে নিয়োগ করেন। এঁরা ছিলেন নিজামের দেহরক্ষী। এঁদের চাউস বলা হত। এই চাউসরা শহরের বাইরে ব্যারাকে বাস করতেন। আমার যতটা অনুমান, এর পরে এঁদের বংশ বৃদ্ধি হয় ও পরে ব্যারাক কথাটি অপভ্রংশ হয়ে বারকাস হয় যায়।

ঘটনাগুলো বেশ মজার হলেও, আমি যেহেতু একজন খাদ্যরসিক ও রন্ধন রসিক তাই আমার আগ্রহের দিকটা ছিল অন্য জায়গায়। আমরা উত্তর ভারতে লোকেরা যেমন খিচড়া খেয়ে থাকি ঠিক তেমনই হায়দরাবাদের লোকেরা হালিম খান। উত্তর ভারতে খিচড়া তৈরি করা হয় গম-সমেত সাত রকমের শস্য, নানারকম মসলা ও মাংস দিয়ে। খিচড়া একটু দানাদানা খেতে হয়।

যদিও এই দুটো রান্নাই অনেকটা এক রকম, কারণ দুটো রান্নাতেই মাংস ও গম ব্যবহার করা হয়, কিন্তু রান্নার প্রণালী ও স্বাদ একেবারে অন্য রকম। হালিম অনেকটা আরবের হারিসের মতো দেখতে ও খেতে। বুঝলাম আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। হালিম ভারতে আসে এই আরবি চাউসদের হাত ধরে। এই খাবারগুলো সম্বন্ধে পড়ার সময়ও এই একই তথ্য উঠে এল।

আমি বহু বছর পশ্চিম এশিয়ায় কাটিয়েছি, তাই ওঁদের খাওয়াদাওয়া ও জামাকাপড় সম্বন্ধে আমার একটা সম্যক ধারণা আছে। বন্ধুরা মিলে যখন রাতে রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে যেতাম, তখন আরবি পোশাক পরা ও মাথায় ডোরাকাটা পাগড়ি বাঁধা অনেক লোকজন দেখতাম। তেমনই একটি রাতে যখন বান্দ্রা মাইল রাশা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখেছিলাম রাস্তা দিয়ে তিনটে বাচ্চা হেঁটে যাচ্ছে যাদের পরণে আরবি জামা। কণিষ্ঠটির বয়স হবে তিন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম তারা জলসা দেখতে গিয়েছিল।

ওমানের কথা মনে পরে যাচ্ছিল। ওই দেশে আমি চমৎকার তিনটে বছর কাটিয়েছিলাম। আমি যেখানে থাকতাম সেই জায়গাটা ইয়েমেনের সীমান্তে ছিল বলে অনেক ইয়েমেনি লোকজনও সেখানে বাস করতেন। এখানকার মান্ডি দোকানগুলো দেখলাম। খুব ভালো সুগন্ধী চালের সঙ্গে মুরগি বা ভেড়ার মাংস ও নানা রকম মসলা যোগ করে খুব কম আঁচে রান্না চাপানো হয়েছিল একটি দোকানে। বিরিয়ানির আরবি সংস্করণ। হাঁটতে হাঁটতে অত্যন্ত জনপ্রিয় দোকান মাতাম-আল-আরবির দেখতে পেলাম। রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল বলে ওখানে আর খেতে গেলাম না। আমার বন্ধুরা বলল রমজানের সময় জায়গাটা জমজমাট হয়ে থাকে। শহরের এই দিকটির মতো অন্যদিকেও বহু মান্ডি দোকান হয়েছে এখন। এই মান্ডি দোকানগুলো তাদের খাবারদাবারের জন্য বেশ জনপ্রিয়।

পরেরদিন সকালে আমি আবার এখানে এলাম। এখানে আমার এক দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হল যাঁদের পূর্বপুরুষ অনেক কাল আগে ইয়েমেন থেকে ভারতে চলে এসেছিল। কিন্তু এই দম্পতি সঠিক বলতে পারলেন না যে ঠিক কত বছর আগে তাঁদের পূর্বপুরুষ এদেশে চলে আসেন ও এখানেই থেকে যান।

একটা জিনিস দেখে খুবই আশ্চর্য্য লাগল, বারকাসগুলোতে ইয়েমেনিরা এখনও তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ঠিক আগের মতো অক্ষত রেখেছেন।

যদিও তাঁরা এক অদ্ভুত উচ্চারণে হায়দরাবাদি উর্দুতে কথা বলছিলেন, কিন্তু বাড়িতে তাঁরা আরবি ভাষাতেই কথা বলেন। খুবই যত্ন সহকারে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, নিজেদের ভাষা ও ঐতিহ্যমণ্ডিত পোশাকআশাক এবং নিজেরদের চিরাচরিত খাবারগুলোকে এখনও তাঁরা বজায় রেখেছেন।

আমি কখনও ইয়েমেনে যাইনি। কিন্তু এখানকার দোকান ও রেস্তোরাঁর নামগুলো দেখলে সৌদি আরবের সেই সব ছোট ছোট শহরগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। এই এলাকার ছোট দোকানগুলোতে মূলত লুঙ্গি ও বড় রুমাল বা স্কার্ফ বিক্রি হয়। এখানেই একজনের সঙ্গে আলাপ হল যিনি একটি ঠেলা গাড়িতে করে ফিগস বা শুকনো ডুমুর ও মালবেরি বা তুন্তফুল বিক্রি করেন, নাম আলি সালেহ বায়াজির। উনি আমার সঙ্গে কথা বলে খুব খুশি হয়েছিলেন। মূল ব্যারাকটির ঠিক সামনে ওনার ঠেলা গাড়িটা দাঁড় করানো থাকত। মূল ব্যারাকটি এখন কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

