‘সাদামাটা দেখতে’ অমল পালেকর কী ভাবে নায়কের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছিলেন
২৪ নভেম্বর ৭৪-এ পড়ল সেই পাশের পাশের বাড়ির ছেলেটা
- Total Shares
রজনীগন্ধা ছবি মুক্তি পেল ১৯৭৪ সালে। মনু ভাণ্ডারীর গল্প ‘য়েহি সচ হ্যায়’ অবলম্বনে তৈরি সরল ও সোজাসুজি ছবি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আলোড়ন সৃষ্টি করল। সেই ‘অ্যাঙ্গরি ইয়ং ম্যান’ যুগে এই ছবিটি যেন নতুন হাওয়া বইয়ে দিল, জঞ্জির ছবির জেরে অমিতাভ বচ্চন তখন একেবারে শিখরে। তখনও সুপারস্টার রাজেশ খান্নার ম্যাজিক শেষ হয়ে যায়নি।
রজনীগন্ধী ছবিতে লাজুক ও নম্রস্বভাবের নায়ক অমল পালেকরকে প্রথম দেখা গেল (ছবি: ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব)
রজনীগন্ধা ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করলেন অতি সাদামাটা দেখতে, নিজেকে জাহির করার কোনও ব্যাপার নেই, লাজুক, বিনয়ী এবং অনেকটা সেই পাশের বাড়ির ছেলের মতো দেখতে অমল পালেকর, তাঁর বিপরীতে ছিলেন নতুন নায়িকা বিদ্যা সিনহা। ছবি দারুণ ভাবে চলল এবং দর্শকরা তাঁকে দারুণ ভাবে নায়ক হিসাবে মেনেও নিলেন – হিন্দি সিনেমায় নায়ক বলতে যা বোঝায় তিনি আসলে ছিলেন একবারেই তার বিপরীত।
অতি সাধারণ (তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তা ছিল মধ্যবিত্ত সাধারণ এক ব্যক্তির, যাঁকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়) এক ব্যক্তিকে রূপোলি পর্দায় দেখতে বেশ ভালোই লেগেছিল দর্শকদের, এই বদলটা তাঁদের পছন্দ হয়েছিল। রজনীগন্ধার পরে অমল পালেকর অভিনীত ছোটি সি বাত এবং চিতচোর ছবি দু’টি (দু’টি ছবিই মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৬ সালে) জনপ্রিয়তা লাভ করে। দু’টি ছবিই ছিল বিনোদনে ঠাসা আর এই ছবি দু’টিতেও পালেকরকে সেই সাদামাটা সাধারণ এমন এক ব্যক্তির ভূমিকায় দেখা যায় যিনি নিত্য নতুন সমস্যায় পড়ছেন।
ছোটি সি বাত ছবিতে তিনি হিসাব রক্ষকের (অরুণ) ভূমিকায় অভিনয় করেন যিনি বোম্বেতে কাজ করেন এবং তিনি যে মেয়েটিকে ভালোবাসেন (আবার সেই বিদ্যা সিনহা) কিছুতেই তাঁর মন জয় করতে পারছেন না। তারপরে তিনি অশোক কুমারের (কর্নেল জুলিয়াস নগেন্দ্রনাথ উইলফ্রেড সিং) কাছে একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী ও ভদ্র হওয়ার পাঠ নিলেন, অভিজ্ঞ অশোক কুমারের সঙ্গে তাঁর অনেকগুলি মনে রাখার মতো দৃশ্য রয়েছে।
বহু থিয়েটারে অভিনয় করার দৌলতে তাঁর প্রথম ছবি থেকেই অভিনয়ের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস দেখা গিয়েছিল পালেকরের মধ্যে। বোম্বের জেজে কলেজ অফ আর্ট থেকে পেন্টিংয়ের পাঠ নেওয়ার পরে তিনি ১৯৬০-এর দশকের একেবারে শেষ দিকে থিয়েটারে অভিনয় করতে শুরু করেন। তিনি ছবিতে যে সব ভূমিকায় অভিনয় করতেন সেখানে চরিত্রটি খানিকটা কিংকর্তব্যমিমূঢ় এবং যথেষ্ট লাজুক প্রকৃতির, যদিও চরিত্রাভিনেতা পালেকর মোটেই তেমন ছিলেন না!
চিতচোর ছবিতে তিনি ওভারসিয়ার (বিনোদ) চরিত্রটিতে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। নায়িকার মা-বাবা বিনোদকে ইঞ্জিনিয়ার ভেবে ভুল করেছিলেন, তাঁরা তার গ্রামে এসে তাঁদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের মেয়ে গীতার সঙ্গে বিয়ে স্থির করে গিয়েছিলেন। গ্রামের সেই মেয়েটি নায়কের চেয়েও অনেক বেশি দৃঢ়চেতা ছিলেন এবং স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেন যে তিনি বিনোদকে বিয়ে করবেন, ওই ইঞ্জিয়ারকে নয়। ছবি তাঁর অবস্থা একেবারে বলির পাঁঠার মতো ছিল!
