কলাভবনের শতবর্ষ: নতুনকে গ্রহণ করাই মন্ত্র
চিন্তাভাবনা অনেক মুক্ত বলেই কোনও একটি ধারায় নিজেকে বেঁধে রাখতে হয় না
- Total Shares
একশো বছর পার হয়ে গেল কলাভবনের। অনেক প্রতিষ্ঠানই শতবর্ষ পার করে, তখন তুলন করা শুরু হয়, আগে কী ছিল, এখন কী হয়েছে। কলাভবনের ক্ষেত্রেও সেই তুলনা অনেকে করতে পারেন। এই প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবাদর্শে প্রতিষ্ঠিত বলেই এখানে নতুনকে সাদরে জায়গা করে দেওয়া হয়। নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাভাবনা এখানে সহজাত। তাই আমার মতে, ১০০ বছর পার করে এই প্রতিষ্ঠান অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।
সুসজ্জিত কলাভবন। (ছবি: সুবীর হালদার)
শতবর্ষ হিসাবে যে শোভাযাত্রা হয়েছিল সেই কথাই ধরা যেতে পারে। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী দাস প্রমুখের কাজের লাইভ ইলাস্ট্রেশন। তাঁদের ছবির জীবন্ত প্রতিমূর্তি – ধরুন সুজাতার কথাই। নন্দলাল বসুর শিল্প রইল, তাতে যোগ হল নতুন ভাবনা।
আঞ্চলিকতা এখানে রয়েছে, তবে অন্য ভাবে। এখানে আঞ্চলিকতা মানে এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের বিভেদ নয়, বরং সকলে মিলে থাকা এবং প্রাদেশিক সংস্কৃতিকে আরও ভালো ভাবে বাঁচিয়ে রাখা। তাই নন্দলাল বসু যে নন্দনমেলা শুরু করেছিলেন সেখানে বিভিন্ন ভাষার অনুষ্ঠান ছিল, আঞ্চলিক ভাষায় গান এই মেলার বড় আকর্ষণ।
মেলায় এখানের ছাত্রছাত্রীদের তৈরি জিনিসের সম্ভার থাকে, থাকে প্রাক্তনদের যোগদানও। ধরাযাক টেক্সটাইলস বিভাগের কথা। টাই অ্যান্ড ডাই (যার একটি উদাহরণ হল বাঁধনি), প্যাচওয়ার্ক সেখান থেকে মা-ঠাকুমাদের সময়ের কাঁথাস্টিচ – এখানে সবই থাকে। সেরামিকের কাজও আকর্ষণীয়।
নন্দনমেলায় প্রদর্শিত শিল্পকাজ বা আর্ট ইনস্টলেশন। (ছবি: সুবীর হালদার)
চিত্রাঙ্কনের একটি বিশেষত্ব রয়েছে। শুধু ভারতীয় শিল্পকলা, বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট বা ওয়েস্টার্ন আর্ট নয়, এখানে মিশ্রকলার প্রচুর উদাহরণ থাকে, এবারও ব্যতিক্রমী নয়। এখানে চিন্তাভাবনা অনেক মুক্ত বলেই কোনও একটি ধারায় নিজেকে বেঁধে রাখতে হয় না।
নন্দনমেলায় অন্যতম আকর্ষণ জগঝম্প পালা। নিজেদের লেখা নাটিকা নিজেরাই উপস্থাপন করা হয় ঘেরা জায়গায় অনেকটা যাত্রাপালার ধাঁচে। মাত্র ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে দেখতে হয়। সামান্য টাকা ধার্য করা হয়, যাতে শুধু উৎসাহীরা দেখতে পারেন আবার সেই অর্থ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যায়। ছোট ছোট পালা, বারে বারে হয়। তাই মেলায় এসে যাত্রা দেখার সুযোগ পাওয়া যায়, আবার কোনও একটা জায়গায় আটকেও পড়তে হয় না।
সেল্ফি তুলছেন মেলায় আগতরা। (ছবি: সুবীর হালদার)
প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও তার বাইরে যত ধারা রয়েছে সেই সব ধারার মিলনস্থল হল আমাদের এই প্রতিষ্ঠান। সময়ের সঙ্গে যে পরিবর্তন ঘটে, সেই পরিবর্তন খুব সহজেই গ্রহণ করা এই প্রতিষ্ঠানের ধর্ম। তবে অনিচ্ছায় নয়, এখানে সবকিছু গ্রহণ করা হয় স্বেচ্ছায়। পুরোনো আলপনা রয়েছে, কাঁথাস্টিচ রয়েছে আবার চাইলে কেউ তার সঙ্গে বিশ্বের অন্য কোনও প্রান্তের সংস্কৃতি প্রয়োগ করতে পারেন, সঙ্গে যোগ করতে পারেন নিজের ভাবনা। তা থেকে উঠে আছে শিল্পের নতুন কোনও ধাঁচ।
নন্দনমেলায় একটি বিপণী। (ছবি: সুবীর হালদার)
এখানে শিক্ষকরা উদারমনা, তাঁরা উৎসাহ দেন নতুনকে গ্রহণ করতে, তাঁরা শিক্ষার্থীদের সব সময় সহযোগিতা করেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব থাকে।
নতুনের প্রবেশে বাধা নেই বলেই যখন কোনও শিক্ষার্থী এখানে পাঠ শেষ করে কাজের জগতে প্রবেশ করে বা বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত হয় তার কাছে কোনও কিছুই নতুন মনে হয় না।
এবার আমাদের প্রতিষ্ঠান শতবর্ষ পার করল। মেলা-উৎসবে প্রতিবছর যা থাকে এ বছরও তাই-ই ছিল, শুধু তার আয়োজন, তার ব্যাপ্তি ও জাঁক ছিল অন্য বছরগুলির তুলনায় অনেক বেশি।