দুপুরের খাওয়ারের কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি আমাকে বললেন, হারিস ওঁর খুব প্রিয় এবং বললেন যে পুরোনো দিল্লির নীহারির মতো হারিসও শুধুমাত্র সকালবেলায় পাওয়া যায়।

halim_body1_051618071440.jpgহারিস

এক ভাগ হাব হারিস অথবা থেঁতো করা গমের সঙ্গে দু-গুণ পাঁঠার মাংস নিতে হবে। পাঁঠার মাংস ও গমকে আলাদা আলাদা করে রান্না করতে হবে, কারণ এই দুটো জিনিস সিদ্ধ হতে দুরকম সময় লাগে। এবার মাংসের সঙ্গে আদা, রসুন, দারুচিনি ও এলাচ মেশাতে হবে। এবার গম ও মাংস, এই দুটি উপকরণকে ভালো করে এক সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। যদি একটু কড়া স্বাদ পছন্দ চান তাহলে মিশ্রণটির সঙ্গে বেশ অনেকটা দিশি ঘি যোগ করে সঙ্গে কিছুটা বাদাম ও কাজু বাদাম বাটা মিশিয়ে দিতে হবে। শেষে ভাজা পেঁয়াজ উপর দিয়ে ছড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে।

হালিম আর হারিস এর পার্থক্যটা তাহলে কী? সালেহ আমাকে বলেন, হালিম রান্না করতে মাংসের সঙ্গে কোরমার মসলা ব্যবহার করা হয়। হায়দরাবাদের লোকেরা একটু মসলাদার হালিম পছন্দ করেন। সালেহ বলেন, তাঁর অনুমান যে এখানকার মানুষ নিজেদের স্বাদ ও পছন্দ মতো হালিমে বিভিন্ন মশলার ব্যবহার শুরু করেন।

এখানকার লোকেরা হালিম এবং হারিস বাড়িতেই রান্না করেন। সালেহ হারিস খেতে বেশি পছন্দ করেন।

এই চাউসেরা শুধু মাত্র নিজেদের সংস্কৃতিই নয়, গোষ্ঠীগত অনেক মূল্যবোধকেও এখনও ধরে রেখেছেন। সালেহ বলেন যে তাঁর মাথায় যতগুলো চুল আছে তার চেয়ে অনেক বেশি উপজাতি এখানে বাস করে।

বারকাসে ২০০-র ও বেশি উপজাতি বসবাস করেন। তাঁদের নিজেদের মসজিদ ও মাদ্রাসা আছে। যদিও এদের বাচ্চারা এখন স্থানীয় স্কুলগুলোতেই পড়াশোনা করে।

আমি খিচড়া খুব ভালোবাসি তাই এখানে প্রণালীটি লিখলাম:

halim_body2_051618071348.jpgবাড়িতে রান্না করা খিচড়া

ভাঙা গম বা দালিয়া - ২ টেবিলচামচ, ছোলার ডাল - ২ টেবিলচামচ, কলাইয়ের ডাল - ১ টেবিলচামচ, মসুরের ডাল - ১/২ টেবিলচামচ, মুগ ডাল- ১/২ টেবিলচামচ, চাল - ১/২ টেবিলচামচ, যব বা বার্লি - ২ টেবিলচামচ

১. উপরের সবকটি উপকরণকে দু-ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখুন। এবার নিচে দেওয়া উপকরণগুলি জলে মিশিয়ে জলটা ফুটিয়ে নিন:সরিষার তেল - ১ টেবিলচামচ, হলুদ - ১ চা-চামচ, ধনে গুঁড়ো - ২ চা-চামচ, আদা বাটা- ১ টেবিলচামচ, রসুন বাটা - ১ টেবিলচামচ, নুন ও লাল লঙ্কার গুঁড়ো স্বাদমতো, তেজপাতা - ১টি, বড় এলাচ - ২টি, লবঙ্গ - ২টি, গোল মরিচ - ৭ থেকে ৮টি

২.ভিজিয়ে রাখা ডাল উনুনে চাপান এবং এক ফুট দিন। ডালটি অনবরত নাড়ুন।

৩. চাপাঢাকা দিয়ে প্রায় ৮ মিনিট কম আঁচে বসিয়ে রাখুন।

৪. এবার এর সঙ্গে ভুনা মাংসটি ভালো করে মিশিয়ে নিন। 

৫. এবার এতে ১/৪ চামাচ গরম মসলা গুঁড়ো দিন।

৬. কিছুটা কুচোনো পেঁয়াজ ঘিয়ে ভেজে তুলে রাখুন।

৭. খিচড়া যোগ করুন। এবার পুদিনাপাতা, ধনেপাতা, আদাকুচি ও কাঁচালঙ্কা কুচি ছড়িয়ে কাটা লেবু যোগ করে পরিবেশন করুন।

অবশেষে আমি ইয়েমেনের লোকেদের জন্য প্রার্থনা করি কারণ তাঁরা নিজেদের দেশে দুর্ভিক্ষের মতো বিভিন্ন প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করছেন।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

RANA SAFVI RANA SAFVI @iamrana

The writer is the author of 'Where Stones Speak' and other books.

Comment