সিনেমাজগতে পালেকরের যখন অভিষেক ঘটল অমিতাভ বচ্চন তখন অ্যাঙ্গরি ইয়ং ম্যান এবং রূপোলি পর্দায় তখন রাজেশ খান্নার দাপট
অমল পালেকরের সহজাত সরল-সাধাসিধে ভাব এবং ব্যক্তিত্বে সেই ভালোমানুষি ছাপ তাঁকে ওই সব চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। ঠিক কোন সময়ে মজা করতে হবে সে কথা তিনি কত সুন্দর ভাবে বুঝতেন তা দেখা গেল গোলমাল (১৯৭৯) এবং নরম গরম (১৯৮১) ছবি দুটিতে যেখানে তিনি সরল মুখ নিয়ে কৌতূক সৃষ্টি করতেন। কৌতূকাভিনেতার চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলতেন অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে, সর্বকালের সেরা শিল্পীদের অন্যতম উৎপল দত্তর সঙ্গে তাঁর রসায়ন এই ছবিগুলিকে সর্বকালের সেরা করে তুলেছে। বম্বের ছেলে হওয়ার জন্য চরিত্রগুলো নিয়ে তাঁকে খুব একটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়নি।
বাতো বাতো মেঁ (১৯৭৯) ছবিতে বান্দ্রার এক খ্রিস্টান ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অমল পালেকর যেখানে তাঁর নাম ছিল ব্রাগাঞ্জা, তিনি যে মেয়েটিকে (টিনা মুনিম) ভালোবাসতেন তাঁকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ভয়ে এড়িয়ে চলতেন বম্বের ছেলে হওয়ার দৌলতে এই ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য তাঁকে পরিশ্রম করতে হয়নি।
ছবিতে নিজের ভাবমূর্তি ভাঙতে পছন্দ করতেন পালেকর, যখন নতুন নায়ক হিসাবে দর্শক তাঁকে গ্রহণ করেছে এবং সেই ব্যপারটি তিনি অনুভব করছেন, তখন ভূমিকা (১৯৭৭) ছবিতে তিনি অনেকটা খলনায়কের পাঠ করলেন।
পালেকর সব সময়ই বলতেন যে তিনি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চান এবং বাধা ভাঙতে চান। তিনি ছবি প্রযোজনা করেছেন, ছবি নির্দেশনাও করেছেন – আর দুই ভূমিকাতেও তিনি খুবই ভালো করেছেন। টেলিভিশনের জন্য তিনি যে সব ধারাবাহিক করেছেন এবং যে ছবির তিনি নির্দেশনা করেছেন সেই দুই ক্ষেত্রেই শিল্পী হিসাবে তাঁর গভীরতা ফুটে উঠেছে।
অমল পালেকর ও উৎপল দত্ত যে ক্লাসিক উপহার দিয়েছেন তার জনপ্রিয়তা কোনও দিনই ম্লান হবে না (ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব)
যখন প্রথম তিনি ছবিতে অভিনয় করতে এলেন তখন যাঁরা বলতেন যে তিনি দেখতে খুবই সাদামাটা, অল্প দিনের মধ্যেই তাঁরা বুঝে গেলেন তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় করার ক্ষমতা কতটা, অনেক সময় তিনি যথেষ্ট দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর অভিনয়ক্ষমতা গোপনও করেছেন। তাঁর সেই কান এঁটো করা হাসির জন্যও দর্শকের কাছে তিনি প্রিয় হয়ে উঠেছেন।
উনিশশো ৭০-এর দশকে যিনি দর্শকদের মনে দাগ কাটতে শুরু করেছিলেন, সম্প্রতি সেই অভিনেতা-প্রযোজক-নির্দেশকের জন্মদিন ছিল। তাঁকে আমি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
আপকে কসম, নমক হারাম, দঙ্গ, রোটি, ত্রিশূল, দিওয়ার, অমর আকবর অ্যান্টনির মতো একের পর ব্লক ব্লাস্টার এবং অবশ্যই শোলের মতো সর্বকালের হিট ছায়াছবির বাজারে তাঁর ছবি জনপ্রিয় হয়েছে। এইরকম একটি সময়ে তিনি অভিনয় করেছেন অপেক্ষাকৃত অনেক শান্ত ছবিতে এবং তা করেও নিজেকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করেঠেন। এটাও খুব কম কথা নয়। তিনি চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসাবে সফল হওয়ার পরে নির্দেশনা – হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে তিনি চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
পালেকরকে নানা ভূমিকায় দেখা গিয়েছে এবং প্রতিটি ভূমিকাতেই তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তবে এর মধ্যে একেবারে সেরাটি হল রামপ্রসাদ দশরথপ্রসাদ শর্মা ও লক্ষ্মণপ্রসাদ দশরথপ্রসাদ শর্মা!
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে