সিংরৌলিতে মিলল অনন্য বিষ্ণু ও ব্রহ্মামূর্তি, ইঁটে গুপ্তপূর্ব যুগের নিদর্শন
সপ্তম-অষ্টম শতকের বিষ্ণুমন্দিরের একটি ইঁটে স্কালক্যাপ পরিহিত মানুষের অবয়ব রয়েছে
- Total Shares
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা এএসআই) উত্তর ভারতের টেম্পল সার্ভে প্রকল্পের দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, সেই দফতর থেকে ২০১৭-১৮ সালে মধ্যপ্রদেশের সিংগরৌলী জেলায় অনুসন্ধানের কাজ শুরু হয়। এই জায়গাটি ভারতের শক্তিকেন্দ্র বা পাওয়ার ক্যাপিটাল নামে পরিচিত।
প্রায় দেড়শো বছরের মধ্যে সিংগরৌলীতে এই ধরনের কাজ এই প্রথমবার শুরু হল। এর আগে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম এবং তাঁর সহকারী গ্যারিক ও জে ডি বেগলার উনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে এই অঞ্চলে ব্যাপক মাত্রায় সার্ভের কাজ করেছিলেন।
উৎখননের আগে। (ছবি সৌজন্য: ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ)
তার পরে আরেক জন বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ স্বনামধন্য রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই অঞ্চলে কলচুরি রাজাদের মন্দির এবং স্থাপত্যকলা বিষয়ে প্রাথমিক বা মূল কাজ করে গেছেন। সেটি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। কলচুরি রাজাদের সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় ঘটিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসে।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে দীর্ঘ প্রায় ৭০-৮০ বছরের মধ্যে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এই অঞ্চলে কোনও সার্ভের কাজ করেনি। দীর্ঘ অন্তরালের পরে এখানে কাজ শুরু হয়েছে ২০১৭-১৮ সাল থেকে।
সিংগরৌলী জেলার জন্ম ২০০৮ সালে, এর আগে সিংগরৌলী জেলা ছিল সিধি জেলার অন্তর্গত এবং তার আগে এটি ছিল দেশীয় রেওয়া রাজ্যের অন্তর্গত। রামায়ণের আমরা যে ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষির কথা পাই, তাঁর নাম থেকেই এই স্থানের নাম হয়েছে সিংগরৌলী।
গত বছর ২০১৮ সালে সিংগরৌলী জেলা সদর থেরে ১৫ কিলোমিটার দূরে নাগওয়া নামে একটি গ্রামে খোঁড়াখুঁড়ির সময গ্রামবাসীরা হঠাৎই একটি বিষ্ণুমূর্তি খুঁজে পান। এই মূর্তিটি লাল পাললিক শিলায় তৈরী। মূর্তিকলার একটি অনন্য উদাহরণ হল এই মূর্তিটি। এখানে বিষ্ণুর দুই হাতে শঙ্খ ও চক্র থাকলেও অন্য দুই হাতের একটিতে রয়েছে বীজপূরক (বাতাবি লেবু) ও বাঁ হাত তাঁর কোমরে বাঁধা বাদ্যযন্ত্র বাদনরত।
সিংগরৌলীতে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তি। (ছবি সৌজন্য: ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ)
মূর্তি পাওয়ার খবর পেয়ে আমি যখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম দেখলাম, মাটির নীচে চাপা পড়ে যাওয়া দু’টি মন্দিরের একটির গর্ভগৃহে এই মূর্তিটি তাঁরা উদ্ধার করেছেন। যে বেদিকার উপরে মূর্তিটি দণ্ডায়মান, সেই বেদিকা ও গোড়ালি সমেত অংশটি উৎখনন করার সময় ভেঙে ফেলেন গ্রামবাসীরা। কালের নিয়মে যতটুকু ক্ষতি হয়েছে আর এই ভেঙে যাওয়া ছাড়া মূর্তিটি মোটের উপরে অটুটই ছিল। গ্রামবাসীরা খনন করার সময় সামান্য ভাবে দেওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিষ্ণু মন্দিরটিও মোটের উপরে অটুটই। ২০১৮ সাল থেকেই আমরা এখানে কাজ শুরু করি।
বিষ্ণুমন্দিরের পাশে একটি শিবমন্দির পাওয়া গেছে।
এই দুই মন্দিরই কলচুরিদের সময়ে সবচেয়ে প্রাচীন মন্দিরগুলির সমসাময়িক। এই অঞ্চলের আরও কয়েকটি মন্দিরের কথা অবশ্য আগেই জানা গিয়েছিল। মন্দিরগুলি কলচুরিদের সমসাময়িক।
সিংগরৌলির প্রত্নস্থল, উৎখননের পরে। (ছবি সৌজন্য: ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ)
আমি যখন এই এলাকায় ব্যাপক সার্ভে করি তখন দেখি যে, মন্দিরের সংখ্যা দু’টিতেই সীমাবদ্ধ নয়, মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকা আরও চারটি মন্দির চিহ্নিত করতে পারি। গ্রামবাসীরা বছর পাঁচেক আগে খোঁড়ার ফলে এর মধ্যে দু’টি মন্দির থেকে একটি ব্রহ্মার মূর্তি ও একটি বিষ্ণুর মূর্তি তাঁরা পান। এই দু’টি মূর্তিই সাদা পাললিক শিলায় তৈরি।
ব্রহ্মার মূর্তিটির বিশেষত্ব হল, ব্রহ্মার উষ্ণীষ (চুল বাঁধার ধরন) সপ্তম-অষ্টম শতকে চৈনিক ধাঁচের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ। এখানে কাজ শুরুর পরে শুধু গর্ভগৃহ নয়, বিষ্ণুর অধর্মণ্ডপও আবিষ্কার করি।
এই বিষ্ণুমন্দির থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে আবিষ্কারটি আমরা করি তা হল বিষ্ণুমন্দিরের দেওয়াল থেকে একটি ইঁট পাওয়া গেছে (মাপ মোটামুটি ভাবে ২০ সেমি x ২০ সেমি x ৫ সেমি) তাতে একটি মানুষের মূর্তি আঁকা রয়েছে। মূর্তিটির বিশেষত্ব হল: মূর্তিটির যে আভূষণ রয়েছে তার সঙ্গে ভারতীয় আভূষণের মিল নেই, বরং অধিক মিল রয়েছে আরব ও পারস্যের আভূষণের সঙ্গে। মূর্তির মাথায় যা পরানো রয়েছে তাকে এখন আমরা স্কাল-ক্যাপ বলে থাকি।
সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর ইঁটে স্কালক্যাপ পরিহিত ব্যক্তি। (ছবি সৌজন্য: ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ)
বিদিশার থাকা হেলিওডোরাসের পিলার ছাড়া এই ধরনের উদাহরণ এ দেশে বেশ বিরল। সেখানে অন্য একটি দেশের মানুষ (যাঁদের যবন বলা হত) এসে বৈষ্ণব হয়েছেন এমন উদাহরণ রয়েছে। এটি হল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে বিদেশি পোশাক পরিহিত মানুষের ছবি পাওয়া যাচ্ছে ধর্মের বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্দিরগাত্র থেকে।
এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, মূর্তিকলা ও স্থাপত্যকলার ভিত্তিতে প্রথমে মনে করা হচ্ছিল, প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যে অবশেষ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা সমস্তই সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর কলচুরি রাজত্বের সমসাময়িক।
এই মন্দিরের এক কিলোমিটার মতো দূর থেক আমরা আরও দু’টি জায়গায় উৎখনন করি সেখানেও মন্দির পাওয়ার সম্ভাবনা আছে মনে করে। অন্য দুটি ট্রেঞ্চে উৎখনিত ইঁট আমাদের গুপ্তপূর্ব যুগে নিয়ে যাচ্ছে। উৎখনিত অংশে পাথরের ভিত্তি-প্রাচীর পাওয়া গিয়েছিল, তার নীচে (২৫ সেমি) একটি ইঁটের সন্ধান পাই যেটি ব্রাহ্মী লিপিতে ‘র’ এবং ‘লা’ লেখা রয়েছে।
ব্রাহ্মী হরফ লেখা ইঁট। (ছবি সৌজন্য: ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ)
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সব আবিষ্কার এই অঞ্চলের নগরায়নের ইতিহাসকে ২০০০ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছে।
এখানে টেম্পল সার্ভে প্রকল্পের কাজ আমার অধীনেই শুরু হয়, কাজ হয ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯-এ। এখনও আমিই এই কাজের দায়িত্বে রয়েছি।
এই অঞ্চলে কলচুরি আমলের অসংখ্য মন্দির পাওয়া গেলেও এত বড় নাগরিক সভ্যতার চিহ্ন এর আগে পাওয়া যায়নি।